শ্রীলঙ্কার চীনা নির্বাচন

এ মাসে অনুষ্ঠেয় শ্রীলঙ্কার সংসদ নির্বাচনে শুধু দেশটির রাজনৈতিক ভবিষ্যৎই নির্ধারিত হবে না, ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলের বৃহত্তর ভূরাজনীতির গতিপথও নির্ধারিত হবে। ভারত মহাসাগর সারা পৃথিবীর বাণিজ্য ও জ্বালানি পরিবহনের কেন্দ্র, এই মহাসাগর দিয়ে বিশ্বের অর্ধেক কনটেইনার ও পেট্রোলিয়ামের ৭০ শতাংশ পরিবহন হয়। শ্রীলঙ্কার কৌশলগত গুরুত্ব চীনের জন্য বিনষ্ট হয়নি। এদিকে চীন আবার ভারত মহাসাগরে নিজের অস্তিত্ব শক্তিশালী করার চেষ্টা করছে, ফলে সে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের মাথাব্যথার কারণ হয়ে উঠেছে।
শ্রীলঙ্কার এই আসন্ন নির্বাচনে অন্যতম একজন প্রতিদ্বন্দ্বী হচ্ছেন দেশটির সাবেক প্রেসিডেন্ট মাহিন্দা রাজাপক্ষে। এই জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তাঁর মর্মান্তিক পরাজয়ের আগে তিনি নয় বছর দেশটির প্রেসিডেন্ট ছিলেন। তাঁর এই পরাজয়ের কারণ ছিল ক্রমবর্ধমান কর্তৃত্বপরায়ণ শাসন, স্বজনপ্রীতি ও দুর্নীতি। তবে এটা ঠিক, এই রাজাপক্ষেই ২০০৯ সালে শ্রীলঙ্কার ২৬ বছর ধরে চলা তামিল বিদ্রোহের অবসান ঘটিয়েছিলেন। ফলে শ্রীলঙ্কার সিংহভাগ সিংহলি মানুষ তাঁকে বীর হিসেবেই মনে করতে শুরু করে। তবে এটা ছিল খুবই নির্মম অভিযান। অভিযোগ আছে, রাজাপক্ষে যুদ্ধাপরাধের নেতৃত্ব দিয়েছেন। তামিল বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত আঘাত হানার প্রক্রিয়ায় প্রায় ৪০ হাজার বেসামরিক মানুষ নিহত হয়েছে।
রাজাপক্ষে যখন প্রেসিডেন্ট ছিলেন, তখন ভারতের সঙ্গে শ্রীলঙ্কার সম্পর্ক খারাপ হয়েছিল। এটা হয়েছিল অংশত এ কারণে যে তাঁর সরকার সংখ্যালঘিষ্ঠ তামিল সম্প্রদায়ের সঙ্গে মতপার্থক্য ঘোচাতে পারেনি (ভারতের তামিল মানুষের সংখ্যা নেহাত কম নয়)। কিন্তু রাজাপক্ষের সময় চীনের সঙ্গে শ্রীলঙ্কার সম্পর্কের উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়। কয়েকটি চীনা প্রতিষ্ঠান শ্রীলঙ্কায় বেশ কিছু লাভজনক কাজ করার সুযোগ পায়। ফলে চীন যে ‘মেরিটাইম সিল্ক রোড’–এর পরিকল্পনা করছে, সেখানে শ্রীলঙ্কা এক গুরুত্বপূর্ণ যাত্রাবিরতির জায়গা হিসেবেই বিবেচিত হবে। এই রুট এশিয়ার সঙ্গে আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের যোগাযোগ স্থাপন করবে।
এই মেরিটাইম সিল্ক রোড শুধু বাণিজ্যের উদ্যোগ নয়, এর মাধ্যমে তেল ভরা, নতুন সরবরাহ, কর্মীদের বিশ্রাম ও রক্ষণাবেক্ষণের চীনা জাহাজ বেশ কয়েকটি দিক দিয়ে ভারত মহাসাগরে ঢুকতে পারবে। চীনের এই অর্থনৈতিক ও সামরিক স্বার্থের একীভবনের ব্যাপারটা গত শরৎকালেই বোঝা
গিয়েছিল। সেবার চীনের একটি সাবমেরিন শ্রীলঙ্কার রাজধানী কলম্বোর একটি চীনা মালিকানাধীন কনটেইনার টার্মিনালে ঢুকেছিল। এসব কর্মকাণ্ডের কারণে শ্রীলঙ্কা ভারতের কিউবায় পরিণত হতে পারে।
রাজাপক্ষের উত্তরসূরি মাইথ্রিপালা সিরিসেনা ও প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহে বুঝতে পেরেছেন, চীনের সঙ্গে এমন গাঁটছড়ার বিপদ কী হতে পারে। সিরিসেনা রাজাপক্ষের মন্ত্রিসভার স্বাস্থ্যমন্ত্রী ছিলেন। এরপর তিনি পদত্যাগ করে তাঁর সাবেক বসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের সময় অর্থাৎ নির্বাচনী প্রচারণায় তিনি বলেছিলেন, চীনকে এসব ঠিকা দেওয়ার কারণে শ্রীলঙ্কা এক গভীর ফাঁদে পড়তে যাচ্ছে।

>আসন্ন নির্বাচনে ভোটাররা কার্যকরভাবেই সিদ্ধান্ত নেবেন, তাঁদের দেশ কি চীনের আঞ্চলিক উচ্চাকাঙ্ক্ষার সামনে মাথা নত করবে, নাকি স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি ও উন্মুক্ত অর্থনীতি গ্রহণ করে নিজের ভবিষ্যৎ নিজেই গড়ে নেবে

একইভাবে সিরিসেনা তাঁর নির্বাচনী ইশতেহারে সতর্ক করে বলেছিলেন, ‘সাদা মানুষেরা সামরিক বলপ্রয়োগের মাধ্যমে আমাদের কাছ থেকে যে ভূমি কেড়ে নিয়েছিল, এখন আবার একদল বিদেশি মুষ্টিমেয় কিছু মানুষকে ঘুষ দিয়ে তা হাতিয়ে নিচ্ছে...এই ধারা আগামী ছয় বছর চললে আমরা উপনিবেশে পরিণত হব, আমরা দাস হয়ে যাব।’ এই মেনিফেস্টোতে চীনের নাম না থাকলেও ইঙ্গিতটা পরিষ্কার।
ক্ষমতায় আসার পর সিরিসেনা পুনরুদ্ধার করা জমিতে চীনা ফার্মের ১ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলারের শহর নির্মাণ প্রকল্প স্থগিত করে দেন। তিনি চীনের এক রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে পরিবেশ দূষণ ও দুর্নীতির অভিযোগ তদন্তের নির্দেশ দেন। সেই প্রতিষ্ঠান নাকি রাজাপক্ষেকে পুনর্নির্বাচনের প্রচারণার জন্য ১ দশমিক ১ মিলিয়ন ডলার ঘুষও দিয়েছিল। রাজাপক্ষে প্রেসিডেন্টের যেসব ক্ষমতা বাড়িয়েছিলেন, সিরিসেনা সংবিধান সংশোধন করে সেসব রদ করেছেন, আর একজন ব্যক্তি সর্বোচ্চ দুবার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হতে পারবেন, সেই বাধ্যবাধকতাও তিনি ফিরিয়ে আনেন (কিছুটা বিপরীতভাবে, এতে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা বেড়েছে, আর রাজাপক্ষে এখন প্রধানমন্ত্রী হওয়ার জন্য লড়ছেন)।
গত মাসে সিরিসেনা হঠাৎ করেই রাজাপক্ষেকে সংসদ নির্বাচনে শ্রীলঙ্কা ফ্রিডম পার্টির (এসএলএফপি) টিকিটে নির্বাচন করার অনুমতি দেন। সিরিসেনা প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর এই পার্টির ক্ষমতা রাজাপক্ষের কাছ থেকে নিয়ে নেন। বিক্রমাসিংহের গণতন্ত্রপন্থী দল ইউনাইটেড ন্যাশনাল পার্টি এই নির্বাচনে এসএলএফপির প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী, ওদিকে আবার এসএলএফপির অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব-বিবাদ ক্রমেই বাড়ছে। এ অবস্থায় রাজাপক্ষেকে ছাড় দেওয়া ছাড়া সিরিসেনার তেমন কিছু করার নেই।
আর এসএলএফপি নির্বাচনে জিতলেই যে রাজাপক্ষে নতুন সরকারের নেতৃত্ব দেবেন, এমন কথা নেই। এ বিষয়টা নির্ভর করছে সিরিসেনার ওপর। ফলে প্রশ্ন হচ্ছে, সিরিসেনা নিজের পূর্বসূরিকে কতটা ছাড় দেবেন, আর নির্বাচনে জেতার দর-কষাকষিতে তিনি নিজের নৈতিক মূল্যবোধ কতটা ছাড় দিয়েছেন।
এটা মনে রাখা দরকার, রাজাপক্ষে প্রধানমন্ত্রী না হলেও তিনি তো সংসদের একটি আসনে জিততেই পারেন। এতে তিনি যে প্রভাব-প্রতিপত্তি অর্জন করবেন, সেটা এসএলএফপির উপদলকে খোলাখুলি নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। সন্দেহ নেই, প্রধানমন্ত্রী হলে জাতীয় নীতি প্রণয়নে তাঁর আরও প্রভাব থাকত।
উদার ও সংখ্যালঘিষ্ঠ মানুষেরা ঠিক এই ভয়টিই পাচ্ছে। রাজাপক্ষের কর্তৃত্ববাদী শাসনের সঙ্গে তুরস্কের রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের মিল রয়েছে। এই মানুষটি এক দশকেরও বেশি সময় ধরে প্রধানমন্ত্রী থাকার পর গত বছর দেশটির প্রথম নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট হয়েছেন। এরদোয়ান যেমন তুরস্কে ইসলামবাদের পালে হাওয়া দেন, তেমনি সিরিসেনা শ্রীলঙ্কায় সিংহলি জাতীয়তাবাদের পালে হাওয়া দেন।
ওদিকে রাজাপক্ষে আবার ক্ষমতায় গেলে চীন নিঃসন্দেহে তা উদ্যাপন করবে। শ্রীলঙ্কার বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে চীনের অভিযোগ হচ্ছে, তারা ‘চীনের সঙ্গে অপরাধীর মতো আচরণ করছে’। ফলে এটা নিশ্চিত যে শ্রীলঙ্কা চীনের ভারত মহাসাগর–বিষয়ক কৌশলের গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
আসন্ন নির্বাচনে ভোটাররা কার্যকরভাবেই সিদ্ধান্ত নেবেন, তাঁদের দেশ কি চীনের আঞ্চলিক উচ্চাকাঙ্ক্ষার সামনে মাথা নত করবে, নাকি স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি ও উন্মুক্ত অর্থনীতি গ্রহণ করে নিজের ভবিষ্যৎ নিজেই গড়ে নেবে। আশা করাই যায়, তাঁরা শেষোক্তটি বেছে নেবে। সব সত্ত্বেও শ্রীলঙ্কা তো আর চীন, ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের সমুদ্র দখলের প্রতিযোগিতার মধ্যে ‘দোদুল্যমান রাষ্ট্র’ নয়।

ইংরেজি থেকে অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন; স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
ব্রহ্ম চেলানি: নয়াদিল্লিভিত্তিক সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চের স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিেজর অধ্যাপক।