সচিব বনাম সাংসদ, এমন দ্বন্দ্ব কেন হয়

বছর দুয়েক আগে এক প্রবাসী বাংলাদেশি প্রথম আলো অফিসে এসেছিলেন দুঃখের কথা বলতে। কোনো এক সূত্রে আমার ফোন নম্বর জোগাড় করেছিলেন তিনি। বয়স সত্তরের কাছাকাছি। যুক্তরাষ্ট্রে থাকেন, চিকিৎসা পেশায় ছিলেন, অবসর নিয়েছেন। অর্থকড়ি ভালোই জমিয়েছেন। এই বয়সে এসে তাঁর মনে হয়েছে নিজের গ্রামে কিছু করা দরকার। তিনি যেহেতু চিকিৎসক, তাই চেয়েছিলেন গ্রামের মানুষকে চিকিৎসাসেবা দেওয়া যায় এমন কিছু করবেন। শেষ পর্যন্ত তিনি তা পারেননি। ব্যর্থ হয়ে ফিরে যাওয়ার আগে তাঁর কাহিনি শুনিয়ে গিয়েছিলেন।

কাহিনিটি এ রকম: তিনি যখন গ্রামে গেছেন এবং কিছু করার পরিকল্পনা শুরু করেছেন, তখনই গ্রামের কিছু মানুষের মধ্যে নানা সন্দেহ দানা বাঁধতে শুরু হয়। প্রথমে গ্রামের মানুষ, তারপর ইউনিয়নের মানুষের মনে কিছু লোক এ প্রশ্ন ঢুকিয়ে দিয়েছে যে তিনি গ্রামে এসে কিছু করতে চান কেন? সহজ ভাষায় বললে এর পেছনের ‘ধান্দাটি’ কী?

দুর্মুখেরা প্রায়ই বলেন, সরকার, সরকারি দল ও প্রশাসন—সব নাকি এখন মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। এরপরও সরকারি দলের একজন সংসদ সদস্যের সঙ্গে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের একজন কর্মকর্তার এই বিরোধ–সংঘাত কেন? বোঝা যায়, নিজের ক্ষমতা ও প্রভাব ধরে রাখা, রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ আর স্বার্থের দ্বন্দ্ব যখন সামনে চলে আসে, তখন বাকি সব অর্থহীন হয় পড়ে

তিনি বোঝানোর চেষ্টা করেছেন, গ্রামবাসীর সেবা করা ছাড়া তাঁর আর কোনো উদ্দেশ্য নেই। তিনি এখানে স্থায়ীভাবে থাকতেও আসেননি, দেখাশোনা করতে হয়তো বছর বছর আসবেন। কিন্তু তাঁর মানবসেবার ‘প্রকৃত’ উদ্দেশ্য নিয়ে যাঁদের মনে সন্দেহ জেগেছে, তাঁরা কেউ এসব কথায় আস্থা রাখতে পারেননি। এলাকার ইউনিয়ন পর্যায়ের জনপ্রতিনিধি, এমনকি তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী বা ভবিষ্যতে ইউপি চেয়ারম্যান হতে চান—এমন সবাই মিলেমিশে তাঁর উদ্যোগের বিরোধিতা শুরু করেন। এ বিরোধিতা শুধু ইউনিয়ন পর্যায়েই নয়, উপজেলা, এমনকি সংসদীয় এলাকা পর্যন্ত ছড়িয়ে গেছে। কারণ, এই সবগুলো পর্যায়ের জনপ্রতিনিধি বা জনপ্রতিনিধি হতে আগ্রহীরা এই প্রবাসীকে তাঁদের জন্য হুমকি মনে করছেন। কারণ, তাঁরা কেউই নিশ্চিত হতে পারেননি যে এই প্রবাসীর ‘আসল ধান্দাটি’ কি ইউপি চেয়ারম্যান হওয়া, উপজেলা চেয়ারম্যান হওয়া, নাকি সাংসদ হওয়া!

দেশের জন্য কিছু করার স্বপ্ন মাটিচাপা দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে যাওয়া ছাড়া এই বেচারা প্রবাসীর আর কোনো পথ ছিল না। একজন বিধ্বস্ত আর পরাজিত মানুষের চেহারা কেমন হতে পারে, তাঁর সঙ্গে সাক্ষাতে সেদিন তা টের পেয়েছিলাম। বড় মন খারাপ করা ছিল সেই সাক্ষাৎপর্ব।

এবার বর্তমানে ফিরে আসি। সাধু আর শয়তানে নয়, বিরোধ লেগেছে স্বাস্থ্যসচিব ও এক সাংসদের মধ্যে। দুজনেরই বাড়ি কিশোরগঞ্জের কটিয়াদী উপজেলার চানপুর গ্রামে। স্বাস্থ্যসচিব আবদুল মান্নান সেখানে নিজের জমিতে একটি স্যাটেলাইট ক্লিনিক বানানোর উদ্যোগ নিয়েছেন। এ নিয়ে স্থানীয় সাংসদ নূর মোহাম্মদের লোকজনের সঙ্গে উত্তেজনা তৈরি হয়। হামলা হয় স্বাস্থ্যসচিবের বাড়িতে। হামলাকারীরা উপজেলা সহকারী কমিশনারকে (ভূমি) পুকুরে ফেলে দেওয়ার মতো ঘটনাও ঘটিয়েছেন।

এখন বুঝতে পারছি সেই প্রবাসী কত বড় বাঁচাই না বেঁচে গেছেন। অন্তত তাঁর বাড়িঘরে হামলা হয়নি। তাঁর পক্ষের কাউকে তুলে নিয়ে পুকুরে ফেলা হয়নি। সে সময়ে যাঁরা তাঁর বিরোধিতা করেছেন, তাঁদের বাস্তব-বুদ্ধি যে খুবই শাণানো, তাতে সন্দেহ নেই। স্থানীয় রাজনীতিতে ঢোকার পথ তো এমনই, এলাকায় গিয়ে কিছু ‘সমাজসেবামূলক’ কাজ শুরু করা। এই প্রবাসী ব্যতিক্রম ছিলেন কি না, তা বিচার-বিবেচনা করার সময় কই। আর ঠ্যাকাটাই বা কী! কল্পিত বা সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বীকে শুরুতে তাড়া করাই তো বুদ্ধিমানের কাজ। প্রবাসীর সমাজসেবার উদ্যোগকে তাই তাঁরা দানা বাঁধতেই দেননি।

কিশোরগঞ্জ–২ আসনের (কটিয়াদী–পাকুন্দিয়া) সাংসদ নূর মোহাম্মদের লোকজনও সেই কাজটিই করেছেন। স্বাস্থ্যসচিব তাঁর গ্রামে ক্লিনিক বানাতে যাবেন আর স্থানীয় সাংসদ তা চেয়ে চেয়ে দেখবেন, তা তো হয় না। সাংসদের লোকজন তাঁকে তাড়া করবেন, এটাই স্বাভাবিক। স্বাস্থ্যসচিবের যে কোনো রাজনৈতিক ‘উচ্চাভিলাষ’ নেই, তা কে নিশ্চিত করবেন? বর্তমান সাংসদ ঝুঁকি নিতে যাবেন কেন? যত দিন তিনি আছেন তো আছেন, এরপর সুযোগ আসবে ভাই-ভাতিজা বা ভাগনেদের। এই ময়দানে স্বাস্থ্যসচিবকে তাঁরা ঢুকতে দেবেন কেন? স্থানীয় রাজনীতির এই লড়াইয়ের মাঠে সাংসদের লোকজন তাই ‘প্রিঅ্যামটিভ অ্যাটাক’ বা আগাম আঘাত হেনেছেন। সাংসদ বা তাঁর লোকজন যে বিশেষ সুবিধা পান, সেটা তাঁরা ভালো করেই জানেন। তাই হামলার ঘটনা বা সরকারি কর্মকর্তাকে পুকুরে ফেলে দেওয়ার পরও মামলা হয়নি। এ জন্য কবে স্পিকারের কাছ থেকে সেই অনুমতি মিলবে, কে জানে!

তবে এই লড়াই একতরফা হবে বলে মনে হয় না। কারণ, স্বাস্থ্যসচিব তো আর সেই প্রবাসীর মতো নিরীহ কেউ নন। তাঁকে হেলাফেলা করা ঠিক হবে না। তিনিও ক্ষমতাকেন্দ্রের কাছাকাছি থাকা লোক। ক্লিনিক তিনি নিজের জমিতেই বানিয়েছেন, কিন্তু সেখানে যাওয়ার জন্য রাস্তা বানাতে গিয়ে সরকারি ও বেসরকারি সব জমিই কাজে লাগিয়েছেন। ক্ষমতা ও প্রভাবকে কাজে লাগাতে তিনিও কম যান না। সাংসদের লোকেরা স্বাস্থ্যসচিবের বিরুদ্ধে এ অভিযোগকেই কাজে লাগাচ্ছেন। স্থানীয় আওয়ামী লীগ এরই মধ্যে ‘ভূমিদস্যু’ স্বাস্থ্যসচিবের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সমাবেশও করেছে।

দুর্মুখেরা প্রায়ই বলেন, সরকার, সরকারি দল ও প্রশাসন—সব নাকি এখন মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। এরপরও সরকারি দলের একজন সাংসদের সঙ্গে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের একজন কর্মকর্তার এই বিরোধ–সংঘাত কেন? বোঝা যায়, নিজের ক্ষমতা ও প্রভাব ধরে রাখা, রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ আর স্বার্থের দ্বন্দ্ব যখন সামনে চলে আসে, তখন বাকি সব অর্থহীন হয়ে পড়ে।

স্বাস্থ্যসচিবের যদি সত্যিই কোনো রাজনৈতিক খায়েশ থাকে, তবে সাংসদের সঙ্গে এই লড়াইয়ে তাঁকে দমের পরীক্ষা দিতে হবে। তিনি যদি রণেভঙ্গ না দেন, তবে আমরা সাধারণ জনগণ, যাঁরা দর্শকের ভূমিকায় আছি, তাঁদের জন্য হয়তো আরও রঙ্গ অপেক্ষা করছে। এসব দেখা, মুখ টিপে হাসাহাসি করা আর আকারে-ইঙ্গিতে কথা বলাই তো এখন আমাদের বিনোদন।

এ কে এম জাকারিয়া প্রথম আলোর উপসম্পাদক

[email protected]