শ্রমিক হত্যার কি কোনো রাজনৈতিক দায় নেই

সম্প্রতি নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে সজীব গ্রুপের কারখানায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ফায়ার সার্ভিসের উদ্ধার তৎপরতাছবি: প্রথম আলো

সকালের নাশতায় নসিলা খাওয়া শিশুদের কজনেই-বা জানে যে সেগুলো তৈরি বা বয়ামে ভরার কাজ করত তাদের বয়সী ছেলেমেয়েরা। দেশের ভেতরের বিমানযাত্রায় যাঁরা সেজানের আমের রস খেয়েছেন, তাঁদেরও জানা ছিল না ওই সব মোড়কে মিশে আছে শিশুশ্রম। দেশের আইনে যেহেতু শিশুশ্রম নিষিদ্ধ, সেহেতু এমন কথা কারও ভাবনায় আসবেই-বা কেন? কথাটা আমরা জানলাম ৫২ জন পুড়ে কয়লা হওয়ার পর, যাদের বেশির ভাগই শিশু বলে আলামত ক্রমেই স্পষ্ট হচ্ছে। চকলেট পাউডার, ফলের পাল্প, অতিদাহ্য প্লাস্টিক, কাগজ আর কেমিক্যালে প্রথমে সেদ্ধ হওয়ার পর কয়লায় পরিণত হয়ে এসব শিশু জানিয়ে দিল, হাসেম ফুডস আইনের নাগালে ছিল না।

সজীব গ্রুপের কারখানাটির ঘটনায় গণমাধ্যম এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যে প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে, তার পরিণতিতে আপাতত কোম্পানিটির মালিক, তাঁর পরিবারের সদস্যসহ মোট আটজন গ্রেপ্তার হয়েছেন এবং পুলিশ তাঁদের রিমান্ডেও নিয়েছে। রানা প্লাজার ক্ষেত্রেও জনরোষের মুখে মালিক সোহেল রানা গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। ১ হাজার ১৩৬ জন শ্রমিকের হত্যা মামলায় গত আট বছরেও সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়নি। দুর্নীতির এক মামলায় অবশ্য সোহেল রানা দণ্ডিত হয়েছেন। শ্রম আইন লঙ্ঘনের জন্য আরও ডজনখানেক মামলা হয়েছে। তবে আইন প্রয়োগে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা যাঁদের, সেই কলকারখানা পরিদর্শকদের কারও কিছুই হয়নি। কয়েকজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা হলেও তাঁরা জামিনে মুক্ত আছেন। সজীব গ্রুপের ক্ষেত্রে কলকারখানা পরিদর্শন অধিদপ্তরের কারও বিরুদ্ধে এখনো কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানা যায়নি।

কলকারখানা পরিদর্শন অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের কথাবার্তায় অবশ্য বোঝায় উপায় নেই যে এতগুলো মৃত্যুর জন্য তাঁদের মধ্যে কোনো আত্মপীড়া কাজ করছে; বরং ইঙ্গিত মিলছে যে দায় এড়ানোর এক অদ্ভুত প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। অধিদপ্তরের নারায়ণগঞ্জ জেলার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা প্রথম দিনে প্রথম আলোকে জানিয়েছিলেন, কারখানাটি অনুমোদন নিয়েছে কেন্দ্রীয় দপ্তর থেকে এবং ২০০০ সালে চালুর পর থেকে বারবার অনুরোধ জানিয়েও তাঁরা পরিদর্শনের অনুমতি পাননি। তারপরও কারখানা পরিচালনার অনুমতি নবায়নে অবশ্য কোনো সমস্যা হয়নি। রোববার তাঁরাই আবার জানিয়েছেন, গত ৭ জুন কারখানাটি পরিদর্শন করা হয়েছিল কোভিডকালের স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা হচ্ছে কি না, তা যাচাইয়ের জন্য। তখন শিশুশ্রমের বিষয়টি নজরে এলে তা বন্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হলেও কারখানা কর্তৃপক্ষ কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।

কারখানাটিতে শিশুশ্রমিক নিয়োগের বিষয়টি হঠাৎ করেই যে ঘটেছে, বিষয়টি এমন হওয়ার কথা নয়। করোনাকালে অন্য শ্রমিক মিলছে না বলেই যে শিশুদের নিয়োগ করা হয়েছে, ঘটনা এ রকম যদি অন্য কোনো শিল্পে না ঘটে থাকে, তাহলে এই একটি কারখানায় তা কীভাবে হবে? শিশুশ্রমের বিষয়টিই যে কারখানাটির একমাত্র আইনবিরুদ্ধ কাজ, তা নয়। অগ্নিকাণ্ডের দুদিন পর রোববার ডেইলি স্টার-এর প্রধান প্রতিবেদক রায় পিনাকীর ঘটনাস্থল থেকে করা ভিডিও প্রতিবেদনে দেখা গেল, যে ভবনে আগুন লেগেছিল, সেটি কারখানার জন্য নির্ধারিত কোনো জায়গা নয়, বরং তাদের কেন্দ্রীয় গুদামঘর। সেন্ট্রাল স্টোর লেখা ভবনটিতে খাদ্যসামগ্রী উৎপাদনের কাজ করানো থেকে নিশ্চিত হওয়া যায়, গুদামঘরকেও কারখানা বানিয়ে ফেলা হয়েছিল। তবে ভিডিওতে সারি সারি ড্রাম, প্লাস্টিকের বোতলের গলিত স্তূপ, পোড়া-আধা পোড়া কার্টনের সারি দেখে বোঝাই যায়, গুদাম হিসেবেও ভবনটির ভূমিকা ছিল। কারখানা পরিদর্শকেরা একই ভবনকে গুদাম এবং কারখানার দ্বৈত উদ্দেশ্যে ব্যবহার বন্ধে হয় ব্যর্থ হয়েছেন, নয়তো তা মেনে নিয়েছেন। আগুনে ছয়তলার কিছু অংশ ধসে পড়ায় ইঙ্গিত মেলে, ভবনটি মোটেও দ্বৈত ব্যবহারের উপযোগী ছিল না।

ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারাও নিশ্চিত করেছেন, ভবনটি আইন অনুযায়ী হয়নি, যে কারণে জরুরি বেরোনোর জন্য প্রয়োজনীয়সংখ্যক সিঁড়ি ছিল না। তাঁরাও বলেছেন, কারখানায় প্রয়োজনীয় অগ্নিনির্বাপক সরঞ্জাম ছিল না এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য নোটিশ দেওয়া হয়েছিল। ভিডিও ফুটেজে লোহার গেটের তালাগুলো লাগানোই দেখা গেছে। ফায়ার সার্ভিসের সাবেক মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবু নাঈম মো. শাহিদউল্লাহ প্রথম আলোকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন, দাহ্য পদার্থের বিষয়ে বিস্ফোরক অধিদপ্তরের দায়িত্ব ছিল এবং তারা যে সেটি পালন করতে ব্যর্থ হয়েছে, তা–ও স্পষ্ট। তিনি বলছেন, ২০১৫ সালের শ্রম বিধিমালায় আগুনের ঝুঁকি মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় সতর্কতামূলক প্রস্তুতি নেওয়ার নির্দেশনা দেওয়ার এখতিয়ার কলকারখানা পরিদর্শন অধিদপ্তরকে দেওয়া আছে।

স্পষ্টতই আইন প্রয়োগের দায়িত্ব যেসব সরকারি দপ্তরের, সেগুলোর মধ্যে দুটি দপ্তর এই কারখানায় আইন প্রয়োগে হয় ব্যর্থ হয়েছে, নয়তো কোনো অজ্ঞাত কারণে তা করা থেকে বিরত থেকেছে। অজ্ঞাত কারণ হতে পারে এক বা একাধিক। যেমন রাজনৈতিক বা অন্য কোনো ক্ষমতার প্রভাব কিংবা ঘুষ-দুর্নীতি অথবা দুটোই। ব্যর্থতা, দায়িত্বে অবহেলা কিংবা দুর্নীতির ক্ষেত্রে এসব সরকারি আমলাকে জবাবদিহি আদায়ের দায়িত্ব হচ্ছে রাজনীতিকদের। আবার বেআইনি কাজে রাজনৈতিক প্রভাব ঠেকানোর দায়িত্বও রাজনৈতিক নেতৃত্বের। তবে আমলারাও যেমন এসব দুর্ঘটনার দায় গ্রহণ করেন না, রাজনীতিকেরাও তেমনি এড়িয়ে যান। সরকারি দপ্তরে চাকরিচ্যুতি এখন যেন একটি অজ্ঞাত সাজা, আর রাজনীতিকদেরও পদত্যাগের চল ইতিহাসে বিস্মৃত হয়েছে। শিল্প হোক কিংবা স্বাস্থ্য খাত—কোথাও দায়িত্ব নেওয়ার মতো নৈতিক উচ্চতা কোনো রাজনীতিকের মধ্যে আর আছে বলে মনে হয় না।

দেশে শ্রমসম্পর্কিত বিষয়গুলোর তদারকের দায়িত্বে একটি মন্ত্রণালয় আছে। তবে শ্রমিকদের স্বার্থে সেই মন্ত্রণালয় কতটা উৎসাহী বা দায়িত্বশীল, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। সরকার, মালিক সমিতি আর শ্রমিক—এই তিন পক্ষের সমন্বয়ে ন্যাশনাল ইন্ডাস্ট্রিয়াল হেলথ অ্যান্ড সেফটি কাউন্সিল গঠিত হলেও গত এক বছরে তার কোনো সভাই হয়নি বলে জানিয়েছেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) শাহিদউল্লাহ। প্রতি তিন মাস পরপর এই কাউন্সিলের সভা হওয়ার কথা। মহামারিকালে নানা বিষয়ে ভার্চ্যুয়াল সভা হলেও এই কাউন্সিল কেন সভা করতে পারে না? অবশ্য আইন থাকলেও যেমন তার প্রয়োগ হয় না, তেমনই সভা হলেই যে আইন প্রয়োগে নাটকীয় উন্নতি ঘটত, সে কথা কেউই জোর দিয়ে বলতে পারে না।

আমলারাও যেমন এসব দুর্ঘটনার দায় গ্রহণ করেন না, রাজনীতিকেরাও তেমনি এড়িয়ে যান। সরকারি দপ্তরে চাকরিচ্যুতি এখন যেন একটি অজ্ঞাত সাজা, আর রাজনীতিকদেরও পদত্যাগের চল ইতিহাসে বিস্মৃত হয়েছে।

রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর তৈরি পোশাকশিল্পে ঝুঁকি দূর করার লক্ষ্যে জাতীয় পর্যায়ে স্বাধীন একটি তদারক প্রতিষ্ঠান গড়ার আহ্বান জানানো হয়েছিল। কিন্তু পোশাক খাতের মালিক সমিতি এবং সরকার তা গ্রাহ্য করেনি। পরিণতিতে ওই শিল্পে নজরদারি ও তদারকের জন্য বিদেশি ক্রেতারাই চাপিয়ে দিয়েছিল অ্যাকর্ড আর অ্যালায়েন্সের মতো দুটি সংস্থা। সজীব গ্রুপের কোম্পানিগুলোও তাদের পণ্য বিদেশে রপ্তানি করে এবং গন্তব্য দেশগুলোর মধ্যে পাশ্চাত্যের একাধিক দেশও রয়েছে। ওই সব দেশের অধিকার গোষ্ঠীগুলো এখন একই রকম প্রতিকারমূলক ব্যবস্থার দাবি তুললে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। আমাদের স্থানীয় উদ্যোক্তারা বারবার প্রমাণ করছেন যে শ্রমের মান বা পরিবেশগত মান অনুসরণের প্রশ্নে বিদেশি ক্রেতাদের চাপ ছাড়া তাঁরা কিছু মানতে আগ্রহী নন।

বছরের পর বছর ধরে এভাবে আইন না মেনে প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনা কীভাবে সম্ভব হয়েছে? এ প্রশ্নের জবাব সম্ভবত প্রতিষ্ঠানের মালিক আবুল হাসেমের রাজনৈতিক পরিচয়ে। তিনি ক্ষমতাসীন দলের মনোনয়নে ২০০৮ সালের সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। ২০১৮ সালেও মনোনয়ন চেয়েছিলেন। ক্ষমতাসীন দলের পরিচয় না থাকলে সবার পক্ষে শুধু ঘুষের বিনিময়ে কাজ করিয়ে নেওয়া সম্ভব হয় না। বিশেষ করে পাকিস্তানের সেজান ব্র্যান্ডের উৎপাদন লাইসেন্সে নির্বিঘ্নে ব্যবসা করা রাজনৈতিক কারণেই বেশ দুরূহ।

সরকারি কর্মকর্তাদের ভাষ্য, বেঁচে যাওয়া শ্রমিকদের অভিজ্ঞতার বিবরণ এবং সংবাদমাধ্যমে উঠে আসা চিত্র থেকে এটিকে যেমন নিছক দুর্ঘটনা বলার অবকাশ নেই, তেমনি এই হত্যাকাণ্ডের বিচার চাইলে আগে বলতে হবে আইনের শাসনের কথা। অবশ্য আইনের শাসন চাইতে হলে যে আগে গণতন্ত্র প্রয়োজন, সে কথা আমরা অনেক আগেই বিস্মৃত হয়েছি। অতএব, সাময়িক হাহুতাশ, ক্ষতিপূরণ ও কথিত দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি তুলেই আমরা ক্লান্ত হয়ে পড়ি। নতুন নতুন অঘটনের বাহুল্যে আগেরগুলো হারিয়ে যায়।

কামাল আহমেদ সাংবাদিক