সন্ত্রাসীরা জাতি-ধর্ম দেখে না

রবার্ট ফিস্ক
রবার্ট ফিস্ক

আপনি যদি কাতালান বা স্প্যানিয়ার্ড না হন, তাহলে বার্সেলোনা হামলার পেছনে যে বড় রাজনৈতিক বিভাজন আছে তা হয়তো খেয়াল করতে পারবেন না। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম একরকম ইচ্ছাকৃতভাবেই খবরের এই সমস্যাপূর্ণ দিকটি এড়িয়ে গেছে। আর আমাদের যেন ইসলামি সন্ত্রাসীদের কর্মকাণ্ডে ভীত-বিহ্বল হয়ে দুঃখিত হওয়ার আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। এক মুহূর্তও কেউ চিন্তা করেনি, এই বর্বর ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে কিছু মানুষ ভিন্ন প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে।

প্রথম প্রতিবেদনে বার্সেলোনা ও স্প্যানিশ জনগণের মধ্যকার ঐক্যে জোর দেওয়া হয়েছে, এর মধ্যে এক যোগসূত্র পাওয়া যায়, যার মধ্যে একরকম অপরাধবোধও আছে। এক প্রতিবেদনে স্রেফ বলা হয়েছিল, আগামী ১ অক্টোবর কাতালানের স্বাধীনতা নিয়ে যে গণভোট হতে যাচ্ছে, মাদ্রিদ সরকার তা অবৈধ মনে করে।

প্রতিবেদনটি একেবারেই সাদামাটা ছিল, সেটা হলো সন্ত্রাস, খুন, বেদনা প্রভৃতিকে আঞ্চলিক স্বাধীনতা ও কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণ থেকে স্বাধীনতাজাতীয় ধারণা দিয়ে আড়াল করা যাবে না।

প্রত্যক্ষদর্শী ব্যক্তিরা ঘটনার পর মানসিক আঘাত বা পীড়নের ব্যাপারে তেমন কিছু বলতে পারছিলেন না বলে ব্রিটিশ এক টেলিভিশন প্রতিবেদক যেভাবে তাঁদের আটকে দিচ্ছিলেন, তাতে আমি বিস্মিত হয়েছি। এসব হামলা যে স্বাভাবিক হয়ে যাচ্ছে—এই স্পষ্ট ব্যাপারটা তিনি বুঝতে পারছিলেন না। সাংবাদিকেরা এই স্বাভাবিক শব্দটা ঘৃণা করেন। আর এই স্বাভাবিক শব্দটার একটা পরিপ্রেক্ষিত আছে, যেটা ঠিক আমলে নেওয়া হয়নি।

আসুন, এবার সেই পরিপ্রেক্ষিতটা বোঝার চেষ্টা করি। স্প্যানিশ প্রধানমন্ত্রী মারিয়ানো রাজয় ঘণ্টাখানেক পর ঘটনাস্থলে হাজির হয়ে শোক জানান। আর বক্তৃতায় তিনি একবারও কাতালানের নাম মুখে আনেননি। তিনি শুধু ‘স্প্যানিশ জাতির বেদনা নিয়ে কথা বলেছেন’। বক্তৃতার অলংকারবহুল শেষাংশে কাতালান প্রেসিডেন্ট কার্লোস পিগডেমন্ট কাতালোনিয়াকে দেশ হিসেবে উল্লেখ করেছেন, যা আদতে দেশ নয়।

ওদিকে কাতালানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বার্সেলোনা হামলার স্প্যানিশ ও কাতালান ভুক্তভোগীদের মধ্যে বিভাজন করেছেন। সংবাদ সম্মেলনে তিনি কাতালান ভাষায় কথা বলেছেন, স্প্যানিশে নয়।

ধারণা হিসেবে এটি বেশ আনন্দের যে কাতালানের স্বাধীনতার ভোটের আগে আইএস না জেনেই স্প্যানিশ ঐক্য গড়তে সহায়ক হতে পারে। কিন্তু হামলার পর স্প্যানিশ ইতিহাসের এই বিপর্যয়কর অধ্যায় কোনো ভূমিকা পালন করেনি—এই ধারণা হাস্যকর।

জনাকয়েক সাংবাদিক যে কেন বার্সেলোনায় সাধারণ মানুষের ওপর হামলার ঘটনাকে স্প্যানিশ রাজনীতির পরিপ্রেক্ষিতে স্থাপন করতে চাচ্ছেন, তা আমার কাছে বিস্ময়ের। প্যাডি উডওয়ার্থ নামের এক সাংবাদিক প্রশ্ন তুলেছেন, ‘হামলাকারীরা কি ব্যাপারটা অনুধাবন করতে পেরেছে?’ তিনি প্রতিবেদনে বলেন, পিগডেমন্টহামলার কয়েক ঘণ্টা পর জোর দিয়ে বললেন, এই হামলা কাতালান স্বাধীনতার গতি রুদ্ধ করতে পারবে না। উডওয়ার্থের ভাষ্যে, এটা ‘রীতিমতো অশালীন’।

আর হামলার প্রতিক্রিয়ায় অনেকে ১৫ ও ১৬ শতকে স্পেনে মুসলমানদের কতল করার ইতিহাসের প্রসঙ্গ তির্যকভাবে টেনেছেন। আমি কখনোই মনে করি না, আইএস এই ঐতিহাসিক মহাকাব্যিক অপরাধের প্রতিশোধ নিতে নিরপরাধ ইউরোপীয়দের ওপর গাড়ি তুলে দিচ্ছে। এটা দিয়ে এই বর্বরতা জায়েজ করা তো দূরের কথা।

কিছুদিন আগে ক্ষুদ্র একদল হতভাগ্য আর্মেনীয় ১৯১৫ সালে তুর্কিদের হাতে খ্রিষ্টান আর্মেনীয়দের গণহত্যার প্রতিশোধ নিতে তুর্কি রাষ্ট্রদূতকে হত্যা করেছে। কিন্তু অন্যরা এই তরিকায় প্রতিশোধ নেয় না।

হত্যাযজ্ঞ থেকে বেঁচে যাওয়া ইহুদিদের বংশধররা আধুনিক জার্মানদের সঙ্গে সহিংসতা করে না। স্পেনে মুসলমানসহ ইহুদিরা যে জাতিগত নিধনের শিকার হয়েছিল, সে জন্য তারা প্রতিশোধের কথা ভাবে না। পর্তুগাল ও স্পেন তো নিজেদের দেশে থেকে সব মুসলমান ও ইহুদি নাগরিককে বের করে দিয়েছিল। এর ক্ষতিপূরণ হিসেবে পর্তুগাল তাদের দেশ থেকে বিতাড়িত ইহুদি পরিবারের বংশধরদের পূর্ণাঙ্গ নাগরিকত্ব ও পাসপোর্ট দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।

অনেকেই বলেন, আন্দালুসিয়ার খ্রিষ্টানরা মুসলিম বিদ্রোহ দমনে বাধ্য হয়েছিল। আর মুসলমানরা ‘যুদ্ধের সময়’ বিতাড়িত হয়েছিল। লোকের কল্পনায় জাতিগত কারণে বিতাড়ন এবং যুদ্ধের সময় বিতাড়নের মধ্যে পার্থক্য আছে, ফিলিস্তিনি আরবদের বেলায়ও এ কথা প্রযোজ্য। আর স্পেন ও পর্তুগালের উল্লিখিত সিদ্ধান্তের কারণ হলো, তারা চায়নি মুসলমানরা তাদের দেশে এসে বসবাস করুক।

এখন বার্সেলানা হামলার পর অনেকেই হয়তো বলবেন, তারা কত না ঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে, বার্সেলোনার মুসলিম হামলাকারীরা মরক্কোর বংশোদ্ভূত। আর ১৫ শতকে মুসলমানরা স্পেন থেকে বিতাড়িত হয়ে আলজেরিয়া ও মরক্কোয় আশ্রয় নিয়েছিল। আর ফ্রান্সে আলজেরীয়রা নিরীহ মানুষকে কতল করছে। প্যারিস হামলার প্রতিবেদন করার সময় আমরা ভুলে যাই, আলজেরিয়া ফ্রান্সের উপনিবেশ ছিল।

নিরীহ মানুষকে হত্যা করা কোনোভাবেই জায়েজ করা যায় না। এ ছাড়া বার্সেলোনার গণহত্যাকারীরা এটা ভাবেনি, তারা কাকে হত্যা করছে। তবে এ ধরনের মারাত্মক আবেগী সময় আমাদের আরেকটু সতর্কতার সঙ্গে ভাবতে হবে, সাংবাদিকেরা ‘ব্যাকগ্রাউন্ড’ বা প্রতিবেদনকে পরিপ্রেক্ষিতে স্থাপন করা বলতে কী বোঝাতে চান।

স্প্যানিশ ও কাতালানরা এসব জানে। তারা নিজ দেশের মধ্যযুগের ইতিহাস জানে। গত সপ্তাহে তারা নিজ দেশের হীন রাজনীতিক নেতাদের স্পেন ও কাতালানবিরোধী অবজ্ঞাপূর্ণ মন্তব্য চিহ্নিত করতে পেরেছে। তাহলে আমাদেরও কেন একই গল্প শোনানো হবে না?

ব্রিটিশ দৈনিক দ্য ইনডিপেনডেন্ট থেকে নেওয়া, অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন

রবার্ট ফিস্ক: দ্য ইনডিপেনডেন্ট-এর মধ্যপ্রাচ্য প্রতিনিধি