শ্রমিকের সস্তা জীবন, মায়ের আহাজারি আর ধনীর ‘উন্নয়ন’

নিহত শ্রমিক মোহাম্মদ রেজার লাশ নি‌য়ে মা‌য়ের আহাজা‌রি। বাঁশখালী উপ‌জেলা হাসপাতা‌লে |
ছ‌বি: সৌরভ দাশ

১৭ এপ্রিল ২০২১-তে প্রথম আলোয় প্রকাশিত একটি ছবিতে চোখ আটকে যায়। ১৮ বছর বয়সী এক শ্রমিকের লাশের ছবি। মনে হচ্ছে এখনো তারুণ্য না পার হওয়া ছেলেটি নির্বিঘ্নে ঘুমাচ্ছেন আর সন্তানের মুখ দুই শীর্ণ হাতে আঁকড়ে ধরে আছেন মা। ছবির ক্যাপশন পড়ে বুঝলাম মা মাথা নিচু করে আহাজারি করছেন। মা আর মৃত সন্তানের এ ছবিটির মতো হৃদয়বিদারক এ পৃথিবীতে কি আর কিছু আছে? অথচ এই গল্পটি অন্য রকম হতে পারত। যে বকেয়া বেতনের জন্য প্রতিবাদ করতে গিয়ে গুলি খেয়ে মরলেন, সেই বেতনে হয়তো তরুণটি মায়ের জন্য একটি নতুন শাড়ি কিনে আনতে পারতেন। মায়ের চোখে অশ্রুর বদলে থাকতে পারত সুখের হাসি।

চট্টগ্রামের বাঁশখালী কয়লাবিদ্যুৎকেন্দ্রে পুলিশের গুলিতে নিহত শ্রমিকদের বয়স ১৮ থেকে ২৪-এর মধ্যে। জীবন শুরু করতে না করতেই শেষ হয়ে গেল। এই বিদ্যুৎকেন্দ্র ঘিরে শুরু থেকেই জনমানুষের বিরোধিতা ছিল। এর আগেও এই বিদ্যুৎকেন্দ্রকে ঘিরে প্রাণহানি ঘটেছে। আমাদের এই দেশে গরিবের মৃত্যু সহজ, সংক্ষিপ্ত আর খুব সস্তা। তাই কয়েক লাখ টাকার ক্ষতিপূরণে মুখ বন্ধ হয়ে যায় সবার। হত্যাকাণ্ডের কোনো সুষ্ঠু বিচার হয় না।

বকেয়া বেতনের দাবিতে আন্দোলন যেকোনো দেশেই স্বাভাবিক ঘটনা। আন্দোলন ঠেকানোর তো নানা উপায় আছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুলি করে মেরে ফেলার মতো ঘটনা বারবার কেন ঘটছে, তার কারণ বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন। সাধারণত কর্তৃত্ববাদী সরকারব্যবস্থায় সবকিছু নিয়ন্ত্রণে রাখতে ভয়ের সংস্কৃতি সমাজের সব স্তরে জারি রাখা প্রয়োজন হয়, তারই ধারাবাহিকতায় যেকোনো ধরনের প্রতিবাদ ও আন্দোলনকে কঠোর হাতে দমন করা জরুরি হয়ে পড়ে।

উন্নয়নের পথযাত্রায় দেশের মানুষ কতটা লাভবান হচ্ছে সেই প্রশ্ন থাকলেও একটি শ্রেণি যে লাভাবান হচ্ছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তাই ক্ষমতার আশপাশে থাকা যেকোনো গোষ্ঠীর বিনিয়োগের বিরুদ্ধে আন্দোলনকেও ‘উন্নয়নবিরোধী’ হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে।

সুইডেনের গোথেনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা অনুযায়ী কর্তৃত্ববাদী সরকারগুলোর জন্য এখন সবচেয়ে বড় হুমকি যে কোনো ধরনের গণ-আন্দোলন। বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাও সম্ভবত জানেন যেকোনোভাবে আন্দোলন ঠেকাতে হবে। তাই প্রাণঘাতী অস্ত্রের ব্যবহারের ক্ষেত্রে কোনো সংযম দেখা যাচ্ছে না। তারা হয়তো এটাও জানেন যে তাদের এ ধরনের আচরণ সরকারের সমর্থন পাবে।

এখন প্রশ্ন আসতে পারে সরাসরি সরকারবিরোধী আন্দোলন নয়, এমন ক্ষেত্রেও কেন সরকার এত কঠোর। বাংলাদেশের বিগত নির্বাচনগুলো ব্যাপক প্রশ্নবিদ্ধ। এমন একটি বাস্তবতায় বর্তমান সরকার তার ক্ষমতায় থাকার বিষয়টিকে বৈধতা দিতে উন্নয়নের বয়ানকে ব্যবহার করছে। যে কোনো ধরনের ‘উন্নয়ন’ কাজে ভূমি অধিগ্রহণ থেকে শুরু করে প্রকৃতি ও পরিবেশ বিরোধী নানা কর্মকাণ্ড ঘটে, যার বিরোধিতাও হয়। এই উন্নয়নের পথযাত্রায় দেশের মানুষ কতটা লাভবান হচ্ছে সেই প্রশ্ন থাকলেও একটি শ্রেণি যে লাভাবান হচ্ছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তাই ক্ষমতার আশপাশে থাকা যেকোনো গোষ্ঠীর বিনিয়োগের বিরুদ্ধে আন্দোলনকেও ‘উন্নয়নবিরোধী’ হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে।

বাংলাদেশের অর্থনীতির অভূতপূর্ব অগ্রগতি হয়েছে বলে আমরা শুনে আসছি। উন্নয়নের এই স্তুতি দেশের গণ্ডি ছড়িয়ে দেশের বাইরেও শোনা যায়। বিশ্বব্যাংক আর আইএমএফও তাদের উন্নয়নের সফলতা দেখাতে বাংলাদেশের কথা উল্লেখ করে। মানব উন্নয়ন সূচকের নানা ধারায় বাংলাদেশ কীভাবে দ্রুতগতিতে উন্নতি করছে, তা নিয়ে অনেকেই বিস্ময় প্রকাশ করেন। সুশাসন, শক্তিশালী রাষ্ট্রীয় কাঠামো ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ছাড়াও বাংলাদেশ কীভাবে উন্নয়ন করছে, তা অনেকের কাছে একটি ধাঁধা। তবে বাংলাদেশের এই দ্রুত উন্নতির প্রতিফলন কি সমাজের সব স্তরে রয়েছে নাকি অল্প কিছু মানুষ ফুলে-ফেঁপে উঠছেন, তা একটি জরুরি প্রশ্ন।

আর এই কথিত উন্নয়নের মান নিয়েও প্রশ্ন তোলা দরকার। ২০২০ সালের নভেম্বর-ডিসেম্বরে সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) গবেষণায় দেখা যায়, করোনা মহামারিতে দারিদ্র্যের হার বেড়ে ৪২ শতাংশ হয়েছে। এমনকি করোনা মহামারি আসার আগেও বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ধনী-গরিব বৈষম্যও বেড়েছে। গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের ‘বাংলাদেশ অর্থনীতি ২০১৭-১৮: প্রথম অন্তর্বর্তীকালীন পর্যালোচনা’ অনুযায়ী বাংলাদেশে ধনীরা আরও ধনী আর গরিবেরা আরও গরিব হচ্ছেন। সবচেয়ে দরিদ্র ৫ শতাংশের খানাপ্রতি আয় (হাউজহোল্ড ইনকাম) ২০০৫ সালে ছিল ১ হাজার ১০৯ টাকা। ২০১৬ সালে তা কমে ৭৩৩ টাকা হয়। আর ধনী ৫ শতাংশের ২০০৫ সালে খানাপ্রতি আয় ছিল ৩৮ হাজার ৭৯৫ টাকা। এই আয় ২০১৬ সালে দ্বিগুণের বেশি বেড়ে দাঁড়ায় ৮৮ হাজার ৯৪১ টাকায়।

তাই যে ব্যবস্থার মধ্যে বাংলাদেশের মানুষ বসবাস করছে, তা যেন কেবল ধনিক শ্রেণির সুবিধা দেখে আর ওপরে ওঠার সিঁড়ি তৈরি করে দেয়। আর খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ কোনো ইস্যুতে প্রতিবাদ করলেই ধেয়ে আসে জুলুম, তাদের সেই সব দাবি-দাওয়া যত ন্যায্য ও ন্যায়সংগতই হোক না কেন। ধনীর জামিন হয় আদালতে না এসেই, তাদের দুয়ারে উপস্থিত থাকে উড়োজাহাজ। যাঁরা গণতন্ত্রের কমতিকে উন্নয়নের খাতিরে বৈধতা দিতে চান, গণতন্ত্রের প্রশ্নে চীনের মডেলকে কার্যকরী মনে করেন, তাঁরা ভুলে যান চীনের মডেলে লুটেরাতন্ত্র আর দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেওয়া হয় না।

কোনো ধরনের সামাজিক উন্নয়ন কর্মসূচি না নিয়ে, শুধু ধনিক শ্রেণি তোষণ করে যে উন্নয়ন, তা একদিকে সমাজে বৈষম্য বাড়ায় আর অন্যদিকে গণতন্ত্রহীনতাকেও বৈধতা দেয়। তাই আমরা না পাই গণতন্ত্র, না পাই সত্যিকারের উন্নয়ন। আমরা পাই শ্রমিকের রক্ত-ঘামে ধনীর উল্লম্ফন, আর গরিবের দীর্ঘশ্বাস ভরা ‘উন্নয়ন’।

সাইমুম পারভেজ নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজবিজ্ঞান ও রাজনীতি বিভাগের শিক্ষক।