শ্রাবণেও খেতে পানি নেই, উপায়?

আষাঢ়-শ্রাবণেই বেশির ভাগ বৃষ্টিপাত হয়। এখন শ্রাবণ মাস চললেও পর্যাপ্ত বৃষ্টির অভাবে খেতে পানি নেই। চিন্তিত কৃষকেরা।
ফাইল ছবি: প্রথম আলো

জুন থেকে অক্টোবর ভারী মৌসুমি বৃষ্টিপাত হয়। এখন জুলাই; আগস্ট হয় হয় ভাব। বাংলায় শ্রাবণ মাস। আষাঢ়-শ্রাবণেই বেশির ভাগ বৃষ্টিপাত হয়। অথচ পাট জাগ দেওয়ার পানি নেই, আমন আবাদের জমি প্রস্তুতে ভরসা ভূগর্ভস্থ আর্সেনিকওয়ালা পানি। ধান আবাদ বলতে আমন আবাদকেই বোঝায়। আউশ বা ইরিতে ভূগর্ভস্থ পানি আর রাসায়নিক সারের নির্ভরতার কারণেই এটা ঘটে। আধিয়াররাও আমনের শর্ত দিয়েই বর্গা নেন।

চিলমারী ব্রহ্মপুত্র আর তিস্তার মতো বড় দুই নদ–নদীর মাঝখানে হওয়ায় কয়েকটি নদী চিলমারী ভেতর দিয়ে বয়ে গেছে। এ কারণে ১৮৩৮ সালে লন্ডন থেকে প্রকাশিত হিস্ট্রি, এন্টিকুইটস, টপোগ্রাফি অ্যান্ড স্ট্যাটিসটিকস অব ইস্টার্ন ইন্ডিয়া গ্রন্থে মন্টেগোমারি মার্টিন বলছেন, ‘সাধারণ প্লাবনেই কয়েকটি বাড়ি বাদে পুরো চিলমারীই ডুবে থাকে। আর এই বিস্তৃত প্লাবন ভূমিকে অসামান্য মাত্রার উর্বরতা দান করে।’ তিনি আরও বলেন, চিলমারী হলো গোটা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের মধ্যে গ্লাসগো ও লিভারপুলের সঙ্গেই কেবল তুলনীয় শহর। অর্থাৎ চিলমারীর এই উন্নতির পেছনে এই প্লাবনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। প্রকৃতপক্ষে এ সত্য পুরো বাংলাদেশের জন্যই প্রযোজ্য।

১৭ শতকে ফরাসি পর্যটক বার্নিয়ে যখন প্লাবন সেচ দেখেছিলেন, তখন নদ–নদীর পাড় ছিল নিচু। বন্যার পানি তখন খোলাখুলি চলে আসত। খালের সঙ্গে নদীর সংযোগস্থলে কোনো পাড়ই থাকত না। এ অবস্থায় মাছের ডিম ভেসে ভেসে খালে চলে আসত, সেখান থেকে ধানখেত-পুকুর ও জলাশয়ে। মাছগুলো কিছুদিনের মধ্যেই তরুণ হয়ে উঠত। তারা দ্রুতই মশার লার্ভা খেয়ে ফেলত। বাংলাদেশ ভরে উঠত মাছে। আর এই সেচ মাটিকে যেমন সমৃদ্ধ করত, তেমনি নদীতে পানির চাপ অসম্ভব করে তুলত।

২.

আধুনিক সেচব্যবস্থার জনক স্যার উইলিয়াম উইলকক্স তাঁর বাংলার নিজস্ব সেচব্যবস্থা (অনুবাদ: ফারুক ওয়াসিফ, ডাকঘর, ২০২১) বইয়ে বলেছেন, বাংলার আদিযুগের কতিপয় রাজা তখন প্লাবন-সেচ পদ্ধতির উদ্ভাবন ও প্রচলন ঘটান। এটাই শত শত বছরের জন্য বাংলার সম্পদ ও সুস্বাস্থ্যের নিশ্চয়তা এনে দিয়েছিল। অববাহিকা-সেচ যেমন মিসরের জন্য, স্থায়ী-সেচ যেমন ব্যাবিলনের জন্য একদম মোক্ষম ছিল, তেমনি বাংলার জন্য উপযুক্ত ছিল এই প্লাবন-সেচের ব্যবস্থা।

স্যার উইলকক্স স্বীকার করেছেন, ‘২০০ বছরের অবহেলায় এই নদীগুলোকে আবার ভরে যেতে দেওয়া হয়েছে। ...আমার মনে আছে, আমি যখন এ দেশের সেচব্যবস্থার জন্য খাল খননের নকশা করতে গেলাম, তখন বিস্মিত হয়ে দেখলাম, মানচিত্রে তথাকথিত কানা নদীগুলো যেমনভাবে বিন্যস্ত রয়েছে, বাস্তবেও তেমনটাই হওয়া উচিত।’

তাহলে ব্রিটিশ–পূর্ব যুগে সেচব্যবস্থাপনা কেমন ছিল? নদী ও খালের পানির দায়িত্ব তুলে দেওয়া হতো আঞ্চলিক সংস্থাগুলোর ওপর। এই সংস্থাগুলো কাজ করত কৃষকদের মাধ্যমে। কৃষকদের আবার দায়িত্ব ছিল পানি যাতে সব জমিতে পৌঁছায়, তা নিশ্চিত করা। যে পথে পানি কম বাধা পায়, সে পথেই গড়ায়। ফলে সব জমিতে পানি পৌঁছাত না। এতে মশার বংশবিস্তার নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হতো না। তাই জমি থেকে জমিতে পানি যাওয়ার বন্দোবস্ত এমন আন্তরিকতার সঙ্গে করা হতো এবং প্রত্যেকে এমনভাবে জড়িয়ে যেত, যেন প্রতিবেশীর জমিটা তার নিজেরই জমি। কেননা, প্রতিবেশীর স্বার্থ থেকে নিজের স্বার্থ কেউ আলাদা করতে পারত না।

৩.

কিন্তু এখন? আইয়ুব খানের পানি উন্নয়ন বোর্ড নদীগুলোর দুই পাড় বেঁধে দিয়েছে। ছোট নদীগুলোর সংগমস্থলগুলোয় কোথাও বাঁধ, কোথাও স্লুইসগেট দিয়ে বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে বড় নদী থেকে। কুড়িগ্রাম জেলার উলিপুরের বুড়িতিস্তা নদীর উৎসমুখ বাঁধ দিয়ে তিস্তা থেকে আর অন্য মুখটি স্লুইসগেট দিয়ে ব্রহ্মপুত্র থেকে বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। ফলে উজান থেকে আসা মূল তিস্তা নদীর ঘোলা পানি বুড়িতিস্তায় ঢুকতে পারে না। ফলে, বুড়িতিস্তা উলিপুরের কৃষি ও স্বাস্থ্যে ভূমিকা পালন করতে পারে না।

এদিকে সম্প্রতি সেচ অধিদপ্তরের খাল খনন কর্মসূচিতে বুজে যাওয়া এবং আবাদি জমিতে দখল হওয়া নদ–নদীকে খাল হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। আর সেসব খাল খনন করা হয়েছে এক বিল থেকে আরেক বিল পর্যন্ত। এটি হয়েছে তিস্তার শাখানদী মানাসের বেলায় যেমন, তেমনি ব্রহ্মপুত্রের শাখানদী মাইলডাঙ্গার বেলায়ও। দুটোই চিলমারী উপজেলারই ঘটনা।

চলছে বর্ষাকাল। কিন্তু বৃষ্টির দেখা নেই। এই মৌসুমে উজানের ঢলের কারণে ভারত যে পানি ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়, তা–ও আমাদের জমিকে উর্বর করা, মশা নিধন ও মাছ উৎপাদনে ভূমিকা রাখতে পারত। স্যার উইলকক্সের ভাষায়, ‘আপনাদের নদীগুলোই আপনাদের তৎপর হতে ডাক দিচ্ছে। ...আপনাদের খালের সমৃদ্ধ ঐতিহ্যকে অধিকার করে নিন।’ কিন্তু আমরা কি তা গ্রহণে সক্ষম?

নাহিদ হাসান রেল-নৌ, যোগাযোগ ও পরিবেশ উন্নয়ন গণকমিটির কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের সাবেক সভাপতি

[email protected]