সংবাদমাধ্যম কতটা ‘গণমাধ্যম’ হতে পেরেছে?

ঢাকা ও ঢাকার বাইরের নিবন্ধিত মোট ৩ হাজার ২০১টি পত্রিকা, পূর্ণ সম্প্রচারে থাকা ৩১টি টিভি ও ২২টি এফএম রেডিও, নিবন্ধনের আবেদন করা ২ হাজার ৯২০টি অনলাইন পোর্টাল মিলে বাংলাদেশের বেসরকারি সংবাদমাধ্যমের সংখ্যাগত পরিসরটাকে বেশ বড়ই বলা চলে। এর বাইরে আছে বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বেতারের বেশ কিছু চ্যানেল। সংখ্যায় ব্যাপক হলেও সংবাদমাধ্যমের ঠিক কতটি গুণগত মান বিবেচনায় ‘গণমাধ্যম’ হিসেবে উত্তীর্ণ হতে পেরেছে—সেটা বাংলাদেশের সমাজ, শিক্ষাঙ্গন ও রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার বিষয় হতে পারে।

চরিত্রের দিক থেকে বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমকে চার ভাগে ভাগ করা যায়। এগুলো হলো—রাজনৈতিক মতাদর্শ ও এলিট সেটেলমেন্টভিত্তিক সংবাদমাধ্যম, বড় বড় শিল্পগোষ্ঠীর ব্যবসায়িক স্বার্থ সংরক্ষণ ও বিকাশের প্রধানতম উদ্দেশ্য নিয়ে প্রতিষ্ঠিত সংবাদমাধ্যম, ধর্মীয় মতাদর্শভিত্তিক সংবাদমাধ্যম এবং আঞ্চলিক সংবাদমাধ্যম। বাংলাদেশের পত্রিকাগুলোর মৌলিক আয় তিন ধরনের—ক. সরকারি বিজ্ঞাপন, খ. বেসরকারি বিজ্ঞাপন গ. পত্রিকা বিক্রির অর্থ। দেখা যায়, ৩০ টাকা উৎপাদন খরচের পত্রিকাটি মাত্র ১০ টাকায় বিক্রি করতে হয়। ঘাটতির ২০ টাকা সরকারি সার্কুলার ও বেসরকারি বিজ্ঞাপন থেকে মেটাতে হয়। এখানেই স্বার্থের দ্বন্দ্বের শুরু, যার সমাধান স্বাধীনতা-উত্তর ৫০ বছরে করা যায়নি।

পত্রিকা চালু রাখার কিংবা লাভের জন্য সরকারের লেজুড়বৃত্তির সীমাহীন চর্চা হয়। বড় বড় শিল্পগোষ্ঠীর পত্রিকাগুলো নিজস্ব পণ্যের বিজ্ঞাপন প্রচার থেকে মঞ্জুরি পায় এবং করপোরেট সুসম্পর্ক কাজে লাগিয়ে বিজ্ঞাপন আনে। আঞ্চলিক ও ধর্মীয় পত্রিকাগুলো মূলত অনুদাননির্ভর, দাতাদের রাজনৈতিক ও ধর্মীয় মতাদর্শে এসব পরিচালিত হয়।

সরকারি সার্কুলেশনের ভাগ পেতে বহু অলিখিত নিয়ম মেনে চলতে হয় বাংলাদেশের টেলিভিশন ও ছাপা পত্রিকাকে। সরকারের নির্বাচনহীন ক্ষমতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে জবাবদিহিহীনতা এবং কর্তৃত্বপরায়ণতা বেড়েছে বলে গণমাধ্যমের ওপর আরোপিত অলিখিত বিধিনিষেধের তালিকাও দীর্ঘ হয়েছে। এসব চর্চা দীর্ঘ সময় ধরে চর্চিত হতে হতে এখন প্রতিষ্ঠিত সেলফ সেন্সরশিপে রূপান্তরিত হয়েছে। গণমাধ্যমের ওপর তিন ধরনের রাজনৈতিক এজেন্ডা এখানে আরোপিত। ১. বিরোধী রাজনীতি, বিরোধী দল ও বিরোধী নেতৃত্বকে নিয়মিত ডি-লেজিটিমেইট, ডি-মোরাল এবং ব্লেইম করা। ২. বর্তমান সরকারের ‘বিকল্প নেই’ এমন একটা ধরনা প্রতিষ্ঠা করা। নির্বাচনহীন ক্ষমতায়নকে প্রশ্ন না করা, বন্ধ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে সচল করার যেকোনো চেষ্টা থেকে বিরত থাকা। ৩. সরকারের অপছন্দের বিষয়ে, সরকারকে বিব্রত করতে পারে এমন জাতীয় কিংবা স্থানীয় ঘটনায় একেবারে চুপ থাকা বা মিডিয়া ব্ল্যাকআউট করা এবং সরকারের ভাবমূর্তি রক্ষার প্রয়োজনে ভিকটিম ব্লেমিং করা। এ তিন এজেন্ডা এখন বলা চলে মিডিয়া সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে, তথাপি বিভিন্ন সংবাদে ফোন আসে, আপত্তি আসে। এ সংস্কৃতিতে খাপ খাওয়াতে না পারা গণমাধ্যম হয় বন্ধ হয়েছে নতুবা তাদের নিবন্ধন বেহাত হয়েছে। এভাবে রাজনৈতিক অধিকারসহ নাগরিকের তথ্যপ্রাপ্তির মৌলিক অধিকারের চর্চাকে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত করা হয়েছে।

সময়ের সঙ্গে সরকারের নির্বাচনহীন ক্ষমতায়নের প্রশাসনিক ভিত পোক্ত হয়েছে বলে এবং সেলফ সেন্সরশিপের সংস্কৃতিতে মিডিয়াকর্মীরা অভ্যস্ত হয়ে পড়েছেন বিধায় সরকারের বিধিনিষেধের চাইতেও বর্তমানে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে রাজনৈতিক মতাদর্শিক বাস্তবায়ন। শাহবাগ-শাপলার বিভাজিত মেরুকরণের রাজনীতির পর গণমাধ্যমও ডান ও বামের বিভাজিত দুই মেরুতে বিভক্ত হয়ে পড়েছে, এতে সমাজে উদার ও মধ্যপন্থী চিন্তার বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়েছে। উদার ও মধ্যপন্থী গণমাধ্যমেরও প্রায় বিলোপ ঘটেছে এ সময়ে।

মোটকথা, মিডিয়ার ব্যবসায়িকভাবে টিকিয়ে রাখার কৌশলের অংশ হচ্ছে বাক্‌স্বাধীনতা, গণতান্ত্রিক অধিকার ও নাগরিক তথ্য অধিকার হরণকারী কলা কানুন মেনে চলার আবশ্যকতা। এখানে সরকারি দলের নেতা, এমপি-মন্ত্রী, প্রশাসনের বড় কর্মকর্তা কিংবা সচিবদের অপব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতি নিয়ে, প্রকল্প বাস্তবায়ন দক্ষতা ও যোগ্যতা নিয়ে, রাষ্ট্রীয় খরচের মডেল নিয়ে মিডিয়ায় আলোচনা করা যায় না, প্রশ্ন তোলা যায় না। ফলে চুরি, লুণ্ঠন, জালিয়াতি, ঘুষ, তদবির, চাঁদাবাজিকেন্দ্রিক দুর্বৃত্ত প্রশাসনিক ব্যবস্থায় ‘রাজনৈতিক অর্থনীতি’র মৌলিক দায়বদ্ধতার বিষয় অনুপস্থিত। কাউকে পদ থেকে সরিয়ে দিলেই পরে তার বিরুদ্ধে কিছু দুর্নীতির অভিযোগ তোলা যায়, তা-ও সরকারের নির্দেশিত কিংবা সহ্যের সীমার মধ্যে থেকে। ফলে সংবাদমাধ্যম ‘গণমানুষ’কে প্রতিনিধিত্ব করতে পারে না বরং প্রশাসনসহ ক্ষমতাসীন সরকার ও সরকারি দলের সার্বিক রাজনৈতিক স্বার্থকে প্রতিনিধিত্ব করে।

সময়ের সঙ্গে সরকারের নির্বাচনহীন ক্ষমতায়নের প্রশাসনিক ভিত পোক্ত হয়েছে বলে এবং সেলফ সেন্সরশিপের সংস্কৃতিতে মিডিয়াকর্মীরা অভ্যস্ত হয়ে পড়েছেন বিধায় সরকারের বিধিনিষেধের চাইতেও বর্তমানে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে রাজনৈতিক মতাদর্শিক বাস্তবায়ন। শাহবাগ-শাপলার বিভাজিত মেরুকরণের রাজনীতির পর গণমাধ্যমও ডান ও বামের বিভাজিত দুই মেরুতে বিভক্ত হয়ে পড়েছে, এতে সমাজে উদার ও মধ্যপন্থী চিন্তার বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়েছে। উদার ও মধ্যপন্থী গণমাধ্যমেরও প্রায় বিলোপ ঘটেছে এ সময়ে। ফলে পত্রিকার সম্পাদকমণ্ডলীকে মেরুকরণ করা রাজনৈতিক মতাদর্শের বৃত্তেই আবদ্ধ থাকতে হচ্ছে। বিশেষ মতাদর্শের অভিজাত বুদ্ধিবৃত্তিক এলিট সেটেলমেন্টই পত্রিকার সম্পাদকীয় নীতিকে বেশি প্রভাবিত করছে। এই যেন ‘শূন্য এবং এক’-এর বাইনারি খেলা। হয় তুমি বন্ধু, না হয় শত্রু, মধ্যপন্থী কোনো মূল্যবোধের চর্চা নেই! অর্থাৎ সংবাদমাধ্যমের সম্পাদকীয় নীতিও আর ‘গণমানুষের’ মধ্যপন্থী উদার ধারাকে প্রতিনিধিত্ব করে না বরং তার অভিজাত পক্ষের মতাদর্শকেই বরং বেশি প্রতিনিধিত্ব করে।

বাংলাদেশের গণমাধ্যম ‘বিপ্লবের’ রাজনীতি করে না সত্য। তবে সে শব্দ ও ভাষার রাজনীতির চর্চা করে। সংবাদপত্রগুলো ভাষার রাজনীতির মাধ্যমে তাঁর পাঠক-শ্রোতাদের রাজনীতিকে গাইড করতে চায়। কোনটা ‘তাণ্ডব’, কোনটা ‘হামলা’, কিংবা কোনটা ‘সংঘাত’ এটা ঘটনা নির্ধারণ করে দেয় না, বরং সংবাদমাধ্যমের ‘নরম’ রাজনীতি তা নির্ধারণ করে দেয়। এখানে রাজনৈতিক দুর্বৃত্তদের দ্বারা ঘটিত ঘটনাও ভাষার রাজনীতিতে পড়ে। পছন্দের দলের ক্ষেত্রে বলা হয় ‘অভিযোগ’। আর বিরোধীদের ক্ষেত্রে দেখানো হয় অকাট্য সব প্রমাণ। একই প্রকারের কোনো ঘটনা হয় ‘হামলা ও তাণ্ডব’, কোনটা হয় ‘দুই পক্ষের সাধারণ সংঘাত’। ঘটনা বর্ণনার ভাষা এখানে ঘটনা নিরপেক্ষ নয়, বরং মতাদর্শই ভাষা ও শব্দ নির্মাণ করে।

বিশ্বব্যাপী শক্তিশালী কিন্তু সাম্রাজ্যবাদে পক্ষপাতদুষ্ট সংবাদমাধ্যমগুলো ক্ষমতাধরদের হয়ে বিশ্ব সমাজের এজেন্ডা নির্ধারণ করে। বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমের ভিন্ন দেশের গোয়েন্দা সংস্থার কিংবা ভিন্ন দেশের পত্রিকার চোখে বিশ্ব দেখতে যেন খুব পছন্দ করে, তার নিজের বুদ্ধিবৃত্তিক কোনো চোখ নেই। ফলে কোনটা ‘জঙ্গিবাদ’, কোনটা ‘স্বাধীনতাসংগ্রাম’, কোনটা ‘সন্ত্রাসবাদ’ আর কোনটা ‘মানসিক বিকারগ্রস্তের অপরাধ’—এসব আঞ্চলিক ইতিহাস, সমাজ ও সংস্কৃতির মূল্যবোধ কিংবা দেশের পররাষ্ট্রনীতির মূলনীতি দিয়ে নির্ধারিত হয় না। এমনকি বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক চুক্তি, আঞ্চলিক অর্থনীতি এবং জলবায়ু পরিবর্তনের মতো বিষয়েও বাংলাদেশের ক্ষতি ও প্রতিকারের দিকগুলো আমাদের মিডিয়া অন্যের চোখে দেখে। ভাষার ভিন্ন ভিন্ন রাজনীতির মাধ্যমে ভিন্ন দেশের গোয়েন্দা সংস্থার কিংবা ভিন্ন দেশের পত্রিকার চোখে বিশ্ব দেখিয়ে আমাদের মিডিয়া যেন ক্ষমতাহীন ‘গণমানুষে’র রাজনীতির ভাষাকেই ঠিক করে দিতে চায়। বলা চলে প্রায় প্রতিটি সংবাদমাধ্যমের রাজনৈতিক পক্ষপাত তার ভাষার রাজনীতিতে প্রতিফলিত। প্রশ্ন উঠে, গণমানুষের আকাঙ্ক্ষাকে ধারণ না করা সংবাদমাধ্যম কি গণমাধ্যম বলে বিবেচিত হতে পারে?

বাংলাদেশের মিডিয়া জগতে নেই একচেটিয়া প্রতিহত করার রেগুলেশন, যা মুক্তবাজার অর্থনীতির প্রাণভোমরা। এখানে মতাদর্শ কিংবা সরকার কিংবা ব্যবসায়িক গোষ্ঠীর স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য খবর চাপা দেওয়া হয়, তবে ভিকটিম ব্লেইমিং সংস্কৃতি জারি রাখতে খবর না ছাপিয়েও তার প্রতিক্রিয়া ছাপানোর হীনমন্য চর্চাটা চলে।

বাস্তবে ব্যক্তি, গোষ্ঠী, কিংবা সরকারের স্বার্থ সংরক্ষণের দায়িত্ব সংবাদমাধ্যমের নয়। সংবাদমাধ্যমের দায়িত্ব রাষ্ট্রের ও রাষ্ট্রের নাগরিকের সাধারণ স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য কাজ করে যাওয়া। আজকে একই ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর সাত-সাতটি মিডিয়া হাউসের লাইসেন্সও জমেছে, ফলে বৈধ-অবৈধ ব্যবসায়িক সম্প্রসারণে কোনো বাধা নেই। তার অবৈধ ব্যবসায়িক সম্প্রসারণকে, মালিকপক্ষের অপরাধ, ব্যবসায়িক ও রাজনৈতিক সন্ত্রাসকে সংবাদে আনার সাধ্য কারও নেই। সে অবৈধ ক্ষমতার হাত ধরে ‘উইন-উইন’ স্বার্থ রক্ষা করে চলে। বাংলাদেশের মিডিয়া জগতে নেই একচেটিয়া প্রতিহত করার রেগুলেশন, যা মুক্তবাজার অর্থনীতির প্রাণভোমরা। এখানে মতাদর্শ কিংবা সরকার কিংবা ব্যবসায়িক গোষ্ঠীর স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য খবর চাপা দেওয়া হয়, তবে ভিকটিম ব্লেইমিং সংস্কৃতি জারি রাখতে খবর না ছাপিয়েও তার প্রতিক্রিয়া ছাপানোর হীনমন্য চর্চাটা চলে।

বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমের একটা বড় গুণ হচ্ছে অভিজাত বয়ান তৈরির সক্ষমতা। ‘সাংবিধানিক ধারাবাহিকতার নির্বাচন’, ‘জামায়াত-শিবির সংযোগ’, ‘বিকল্প কে?’, ‘কম গণতন্ত্র বেশি উন্নয়ন’, ‘ফুটন্ত কড়াই থেকে জ্বলন্ত উনুন’, ‘মধ্যবিত্ত দেশ’ কিংবা ‘মেগা প্রকল্প ও মাথাপিছু আয়ের উন্নয়ননির্ভর বয়ান’—আমাদের গণমাধ্যম পছন্দ করে। আমাদের গণমাধ্যম এসব বয়ান তৈরির পেছনের গল্প ও তথ্যগুলোকে প্রশ্ন করে না। ধনবৈষম্য, বিচারহীনতা ও গণতন্ত্রহীনতাকে প্রশ্ন করে না। আমাদের গণমাধ্যম ভারত, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কিংবা ইউরোপের গণতন্ত্র নিয়ে বেশ চিন্তিত থাকে, কিন্তু বাংলাদেশের গণতন্ত্রহীনতা, রাতের ভোট, একদলীয় নির্বাচন, বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ী হওয়ার ঘটনায় আমাদের গণমাধ্যম বেশ নির্ভার। আমাদের গণমাধ্যম ব্যাংক লুট, পাচার, প্রকল্প ব্যয়ে সীমাহীন দুর্নীতি, সময়ক্ষেপণ, উন্নয়ন প্রকল্পের বাজে মান, শিক্ষার নিম্নমান, স্বাস্থ্য খাতের দুরবস্থা, স্বাস্থ্য-দারিদ্র্য, পুষ্টি-দারিদ্র্য, দারিদ্র্য ফাঁদের সঙ্গে রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নকে, প্রাতিষ্ঠানিক অপশাসনের সংযোগকে প্রশ্ন করতে পারে না। সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে একদলীয় ব্যবস্থা তৈরির সময়ে সে চুপ থাকে, পরে সেই সংবিধানের দোহাই দিয়ে সে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া বন্ধের পক্ষে সম্মতি উৎপাদন করে। ফলে জনস্বার্থ ও জনকল্যাণের জন্য তার নিবেদন প্রশ্নযুক্ত। একটা বড় ঘটনা ঘটে গেলে তথ্য প্রকাশে হীনমন্য সব সিদ্ধান্তের ভেতর হাঁটতে হয়। ছাপা পত্রিকা ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় শোভা পায় নাগরিক স্বার্থকে নিয়ে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা বাহাস। রাজনৈতিক কূটতর্ক দিয়ে নাগরিক কষ্ট, মানুষের অধিকার এবং নাগরিক দাবি ভুলিয়ে রাখাই যেন গণমাধ্যমের এজেন্ডা।

রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক বৈরিতায় তথ্যপ্রাপ্তির স্বাভাবিক প্রক্রিয়া বাংলাদেশে তৈরি হয়নি। ফলে সাংবাদিকতা বাংলাদেশের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ পেশা। নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতি ও প্রশাসনিক শাসন নেই বলে সত্যকে মোকাবিলার সাহস নেই ক্ষমতা কেন্দ্রের। জবাবদিহির সংস্কৃতি তৈরি হয়নি বলে ব্যবসায়ী সমাজ ও সরকার উভয়েই সাংবাদিককে শত্রুজ্ঞান করে।

সমাজে রাজনৈতিক মেরুকরণ বেড়েছে বলে, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার অধঃপতন হয়েছে বলে, আন্তধর্মীয় সহনশীলতা কমেছে এবং বেকারত্ব বেড়েছে বলে অপরাধ বেড়েছে। এতে কাজের ধরন ও ক্ষেত্র বেড়েছে। পাল্লা দিয়ে বেড়েছে কালো হাত, কালো পথ ও কালো বাঁক। ফলে একদিকে মালিকপক্ষের অপচর্চাগুলো আরও উৎসাহ পাচ্ছে, অন্যদিকে ঝুঁকিপূর্ণ পেশা হিসেবে ব্যক্তি সাংবাদিকতা আরও বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হচ্ছে। আমরা অবাক হয়ে দেখি, সরকারকে যথেষ্ট সেবা করার পরও ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনের খড়্গে বেশি পড়ছেন খোদ সাংবাদিকরাই। কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা বিধানের সুস্পষ্ট কোনো চর্চা নেই। বরং সাগর-রুনীসহ খুন হওয়ায় সাংবাদিকদের মামলাগুলোকে রাজনৈতিকভাবে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। সাংবাদিকদের পেশাজীবী সংস্থাগুলো যেন দলীয় লেজুড়বৃত্তির আখড়া। ৫০ বছর বয়সী দেশের মিডিয়া মালিকদের স্বৈরচারিতা এবং গণমাধ্যমকর্মীদের এমন অনৈক্য দেশের সার্বিক সুশাসনের পথেও বড় বাধা।

আজকে সংবাদমাধ্যম নিজেই রূপান্তরের চ্যালেঞ্জে পড়েছে। বিকল্প গণমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম তৈরি হয়েছে বলে চ্যালেঞ্জে পড়েছে ধ্রুপদি গণমাধ্যমের সংবাদ ভাষ্য, গুণগত মান, আলোচনার বিষয়বস্তু এবং আয়ের খাত সবখানে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে, মিথ্যা খবরের ছড়াছড়ি। দ্রুততম সময়ে ডিজিটাল মাধ্যমের তথ্য যাচাই এবং নিউজ অথেনটিকেশন বড় চ্যালেঞ্জ। একদিকে বেড়েছে খরচের খাত, অন্যদিকে বেড়েছে ডিজিটাল নিরাপত্তার ঝুঁকি। এর সঙ্গে কর্তৃত্ববাদী সরকারের আচরণ, সরকারি উৎস থেকে প্রাথমিক তথ্যপ্রাপ্তির অনিশ্চয়তা সাংবাদিকতাকে কঠিন সব চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি করে দিয়েছে। ফলে টিকে থাকার স্বার্থেই স্বৈরাচারী সরকার ও ফ্যাসিবাদের পক্ষে সম্মতি উৎপাদন কেন্দ্র না হয়ে বরং আজকের সংবাদমাধ্যমের ‘গণমাধ্যম’ হয়ে ওঠার দায় বরং বেড়েছে। গণমানুষের বয়ানকে, তাদের দাবিকে, তাদের ভাষ্যকে, তাদের প্রতিবাদ ও প্রয়োজনকে আগলে রেখে পথ চললেই কেবল সত্যকে সত্য বলতে পারার কঠিন চ্যালেঞ্জ উতরানো সম্ভব।

ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব টেকসই উন্নয়নবিষয়ক লেখক। ‘চতুর্থ শিল্পবিপ্লব ও বাংলাদেশ’, ‘বাংলাদেশ অর্থনীতির ৫০ বছর’ গ্রন্থের রচয়িতা। [email protected]