সবার আগে দর্শক-শ্রোতাদের কথা ভাবুন

তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনুর সর্বশেষ বক্তব্যের ওপর আমরা আস্থা রাখতে চাই। তিনি বলেছেন, ‘এই নীতিমালা আইন নয়, নির্দেশনা মাত্র। এই নীতিমালা বাস্তবায়নে কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। এর কোনো আইনি ভিত্তিও নেই। কাজেই এই সম্প্রচার নীতি নিয়ে কারও শঙ্কিত হওয়ার কারণ নেই।’
আশা করা যায়, তথ্যমন্ত্রীর এই ব্যাখ্যার পর গণমাধ্যমকর্মীদের আশঙ্কা কমে আসবে। মন্ত্রী নীতিমালার কয়েকটি ধারার ব্যাখ্যা দিয়েছেন তাঁর সংবাদ সম্মেলনে। যেমন সামরিক বাহিনী, পুলিশ ও র্যাবের কোনো সদস্য অন্যায় করলে তা নিয়ে অবশ্যই টিভিতে রিপোর্ট বা আলোচনা হতে পারে। মন্ত্রীর এই কথাটি নীতিমালায় থাকলে ভালো হতো। মন্ত্রী আরও বলেছেন, ‘কোনো বন্ধুদেশ যদি আমাদের প্রতি অবিচার করে, আমাদের স্বার্থহানিকর কাজ করে, তাহলে অবশ্যই রিপোর্ট বা আলোচনা হতে পারে।’ মন্ত্রীর এই ব্যাখ্যাটিও নীতিমালায় থাকলে ভালো হতো। দুটি বিষয়ই খুব গুরুত্বপূর্ণ। অথচ এমন দুটি গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য নীতিমালায় রাখা হয়নি। পরে তথ্যমন্ত্রীকে ব্যাখ্যা দিয়ে বলতে হয়েছে।
তথ্যমন্ত্রী অবশ্য আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্যের ব্যাখ্যা দেননি। নীতিমালায় বলা হয়েছে, ‘আলোচনা অনুষ্ঠানে কোনো ধরনের বিভ্রান্তিকর ও অসত্য তথ্য বা উপাত্ত দেওয়া পরিহার করতে হবে।’ অসত্য তথ্য তো অসত্যই। তা অবশ্যই পরিহার করতে হবে। কিন্তু ‘বিভ্রান্তিকর তথ্য’ কোনটিকে বলা যাবে, সেটা কার কাছে বিভ্রান্তিকর মনে হবে, এটা কে ঠিক করবে, কেউ ঠিক করে দিলে আলোচকই বা তাঁর সঙ্গে একমত হবেন, তার নিশ্চয়তা কী ইত্যাদি অনেক প্রশ্ন তোলা যায়। আসলে ‘বিভ্রান্তিকর তথ্য’ শব্দটিই বিভ্রান্তি সৃষ্টি করছে। বিভ্রান্তিকর শব্দটি নীতিমালা থেকে বাদ দিতে পারলে ভালো হয়। পুরো নীতিমালা পর্যালোচনা করলে এ রকম বহু বাক্য বা শব্দ বাদ দিতে হতে পারে। এই কলামে সেই সুযোগ নেই। তবে তথ্যমন্ত্রী আমাদের আশ্বস্ত করেছেন, ‘এই নীতিমালা গুরুত্বপূর্ণ নয়। গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে আইন।’ তিনি বলেছেন, ‘এই নীতিমালা নিয়ে যাঁর যা বক্তব্য বা বিশ্লেষণ, তা খসড়া আইনে যুক্ত করার সুযোগ রয়েছে।’ খুব ভালো কথা। কিন্তু আমাদের আশঙ্কা, এই ত্রুটিপূর্ণ নীতিমালা সম্প্রচার আইনপ্রণেতাদের প্রভাবিত করতে পারে। আইনের প্রথম খসড়া যতটা মিডিয়াবান্ধব করা যায়, তত ভালো।
তথ্যমন্ত্রী বলেছেন, ‘খসড়া আইনে সবাই তাঁদের ইনপুট দিতে পারবেন।’ আমাদের বক্তব্য, নীতিমালা ও আইন দুটি পৃথক ভাষ্য। আইনের ভঙ্গি ও ভাষাও ভিন্ন। আইন রচনায় ভিন্ন ধরনের বিশেষজ্ঞতার প্রয়োজন নয়। সব অংশীজন তা হয়তো পারবেন না। এই পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের প্রস্তাব: সম্প্রচার আইনের একটা খসড়া দ্রুত প্রকাশ করা হোক। তারপর অংশীজন, আগ্রহী দর্শক-শ্রোতা নিজেদের মতামত দিতে পারবেন। আশা করি, তথ্য মন্ত্রণালয় আইন ও গণমাধ্যম বিশেষজ্ঞদের নিয়ে খসড়া আইন প্রণয়ন করবেন। বর্তমান নীতিমালার যে কয়েকটি ধারা নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হয়েছে, সেগুলোর সঙ্গে তথ্যমন্ত্রীর ব্যাখ্যাও সংযোজন করে আইন প্রণয়ন কমিটির কাছে দিলে তাঁদের কাজ সহজ হবে। এই নীতিমালা প্রণয়নের সঙ্গে যাঁরা জড়িত ছিলেন, তাঁরা এখন নীতিমালার যেসব ধারা নিয়ে বেশি সমালোচনা হয়েছে, তার যৌক্তিকতা দেখে ধারাগুলো পর্যালোচনা করতে পারেন। এভাবে একটি সংশোধিত ও সম্পাদিত ‘নীতিমালা’ আইন প্রণয়ন কমিটির কাছে দিলে তাদের কাজটা সহজ হবে।
সাংবাদিক মিজানুর রহমান খান ১৩ আগস্ট প্রথম আলোতে লিখেছেন, ‘আলাদা সম্প্রচার কমিশন গঠন না করে বর্তমান প্রেস কাউন্সিলকে ঢেলে সাজিয়ে “মিডিয়া কাউন্সিল” গঠন করা যেতে পারে।’ অনেক বছর আগে আমিও অনুরূপ প্রস্তাব দিয়েছিলাম। প্রেস কাউন্সিলের দুটি বিভাগ থাকবে। প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া। প্রয়োজনে দুটি পৃথক বোর্ডও থাকতে পারে।
তবে বর্তমান প্রেস কাউন্সিল তেমন কার্যকর প্রতিষ্ঠান নয়। এর আইন ও বিধিমালাও ত্রুটিপূর্ণ। সংবাদপত্র দোষ করলে তাকে সতর্ক করে দেওয়া বা সাংবাদিককে মৃদু ভর্ৎসনা করা ছাড়া প্রেস কাউন্সিল কিছু করতে পারে না। দোষী সাংবাদিক, প্রযোজক বা আলোচককে অন্তত অর্থদণ্ড দেওয়ার ক্ষমতা থাকা উচিত। গুরুতর অপরাধের জন্য পত্রিকার ডিক্লারেশন বা টিভির লাইসেন্স সাময়িক স্থগিত করার ক্ষমতা থাকা উচিত। তবে এর চেয়ারম্যান বা সদস্য (বোর্ড) কারা হবেন, কীভাবে হবেন, তা খুব গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। সম্প্রচার কমিশনের চেয়ারম্যান ও সদস্যদের নাম প্রস্তাব করার জন্য নীতিমালায় একটি সার্চ কমিটি গঠনের কথা বলা হয়েছে। সরকারই সার্চ কমিটি গঠন করবে। আমাদের ভয় হয়, সরকার এমন একটি সার্চ কমিটি গঠন করতে পারে, যারা সরকারের বশংবদ।
সম্প্রচার কমিশনের সদস্যসংখ্যা, তাঁদের গুণাবলি বা পেশা বা বিশেষজ্ঞতা ইত্যাদি সুচিন্তিতভাবে আইনে থাকতে হবে। টিভি চ্যানেলের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যুক্ত কাউকে এর সদস্য রাখা যাবে না। এটা ওয়েজ বোর্ড নয়। এটা টিভি অনুষ্ঠান ও অন্যান্য বিষয় সম্পর্কে একধরনের বিচারিক ফোরাম। যাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আসবে, তাঁদের প্রতিনিধিকে শুনানিতে ডাকা হবে। এভাবেই কাজ হয়। সম্প্রচার কমিশন গঠনপদ্ধতি ও ব্যক্তি নির্বাচন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশে সবার আস্থাভাজন ব্যক্তি নির্বাচন করা প্রায় অসম্ভব কাজ। সার্চ কমিটির বদলে অংশীজন, বিভিন্ন পেশাজীবী জাতীয় সংগঠন, নাগরিক সমাজের সক্রিয় ফোরাম ইত্যাদি থেকে নাম চাওয়া যেতে পারে।
জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালা নিয়ে ঢাকায় বুদ্ধিজীবীরা বেশি সোচ্চার হয়েছেন। কিন্তু এটা শুধু বুদ্ধিজীবীর বিষয় নয়। এটা দেশের আপামর দর্শক-শ্রোতার বিষয়। ভুল নীতি, ভুল আইন হলে দেশের সাধারণ দর্শক-শ্রোতা টিভি ও বেতারের বহু ভালো, তথ্যমূলক, গঠনমূলক, বিতর্কমূলক অনুষ্ঠান ও বস্তুনিষ্ঠ খবর থেকে বঞ্চিত হবেন। এটা মেনে নেওয়া যায় না। দর্শক-শ্রোতাদের উদাসীনতা ও নীরবতার ফলে বিটিভি সরকার ও সরকারি দলের আজ্ঞাবহ প্রচারযন্ত্রে পরিণত হয়েছে। এটা আমাদের বিরাট ব্যর্থতা। আশা করি দর্শক-শ্রোতারা চাইবেন না, দেশের প্রাইভেট টিভি চ্যানেলগুলোও সরকারের কাছে নতজানু থাকুক। আমরা চাই স্বাধীন ও দায়িত্বশীল গণমাধ্যম।
মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর: মিডিয়া ও উন্নয়নকর্মী।