শ্রীলঙ্কার পুনর্জন্ম

২০০৯ সালে বিচ্ছিন্নতাবাদী তামিল বিদ্রোহীদের সঙ্গে যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর শ্রীলঙ্কার বেশ ভালো অগ্রগতি হয়েছে, সে জন্য তার প্রশংসা প্রাপ্য। তখন থেকে তার জিডিপি প্রতিবছর ৬ দশমিক ৭ শতাংশ হারে বেড়েছে, আর তার শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতের পরিসংখ্যানও বেশ চিত্তাকর্ষক।
সব উন্নয়নশীল দেশই নানা সমস্যার সম্মুখীন হয়, কিন্তু যে দেশটি ৩০ বছর ধরে মারাত্মক গৃহযুদ্ধের কারণে জেরবার হয়েছে, সে দেশটির জন্য এটা বিশেষভাবে সত্য। সরকারকে অগ্রাধিকার নির্ধারণ করতে হবে, কিন্তু সফলতার জন্য সমন্বিত মনোভঙ্গি দরকার।
সব যুদ্ধের পেছনেই কিছু কারণ থাকে, তেমনি তামিল টাইগারদের সঙ্গে শ্রীলঙ্কার সরকারের যে যুদ্ধ হয়েছে, তার পেছনেও কিছু বৈশিষ্ট্যসূচক কারণ রয়েছে: সামাজিক ও অর্থনৈতিক দুঃখ-দুর্দশা, বাস্তব বা অনুমিত বৈষম্য, আর সম্পদ ও আয়বৈষম্য আমলে নেওয়ার ক্ষেত্রে সরকারের ব্যর্থতা। ফলে শ্রীলঙ্কায় শুধু মধ্যবর্তী সময়ের জন্য ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করলেই চলবে না (আরেকটি উদাহরণ হচ্ছে কলাম্বিয়া, যেখানে ফার্ক গেরিলাদের সঙ্গে শান্তি চুক্তির সম্ভাবনা ক্রমেই বাড়ছে)। এখন প্রয়োজন হচ্ছে, তামিলদের শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক কার্যক্রমে পূর্ণাঙ্গভাবে আত্তীকরণ করা, দেশটির সংখ্যালঘু তামিলদের মনে নানারকম তিক্ততার সৃষ্টি হয়েছে।
বাজার নিজে থেকে এই সমস্যার সমাধান করতে পারে না। শ্রীলঙ্কার জন্য ভারসাম্যপূর্ণ ও ইতিবাচক কর্মোদ্যোগ দরকার, যার মধ্য দিয়ে অর্থনৈতিক অসমতার নানা মাত্রা ও তামিলদের সঙ্গে যে বৈষম্য করা হয়েছে, তা আমলে নেওয়া যাবে। আর সরকার যদি দরিদ্র ও নিম্নবর্ণের তামিলদের অন্ধকারে রেখে ধনী তামিলদের সুবিধা দেয়, তাহলে সেটা তেমন কাজে আসবে না।
দেশটির সরকার যদি উত্তরাঞ্চলের তামিল অঞ্চলকে মূল ধারায় যুক্ত করতে চায়, তাহলে তাকে অবকাঠামো, শিক্ষা, প্রযুক্তি ও অন্যান্য ক্ষেত্রে অনেক বিনিয়োগ করতে হবে। সম্ভবত, সারা দেশের জন্যই তেমন বিনিয়োগ দরকার। আর শ্রীলঙ্কার রাজস্ব-জিডিপির অনুপাত এখনো ১১ দশমিক ৬ শতাংশের মতো, যেটা ব্রাজিলের এক-তৃতীয়াংশের মতো।
অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের মতো শ্রীলঙ্কাও সাম্প্রতিক সময়ে পণ্যের উচ্চমূল্যের সুফল ভোগ করছে (দেশটির রপ্তানির ২২ শতাংশ আসে চা ও রাবার থেকে)। এই উচ্চমূল্যকে ব্যবহার করে শ্রীলঙ্কার উচিত হবে তার রপ্তানির পণ্যসম্ভারকে আরও সমৃদ্ধ করা, রাজাপক্ষের সরকার যে কাজটি করেনি। অন্যদিকে রপ্তানিমূল্য কমে যাওয়া এবং বৈশ্বিক মন্দার কারণে পর্যটনে মন্দা আসার আশঙ্কা থাকায় দেশটির ব্যালান্স অব পেমেন্টের ঘাটতি সৃষ্টি হলো বলে।
অনেকেই শ্রীলঙ্কাকে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) দ্বারস্থ হওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন, যেটা করলে তাকে ব্যয় কমাতে হবে। কিন্তু সেটা অত্যন্ত অজনপ্রিয় কাজ হবে। অনেক দেশই আইএমএফের ঋণ নিয়ে অর্থনৈতিক সার্বভৌমত্ব হারিয়েছে। এর পাশাপাশি, আইএমএফ শ্রীলঙ্কার সরকারকে নিশ্চিতভাবেই বলবে যে তারা খুবই কম কর সংগ্রহ করছে, তবে আইএমএফ এটা বলবে না যে তারা বেশি খরচ করছে।

>শ্রীলঙ্কা দেশটি সুন্দর, অবস্থানগত দিক থেকেও সে আদর্শ জায়গায় আছে, ভারত মহাসাগরে। পৃথিবীর এই অংশটা ভূরাজনৈতিক দিকে থেকে টালমাটাল অবস্থায় আছে, ফলে শ্রীলঙ্কা একটি আর্থিক কেন্দ্র ও বিনিয়োগের নিরাপদ আশ্রয়স্থল হতে পারে। কিন্তু বাজারের ওপর অতিরিক্ত নির্ভর করলে তা হবে না

সৌভাগ্যবশত, শ্রীলঙ্কার সরকার অনেক ধরনের করই আরোপ করতে পারে, যার মধ্য দিয়ে দক্ষতা, প্রবৃদ্ধি ও ইকু্যইটি বাড়ানো সম্ভব। শ্রীলঙ্কায় প্রচুর সূর্যালোক ও বায়ু আছে, ফলে কার্বন কর আরোপ করলে রাজস্ব আয় প্রভূত বাড়বে, সমন্বিত চাহিদা বাড়বে, আর দেশটিও সবুজ অর্থনীতির দিকে ধাবিত হবে। অনুক্রমিক হারে সম্পদ কর আরোপ করা হলে উৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগের পরিমাণ বাড়বে, ফলে একদিকে যেমন অসমতার রাশ টানা যাবে, অন্যদিকে রাজস্ব আয়ও ব্যাপক হারে বাড়বে। বিলাসদ্রব্যের ওপর কর আরোপ করা হলেও একই লক্ষ্য অর্জিত হবে, যেসব দ্রব্যের বেশির ভাগই বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়।
দেশটিতে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগের পরিমাণ কম—অনেকেই এই যুক্তি দিয়ে বলেন, করপোরেট কর কমানো উচিত। কিন্তু করে এ রকম ছাড় দেওয়া হলে তা দেশটির জন্য প্রয়োজনীয় দীর্ঘমেয়াদি প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ নিশ্চিত করতে পারবে না, এই পদক্ষেপ এ ক্ষেত্রে আপেক্ষিকভাবে অকার্যকর। ফলে কর কমানো হলে তা শ্রীলঙ্কার ইতিমধ্যে দুর্বল হয়ে যাওয়া কর ভিত্তিকে আরও দুর্বল করে দেবে।
একইভাবে, সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগের কথা যেমন প্রায়ই বলা হয়, সেটাও হয়তো তেমন একটা কার্যকর হবে না। এসব উদ্যোগে সরকারকেই সাধারণত ঝুঁকি বহন করতে হয়, আর লাভের গুড় খায় বেসরকারি খাত। সাধারণত, এর মাধ্যমে যে পুঁজি সংগৃহীত হয়, তার অপরচুনিটি কস্ট অনেক বেশি। বেসরকারি খাত তো দেউলিয়াত্বের বাহানায় যখন-তখন চুক্তি ভঙ্গ করতে পারে বা তার হুমকি দিতে পারে, কিন্তু সরকার তো সেটা করতে পারে না, বিশেষ করে আন্তর্জাতিক চুক্তির ক্ষেত্রে।
২১ শতকের উন্নয়নের জন্য ভিন্ন কৌশল নিতে হবে। শিক্ষণ হবে এই উন্নয়নের ভিত্তি, উৎপাদন ও রপ্তানি করতে এবং শেখাটা শিখতে হবে। একটা ধাপ পেরিয়ে আরেক ধাপে চলে যাওয়া যেতে পারে। শ্রীলঙ্কার বেলায় কিছু নিম্ন দক্ষতার উৎপাদন যেমন, গার্মেন্টস থেকে সীমিত আয় হতে পারে। শিক্ষার মানের বিবেচনায় শ্রীলঙ্কা সরাসরি প্রাযুক্তিকভাবে উন্নততর পর্যায়ে ও উচ্চ ফলনশীল জৈব চাষাবাদের দিকে যেতে পারে, একই সঙ্গে তারা উচ্চ মুনাফার পর্যটনের দিকেও ধাবিত হতে পারে।
কিন্তু তারা যদি এসব নীতি বাস্তবায়ন করতে যায়, তাহলে তাদের পুরো দ্বীপের জন্যই উন্নত পরিবেশ নীতি গ্রহণ করতে হবে। এর জন্য পরিপূর্ণ নগর পরিকল্পনা করতে হবে। আজ দেশটিতে নগরায়ণের মাত্রা কম বলে তাকে ভাগ্যবান বলা যায়, কিন্তু আগামী দুই দশকে তার চিত্র পাল্টে যেতে পারে। ফলে সে আদর্শ শহর নির্মাণের সুযোগ পাবে, যার ভিত্তি হবে পর্যাপ্ত গণ-সেবা, যেটা কার্বন নিঃসরণ ও জলবায়ু পরিবর্তনের মূল্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে।
শ্রীলঙ্কা দেশটি সুন্দর, অবস্থানগত দিক থেকেও সে আদর্শ জায়গায় আছে, ভারত মহাসাগরে। পৃথিবীর এই অংশটা ভূরাজনৈতিক দিকে থেকে টালমাটাল অবস্থায় আছে, ফলে শ্রীলঙ্কা একটি আর্থিক কেন্দ্র ও বিনিয়োগের নিরাপদ আশ্রয়স্থল হতে পারে। কিন্তু বাজারের ওপর অতিরিক্ত নির্ভর করলে তা হবে না, আবার জনকল্যাণমূলক কাজেও কম বিনিয়োগ করলে চলবে না। সৌভাগ্যবশত, দেশটিতে শান্তি প্রতিষ্ঠিত এবং প্রতিনিধিত্বমূলক সরকারব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়েছে, ফলে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে সে অন্যদের তুলনায় এগিয়ে আছে।
স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন
জোসেফ ই স্টিগলিৎস: নোবেলজয়ী মার্কিন অর্থনীতিবিদ।