সংবাদপত্রের নেপথ্য নায়কেরা এবং ফওজুল করিম

ফওজুল করিম
ফওজুল করিম

আজকাল দৈনিক সংবাদপত্রে ‘বার্তা সম্পাদক’ (নিউজ এডিটর) পদটি তেমন আলাদাভাবে চোখে পড়ে না। সংবাদপত্রের প্রধান চরিত্র এখন সম্পাদক নিজেই। নানা কারণে প্রায় প্রতিটি দৈনিক পত্রিকায় এখন সম্পাদক বা নির্বাহী সম্পাদকই পত্রিকার প্রতিদিনের সিদ্ধান্তগুলো নিয়ে থাকেন। অথচ পাকিস্তান আমলে তো বটেই, স্বাধীনতার পরেও প্রায় এক দশক সংবাদপত্রে বার্তা সম্পাদকের প্রবল দাপট ছিল।
সম্প্রতি বাংলাদেশের সংবাদপত্র জগতের একজন দক্ষ বার্তা সম্পাদক এই পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন। তিনি ফওজুল করিম। সংবাদপত্র জগতে ‘তারা ভাই’ নামে অধিক পরিচিত। দৈনিক বাংলা (অধুনালুপ্ত) পত্রিকার বার্তা সম্পাদক হিসেবে দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করেছেন। পরে নির্বাহী সম্পাদক হিসেবে অবসর গ্রহণ করেছেন। তারও আগে দৈনিক পাকিস্তান পত্রিকায় সিনিয়র সাব-এডিটর ও সংবাদ-এ সাব-এডিটর হিসেবে দীর্ঘদিন কাজ করেছেন। তিনি ছিলেন আপাদমস্তক সাংবাদিক।
সংবাদপত্রের সোনালি যুগ ছিল গত শতকের ষাটের দশক। সম্পাদকের তালিকা দেখুন: মওলানা আকরম খাঁ, মুজীবর রহমান খাঁ, তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া, আবুল কালাম শামসুদ্দীন, আবদুস সালাম, জহুর হোসেন চৌধুরী। জাঁদরেল বার্তা সম্পাদকের তালিকা সিরাজুদ্দীন হোসেন, এবিএম মূসা, তোয়াব খান, সন্তোষ গুপ্ত। সিনিয়র সাংবাদিক ছিলেন রণেশ দাশগুপ্ত, শহীদুল্লা কায়সার, আহমেদুর রহমান, আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী, কে জি মুস্তফা, হাসান হাফিজুর রহমান, নির্মল সেন, আহমেদ হুমায়ুন, বজলুর রহমান প্রমুখ। এরপর বার্তা সম্পাদক হিসেবে যাঁরা খ্যাতি অর্জন করেন—আসাফউদ্দৌলা রেজা, ফওজুল করিম, কামাল লোহানী। এটা কোনো গবেষণার তালিকা নয়। মোটামুটি এঁরাই সম্পাদক, বার্তা সম্পাদক বা সাংবাদিক হিসেবে ব্যাপক পরিচিতি ও খ্যাতি অর্জন করেছিলেন।
ষাটের দশকে (প্রকাশকাল: ১৯৬৪) দৈনিক পাকিস্তান (স্বাধীনতার পরে দৈনিক বাংলা) যে একটি ব্যতিক্রমধর্মী ও আধুনিক বাংলা দৈনিকে পরিণত হয়েছিল এবং ব্যাপক পাঠক আকর্ষণ করতে পেরেছিল, তার পেছনে একটি দক্ষ টিমই প্রধানত কাজ করেছিল। আবুল কালাম শামসুদ্দীন, তোয়াব খান, ফওজুল করিম, আহমেদ হুমায়ুন, নির্মল সেন, আলী আশরাফ, ফজলুল করিম, হেদায়েত হোসাইন মোরশেদ—এঁদের নেতৃত্ব ও অবদান অপরিসীম। আমি অবদানের চেয়ে নেতৃত্বকে অনেক বড় বলে মনে করি। ফওজুল করিমের নেতৃত্বে দৈনিক পাকিস্তান প্রকাশ করে ‘শেষের পাতা’। পত্রিকার শেষ পৃষ্ঠাজুড়ে শুধু ফিচার। অচিরেই ‘শেষের পাতা’ পাঠকমহলে সাড়া ফেলে দেয়। বাংলাদেশের সাংবাদিকতায় ‘শেষের পাতা’ একটি বড় সৃজনশীল অবদান। সংবাদপত্র যে পাঠক শেষ পৃষ্ঠা থেকে পড়া শুরু করতে পারে তা দৈনিক পাকিস্তান প্রমাণ করেছে। এমনই আকর্ষণ ছিল শেষের পাতার।
পত্রিকায় রিপোর্টের জন্য কী ধরনের এক্সক্লুসিভ বিষয় হতে পারে, সেই রিপোর্টে কী কী তথ্য থাকা উচিত, রিপোর্টের জন্য কার কার সঙ্গে দেখা করা উচিত, কোন বইয়ে বা জার্নালে আরও তথ্য থাকতে পারে ইত্যাদি ফওজুল করিম বাড়ি থেকে নিজউপ্রিন্ট কাগজে লিখে আনতেন রিপোর্টারের জন্য। শুধু লেখাই নয়, নানাভাবে িব্রফিং করতেন রিপোর্টারকে। শুধু রিপোর্ট নয়, ফিচারের জন্যও নানা বিষয় প্রস্তাব করতেন। রিপোর্ট বা ফিচারের আকর্ষণীয় হেডলাইন লেখার জন্য তাঁর জুড়ি ছিল না। ছবি এডিটিং ছিল তাঁর আরেকটি প্রিয় কাজ। পত্রিকার প্রথম পাতার মেকআপে তিনি ছবি নিয়ে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতেন। অবশ্য এ কাজে তাঁর পূর্বসূরি ও বন্ধু তোয়াব খানেরও দক্ষতা প্রশ্নাতীত। তোয়াব খান ও ফওজুল করিম যৌথভাবে দৈনিক পাকিস্তান–এর প্রথম ও শেষ পৃষ্ঠার মেকআপ নিয়ে কত চমকই না দেখিয়েছেন। বিশেষ করে দুটি বিশেষ সময়ের কথা মনে পড়ছে। ১. ১৯৭০-এর জলোচ্ছ্বাস, ডিসেম্বরের সাধারণ নির্বাচন। ২. ১৯৭১-এর মার্চের অগ্নিক্ষরা দিনগুলো। দৈনিক পাকিস্তান–এর এই সময়ের কপিগুলো বাংলা সাংবাদিকতা, সংবাদ আলোকচিত্র ও সংবাদপত্র মেকআপের জন্য এক মূল্যবান দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। এ প্রসঙ্গে গোলাম মাওলার তোলা সাড়া জাগানো সংবাদ আলোকচিত্রের কথা উল্লেখ না করলেই নয়।
ফওজুল করিম পত্রিকার মেকআপ নিয়ে কত ভাবনাচিন্তা করতেন তার একটা নমুনা দেওয়া যাক। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের কারাগার থেকে প্রথম স্বাধীন বাংলাদেশে এসেছেন। বিকেলে ভাষণ দিয়েছেন রেসকোর্স মাঠে (সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যান)। ঐতিহাসিক জনসভা বলতে যা বোঝায়, সেটা তা-ই। সেই জনসভার কভারেজ কেমন হওয়া উচিত তা নিয়ে তারা ভাই প্রথম পৃষ্ঠার তিন রকম মেকআপ করে সহকর্মীদের মতামত নেন। পত্রিকার মেকআপ নির্ভর করবে ফটোগ্রাফার কী ধরনের ছবি দেয় তার ওপর। বিভিন্ন অ্যাঙ্গেলের ছবি দিয়ে তিন রকম পাতা সাজান তিনি। জনসভা থেকে ফিরে রিপোর্টারের লেখা রিপোর্টের শিরোনাম লেখেন নির্মল সেন, ‘রেসকোর্সের বিশাল জনসমুদ্রে বঙ্গবন্ধুর দৃপ্ত ঘোষণা: স্বাধীন হয়েছি স্বাধীন থাকব’।
সংবাদপত্রে ফওজুল করিম তাঁর সৃজনশীলতার নানা মাত্রা ব্যবহার করেছেন। নির্বাহী সম্পাদক হওয়ার পর সপ্তাহ শেষে চার পৃষ্ঠার একটা ফিচার বিভাগ পরিকল্পনা ও সম্পাদনার দায়িত্ব নেন। নাম: ‘দৈনিক বাংলা সাময়িকী’। কত বিচিত্র প্রতিবেদন ও ফিচার যে তিনি রিপোর্টারদের দিয়ে লিখিয়েছেন তার ইয়ত্তা নেই। ঢাকার সংবাদপত্রে সে ধরনের বড় আকারের প্রতিবেদন, ফিচার বা সাক্ষাৎকার তখন তেমন দেখা যেত না।
ফওজুল করিম বড় মাপের সাংবাদিক ছিলেন। সংবাদপত্রের রিপোর্টার ছিলেন না বলে তাঁর নামের সঙ্গে পাঠকেরা তেমন পরিচিত ছিলেন না। সংবাদপত্রে অনেক নেপথ্য সাংবাদিক থাকেন, যাঁদের পাঠকেরা তেমন চেনেন না। তাঁরা বার্তা সম্পাদক, সাব-এডিটর, কপি-এডিটর, সম্পাদনা সহকারী ইত্যাদি। একটি সংবাদপত্রকে পাঠকনন্দিত করার পেছনে এঁদের অবদান কম নয়। ফওজুল করিম ছিলেন সংবাদপত্র নির্মাণকারী একজন নেপথ্য দক্ষ সাংবাদিক।
বিভিন্ন বিষয়ে ফওজুল করিমের উৎসাহ ছিল। নানা বিষয়ে পড়াশোনা করতেন। প্রত্নতত্ত্ব ও প্রাচীন ঢাকা তাঁর একটি বিশেষ আগ্রহের জায়গা। এসব নিয়ে বড় বড় পণ্ডিতের বই পড়েছেন। ইতিহাসবিদদের সঙ্গে আলোচনা করতেন। অনুবাদেও আগ্রহ ছিল। তাঁর অনূদিত একাধিক বই বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত হয়েছে। ফটো এডিটিং বিষয়ে তাঁর লেখা বই (প্রকাশক: প্রেস ইনস্টিটিউট) একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রকাশনা। চলচ্চিত্র, বিশেষ করে বিশ্ব চলচ্চিত্র সম্পর্কেও তাঁর বিশেষ আগ্রহ ছিল। একসময় (১৯৬০-৬৪) তিনি মাসিক সাহিত্য পত্রিকা পূর্বাণীর (সম্পাদক মোহাম্মদ মাহফুজউল্লাহ) সিনেমা বিভাগ (রঙ্গরূপ) পরিচালনা করতেন। এ প্রসঙ্গে সম্পাদক তাঁর স্মৃতিকথায় (২০০৫) লিখেছেন, ‘ফওজুল করিম সাহেবের দক্ষ পরিচালনায় ও তাঁর সমৃদ্ধ রচনায় যে পূর্বাণীর “রঙ্গরূপ” বিভাগটি বিশেষ আকর্ষণীয় ও ঐশ্বর্যমণ্ডিত হয়েছিল, আজও তা পাঠকমহল স্বীকার করে। আমার ব্যক্তিগত ধারণা, এমন সমৃদ্ধ সিনেমা বিভাগ আজও সম্ভবত কোনো মাসিক সাহিত্য পত্রিকায় প্রকাশিত হয়নি। সিনেমা যে একটি আর্ট তথা শিল্প এবং সিনেমাবিষয়ক রচনায়ও যে থাকতে পারে সাহিত্য ও শিল্পগুণ, এই সত্যটা মনে রেখেই ফওজুল করিম চলচ্চিত্রবিষয়ক প্রবন্ধ, আলোচনা ও সমালোচনা লিখতেন।’
আমাদের সাংবাদিকতা জগতে অনেক কৃতী পুরুষ এসেছেন। তাঁদের অবদান আমরা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি। তাঁদের অনেকের নামের সঙ্গে পাঠকসমাজ পরিচিত। সংবাদপত্রে বিশেষ রিপোর্ট বা কলাম না লিখলে পাঠকেরা সাংবাদিকদের চেনেন না। ইদানীং টিভির টক শোর কল্যাণে অনেক সাংবাদিক বিশেষ পরিচিতি ও খ্যাতি লাভ করেছেন। কিন্তু সংবাদপত্রে এমন অনেক সাংবাদিক নেপথ্যে কাজ করেন, যাঁদের প্রতিভা ও অবদানের ওপর ভিত্তি করে একটি সংবাদপত্র বিকশিত হয়। পাঠকনন্দিত হয়। অথচ এই নেপথ্য সাংবাদিকেরা তেমন স্বীকৃতিও পান না। ফওজুল করিম ছিলেন সে রকম একজন নেপথ্য দক্ষ সাংবাদিক; যাঁর মেধায় ও সৃজনশীলতায় দৈনিক বাংলা পত্রিকা সত্তরের দশকে বাংলাদেশে একটি আধুনিক ও অনন্য বাংলা দৈনিক হিসেবে বিকশিত হয়েছিল।
তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করি। সেই সঙ্গে স্মরণ করি প্রতিটি দৈনিক পত্রিকায় নেপথ্যচারী সাংবাদিকদের অবদানের কথা, যাঁদের হাত দিয়ে প্রতিদিন অসংখ্য খবর ছাপা হয়। মৃত্যুর পর একটা সিঙ্গেল কলাম সংবাদের মধ্য দিয়ে সাংবাদিকতা ও সংবাদপত্রের সঙ্গে তাঁদের দীর্ঘদিনের সম্পর্কের ইতি ঘটে। শুধু পরিবার ও সহকর্মীদের মধ্যেই বেঁচে থাকে তাঁদের স্মৃতি।
মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর: দৈনিক বাংলার সাবেক সাংবাদিক।