‘সফল’ অর্থনীতি ও পরিবর্তিত সমাজ

একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ ৫০ বছর পূরণ করতে যাচ্ছে। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী এমন একটি মাইলফলক, যখন এই দীর্ঘ যাত্রার একটি মূল্যায়ন প্রয়োজন। একটি রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ এখন কোথায় এসে দাঁড়িয়েছে, তার মূল্যায়ন করেছেন দুই গবেষক। চার পর্বের ধারাবাহিকের শেষ পর্ব ছাপা হলো আজ।

স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর মাহেন্দ্রক্ষণে বাংলাদেশের সাফল্যের কথা বলতে গিয়ে যে কথা বারবার বলা হচ্ছে এবং হবে, তা হচ্ছে বাংলাদেশের অর্থনীতির সাফল্য—মোট জাতীয় উৎপাদন বা জিডিপির প্রবৃদ্ধি। কয়েক বছর ধরেই আমরা এই কথা শুনতে পাচ্ছি এই কারণেও যে ক্ষমতাসীনেরা এটা দেখাতে আগ্রহী, তাঁদের অব্যাহত শাসনামলে সুশাসনের ঘাটতি থাকলেও এবং গণতন্ত্রের ক্ষেত্রে ব্যত্যয় ঘটলেও ‘উন্নয়ন’ হয়েছে। উন্নয়ন আর প্রবৃদ্ধি সমার্থক হয়ে গেছে। এটা অনস্বীকার্য যে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে গত কয়েক দশকে উল্লেখযোগ্য প্রবৃদ্ধি লক্ষ করা গেছে।

এই বৃদ্ধির পেছনে অর্থনৈতিক কাঠামো পরিবর্তন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। স্বাধীনতার আগে এবং স্বাধীনতা পাওয়ার পরের এক দশক বাংলাদেশের অর্থনীতি মূলত কৃষির ওপর নির্ভরশীল ছিল। বর্তমানে কৃষি নয়, বরং শিল্প ও সেবা খাতই দেশের অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি। দেশের বাইরে থেকে পাঠানো রেমিট্যান্স এবং তৈরি পোশাক রপ্তানি বাংলাদেশের অর্থনীতিতে প্রধানত অবদান রাখছে।

বাংলাদেশ এখন পৃথিবীর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক। এ ছাড়া তৈরি পোশাকশিল্প খাতে এখন বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি মানুষ চাকরি করেন। মোট ৪০ লাখ কর্মীর মধ্যে ৩২ লাখই নারী। ১৯৭৯ সালে তৈরি পোশাকশিল্প থেকে আয় ছিল মাত্র ৪০ হাজার মার্কিন ডলার আর ২০১৯ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৪ দশমিক ১৩ বিলিয়ন ডলারে। তবে এই সাফল্যের পেছনে কত শ্রমিকের ত্যাগ, স্বল্প বেতন আর অনিরাপদ পরিবেশে কাজ অবদান রেখেছে, তা ভুলে গেলে চলবে না। কয়েকটি প্রাণঘাতী দুর্ঘটনা, বিশেষ করে রানা প্লাজা ধসে ১ হাজার ২০০ শ্রমিকের মৃত্যু এবং ২ হাজার ৫০০ মানুষ আহত হওয়ার পর পৃথিবীর নামীদামি পোশাক ব্র্যান্ডগুলো কাজের পরিবেশ তদারকির জন্য দুটি উদ্যোগ নেয়।

তৈরি পোশাক খাতের পাশাপাশি বিদেশে, বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যে কর্মরত শ্রমিকদের পাঠানো রেমিট্যান্স বাংলাদেশের অর্থনীতিতে অবদান রেখেছে। ১৯৭৬ সালে এ খাত থেকে বাংলাদেশে আসত ২৩ দশমিক ৭১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা ২০১৯-এ বেড়ে দাঁড়ায় ১৬ দশমিক ৩৭ বিলিয়ন ডলারে। বর্তমানে বাংলাদেশ রেমিট্যান্স গ্রহীতা দেশ হিসেবে পৃথিবীতে নবম স্থানে রয়েছে। কিন্তু লক্ষণীয় এই যে এই দুই খাতের যে শ্রমিকগোষ্ঠী এই সাফল্যের নির্মাতা, তাঁদের ব্যাপারে রাষ্ট্র একধরনের নির্লিপ্ততাই অনুসরণ করেছে, তাঁদের নিরাপত্তা এবং অধিকার নিয়ে রাষ্ট্র কিছুই করেনি। একই কথা বলা চলে কৃষি খাত বিষয়েও। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা সত্ত্বেও ১৯৭৪ সালের পর বাংলাদেশ দুর্ভিক্ষে পতিত হয়নি; এই কৃতিত্ব একাদিক্রমে কৃষকের এবং নীতিনির্ধারকদের।

সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ১৯৯১ সালে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সূচনা থেকে বাংলাদেশের জিডিপি প্রতিবছর শতকরা ৫ থেকে ৬ ভাগ হারে বাড়ছে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে এই বৃদ্ধি ছিল শতকরা ৭.৮ এবং ২০১৯-২০-এ ৭.৩। এই হার বিবেচনায় বাংলাদেশ পৃথিবীর পঞ্চম দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতি। কিন্তু বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান জিডিপি বৃদ্ধির এই সরকারি পরিসংখ্যান সম্পর্কে সন্দিহান, কেননা খাতওয়ারি হিসাবের ফলের সঙ্গে সরকারের এই দাবি মেলে না।

গত কয়েক দশকে বাংলাদেশ মানবসম্পদ উন্নয়ন সূচকে, বিশেষ করে দারিদ্র্য দূরীকরণ, নিম্ন শিশু ও মাতৃমৃত্যুর হার, স্যানিটেশন ও নারীশিক্ষায় উল্লেখযোগ্য উন্নতি করেছে। এই উন্নয়নের ধারা অব্যাহত থাকার পেছনে কেবল যে রাষ্ট্রের ভূমিকা আছে তা নয়, বিভিন্ন সরকারের নীতিগত ধারাবাহিকতা, উন্নয়নবিষয়ক এনজিও, ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান এবং বাংলাদেশের মানুষের উদ্ভাবনী শক্তি কাজ করেছে। এদের সমন্বিত সাফল্যের প্রমাণ হচ্ছে এসব সূচকের অগ্রগতি। কিন্তু গত এক বছরে করোনাভাইরাস মহামারি এই সবকিছুকেই চ্যালেঞ্জের মুখে ঠেলে দিয়েছে। দারিদ্র্য বেড়েছে, সমাজের এক বড় অংশের মানুষ জীবন এবং জীবিকা নিয়ে এখন আরও বেশি বিপদের মুখে পড়েছেন।

বাংলাদেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক সাফল্য অনেক অর্থনীতিবিদ ও উন্নয়নকর্মীকে অবাক করেছে। নিম্নমানের শাসনব্যবস্থা, জনসংখ্যার উচ্চ ঘনত্ব, প্রাকৃতিক সম্পদের অভাব, প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর অভাব, ঘন ঘন প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা সত্ত্বেও বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নতিকে অনেকে ‘বাংলাদেশ প্যারাডক্স’ হিসেবে অভিহিত করেন। বিশেষ করে বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ তাদের উন্নয়নের পোস্টার চাইল্ড হিসেবে বাংলাদেশের উদাহরণ নিয়ে আসে। কিন্তু এই আপাত-উন্নয়নের পেছনে যে অর্থনৈতিক বৈষম্য ও ধনিকশ্রেণির অস্বাভাবিক উত্থান রয়েছে, তা বেশির ভাগ সময় আলোচনায় আসে না।

যখন অর্থনীতিতে প্রবৃদ্ধির হার বেড়েছে, সেই একই সময়ে দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর আয় এবং তাদের হাতে সম্পদের হ্রাস ঘটেছে। দেশের ৪৬ শতাংশ শিশু বহুমাত্রিক দারিদ্র্যের শিকার। জাতিসংঘের সাম্প্রতিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশের প্রতি ছয়জনে একজন অপুষ্টির শিকার। অন্যদিকে ২০১৯-এ প্রকাশিত নিউইয়র্ককেন্দ্রিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ওয়েলথ এক্সএর একটি রিপোর্ট পৃথিবীর ১০টি দ্রুত বর্ধনশীল ধনীদের দেশের তালিকা প্রকাশ করে, যেখানে বাংলাদেশ ছিল তৃতীয়। এমন এক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা তৈরি করা হয়েছে, যাতে রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে যুক্তদের পক্ষে রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুট করা এক স্বাভাবিক ঘটনায় রূপান্তরিত হয়েছে।

যখন অর্থনীতিতে প্রবৃদ্ধির হার বেড়েছে, সেই একই সময়ে দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর আয় এবং তাদের হাতে সম্পদের হ্রাস ঘটেছে। দেশের ৪৬ শতাংশ শিশু বহুমাত্রিক দারিদ্র্যের শিকার। জাতিসংঘের সাম্প্রতিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশের প্রতি ছয়জনে একজন অপুষ্টির শিকার।

জিডিপির হিসাবে বাংলাদেশের অর্থনীতির যে প্রবৃদ্ধি, অর্থনীতির সেই সাফল্য সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে সমাজের এক ছোট অংশের হাতে। এই প্রবৃদ্ধি লাখো দরিদ্র মানুষের দরিদ্রতর হওয়াকে ঠেকাতে পারেনি। তার প্রভাব পড়েছে সমাজে, সামাজিক মূল্যবোধে, সামাজিক সংহতি বা কোহেশনে। ভোগবাদিতা ও ব্যক্তিকেন্দ্রিকতার উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে সমাজের পুরোনো বন্ধনগুলো ছিন্ন হওয়ার পথে, বিশেষ করে সমাজে সহনশীলতা ও সহমর্মিতার অভাব লক্ষণীয়।

বিশ্বায়নের কারণে এই ধারা আরও বেশি গতি পেয়েছে। প্রযুক্তির নতুন নতুন আবিষ্কার, বিশেষ করে ইন্টারনেটের ব্যবহার, বৈশ্বিকভাবে জনপ্রিয় সংস্কৃতি, খাদ্যাভ্যাস ও জীবনাচরণকে বাংলাদেশের মানুষের কাছে সহজে পৌঁছে দিয়েছে। সস্তা স্মার্টফোন আর ইন্টারনেট যোগাযোগের কারণে সমাজের একটা অংশ তথ্যপ্রবাহের সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারছে। ২০২০ সালের ডিসেম্বরে বিটিআরসি থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে মোট ইন্টারনেট গ্রাহকের সংখ্যা ছিল প্রায় ১১ কোটি। জানুয়ারি ২০২০-এ প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, মোট মুঠোফোন সংযোগের সংখ্যা ছিল ১৬ কোটির বেশি এবং সামাজিক মাধ্যম ব্যবহারকারীর সংখ্যা ছিল ৩ কোটি ৬০ লাখ। এসব তথ্য সামনে রেখে সরকার দাবি করে যে তারা ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ গড়ে তুলেছে; কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের চেয়ে কম গতির ইন্টারনেট কেবল আফগানিস্তানে; ইথিওপিয়া ও সোমালিয়ার চেয়েও বাংলাদেশে ইন্টারনেটে গতি কম।

বৈশ্বিক ও স্থানীয় সংস্কৃতি ও মূল্যবোধের মিশ্রণ এককেন্দ্রিক নয়। পশ্চিমা সংস্কৃতির প্রভাবের সঙ্গে সঙ্গে নতুন প্রযুক্তি ধর্মীয় সংস্কৃতিরও বিস্তার ঘটাচ্ছে, এমন প্রমাণও পাওয়া যায়। পরিবর্তনের অনিবার্যতা সত্ত্বেও এটাও ঠিক যে বাংলাদেশের সমাজের পরিবর্তনের ক্ষেত্রে একদিকে আছে দরিদ্র এবং ধনের বৈষম্য, আছে গ্রাম এবং নগরের পার্থক্য, তদুপরি তৈরি হচ্ছে ডিজিটাল ডিভাইড।

গত ৫০ বছরে নানা ধরনের পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে গেছে বাংলাদেশ। প্রাকৃতিক সম্পদের অপ্রতুলতা, অবকাঠামোর অভাব ও জনসংখ্যার ঘনত্ব বেশি হওয়ার পরও বাংলাদেশের জনগণের টিকে থাকার সক্ষমতা দেশটিকে সাফল্য এনে দিয়েছে। যে দেশটি একসময় আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ছিল প্রায় অচেনা, সেই দেশটি এখন জাতিসংঘের শান্তিরক্ষায় সবচেয়ে বেশি অবদান রাখছে। ক্ষুদ্রঋণের ওপর নির্ভর করে তৈরি হওয়া গ্রামীণ ব্যাংকের উন্নয়ন মডেল, যা বাংলাদেশের জন্য বয়ে এনেছে প্রথম নোবেল পুরস্কার, এখন দেশে-বিদেশে লাখো মানুষের জীবন পরিবর্তনে ভূমিকা রাখছে।

এ ছাড়া বাংলাদেশেই রয়েছে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বেসরকারি উন্নয়ন সংগঠন ব্র্যাক। অর্থনীতি ও মানবসম্পদের অভূতপূর্ব উন্নয়নের এই ধারা গণতন্ত্রের অবনতি, মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং রাজনৈতিক অধিকার হরণের মাধ্যমে কলুষিত হচ্ছে। গণতন্ত্রকে সুসংগঠিত করা ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করার বদলে সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ গণতন্ত্রের মৌলিক ভিত্তিগুলোকে লঙ্ঘিত করে অগ্রযাত্রার বদলে পেছনের দিকে হাঁটছে।

৫০ বছর পূর্তিতে প্রশ্ন উঠছে, বাংলাদেশের উন্নয়ন কি সামনের দিনে টেকসই হবে, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো শক্তিশালী হয়ে নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করবে, নাকি বাংলাদেশ একটি পূর্ণ কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রে পরিণত হবে? কেবল প্রবৃদ্ধির হিসাব নয়, বৈষম্যের অবসান ঘটিয়ে এক ধরনের অংশগ্রহণমূলক অর্থনীতি তৈরি হবে কি না। বাংলাদেশের ভূরাজনৈতিক অবস্থানের সঠিক ব্যবহার দেশটিকে ভবিষ্যতে একটি গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রে পরিণত করতে পারে, কিন্তু তা নির্ভর করবে গণতান্ত্রিক স্থিতিশীল রাজনীতি প্রতিষ্ঠা ও সঠিক পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণের ওপর; বাংলাদেশের আগামীর পথরেখা কি সেই দিকে?

আলী রীয়াজ যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর ও আমেরিকান ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজের প্রেসিডেন্ট

সাইমুম পারভেজ নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক। তিনি সম্প্রতি ইউনিভার্সিটি অব সিডনি থেকে ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেছেন