সবারই মাস্ক থুতনিতে ঠেকেছে

করোনার প্রকোপ আবারও বেড়েছে। এতটাই বেড়েছে যে, সারা দেশে লকডাউন দিতে বাধ্য হয়েছে সরকার। মাস্ক পরাসহ বিভিন্ন স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলায় সাধারণ মানুষের অনীহা ও অবহেলা এই পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার একটা বড় কারণ। কেউ কেউ স্বাস্থ্যবিধি যেভাবে মেনে এসেছেন এবং এখনো মানছেন, তাকে ঠিক মানা বলা যায় না। তাঁরা মাস্ক পরছেন না মাস্কের সঙ্গে মশকরা করছেন তা বোঝা মুশকিল। নাক-মুখ খোলা, থুতনিতে সেঁটে থাকছে মাস্ক।

আজকের এই করোনা পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে, সাধারণ মানুষের মতো সরকারেরও ‘থুতনিতেও’ এত দিন মাস্ক সেঁটেছিল। গত একটি বছর সরকার যদি ঠিকমতো ‘মুখ-নাক ঢাকত’ তাহলে হয়তো আজ লকডাউন দিতে হতো না; করোনা আক্রান্তদের চিকিৎসা পাওয়ার জন্য এত হা-পিত্যেশ করতে হতো না।  

বলা হচ্ছে, দেশে এসে গেছে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ। প্রথম ঢেউয়ের শুরুতে দেশে শনাক্ত ও মৃত্যু দুই-ই কম ছিল। ধীরে ধীরে তা বেড়েছে। কিন্তু এবার দেখা যাচ্ছে, দ্বিতীয় ঢেউয়ের শুরু থেকেই দৈনিক শনাক্তের ক্ষেত্রে আগের সব রেকর্ড ভেঙে যাচ্ছে। অথচ গত বছর মানুষের মধ্যে যে পরিমাণ সতর্কতা দেখা গিয়েছিল, সেটি আর এবার পরিলক্ষিত হচ্ছে না। অনেকেরই মুখে থাকার বদলে মাস্ক জায়গা নিচ্ছে থুতনিতে। কিন্তু একই অবস্থা যে সরকারের ক্ষেত্রেও দেখা যাচ্ছে। কারণ, সরকারের যা করে ফেলার কথা ছিল, তা যে এখনো ‘করা হবে’ পর্যায়েই রয়ে গেছে।

বিষয়টা কেমন, তার উদাহরণ দেওয়া যাক। করোনা আক্রান্তদের চিকিৎসার ক্ষেত্রে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র ও প্রয়োজনীয় অক্সিজেন দেওয়ার বিষয়টি কতটা গুরুত্বপূর্ণ, তা প্রথম ঢেউয়েই স্পষ্ট হয়ে গেছে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, করোনা সংক্রমণের উচ্চ ঝুঁকিতে থাকা ৩১ জেলার মধ্যে ১৫টিতেই নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র (আইসিইউ) নেই। অথচ ১০ মাস আগেই সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে প্রতিটি জেলা সদর হাসপাতালে আইসিইউ ইউনিট স্থাপনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু এত দিনেও সেখানে উন্নতি নেই। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জেলা পর্যায়ে আইসিইউ ইউনিট তৈরি না হওয়ায় স্বাস্থ্য বিভাগের গাফিলতিই দায়ী।

এবার দেখা যাক অক্সিজেন সরবরাহের বিষয়টিতে। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে জানা গেছে, গত বছর সারা দেশে ৭৯টি হাসপাতালে সেন্ট্রাল অক্সিজেন প্ল্যান্ট (নিরবচ্ছিন্ন অক্সিজেন সরবরাহের ব্যবস্থা) বসানোর পরিকল্পনা নেয় সরকার। কিন্তু গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত মোট ৩৮টিতে অক্সিজেন সরবরাহ শুরু হয়েছে। বাকিগুলোর কাজ এখনো চলছে। বলা হচ্ছে, সংক্রমণের হার কিছুদিন আগে কমে আসায় কাজের গতিও কমে গিয়েছিল। এমনকি এ কাজ বাতিল করার উপক্রমও নাকি হয়েছিল! আর তাই করোনার দ্বিতীয় ঢেউ বাংলাদেশে আছড়ে পড়লেও সারা দেশে নিশ্চিত হয়নি নিরবচ্ছিন্ন অক্সিজেন সরবরাহ।

অথচ সরকারই বলছে, সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্যবিধি মানা নিয়ে তোড়জোড়ের কথা। অনেকে তা মানছে না বা মানতে চাইছে না বলে আমরাও অনুযোগ করছি। কিন্তু সরকারের যা করার কথা ছিল, তা কি সম্পূর্ণ হয়েছে? ওপরের দুটি খবরে এটুকু স্পষ্ট যে সরকার সময়ের কাজ সময়ে করেনি। সেটি হলে এখন অন্তত অক্সিজেনের খোঁজে মানুষকে অসহায় হতে হতো না। সম্প্রতি সংবাদমাধ্যমে বিভিন্ন হাসপাতালে ঘুরে ঘুরে অক্সিজেন না পেয়ে অ্যাম্বুলেন্সেই রোগীর মৃত্যুর ঘটনা আমরা দেখছি। এমন পরিস্থিতি গত বছরও দেখা গেছে। প্রশ্ন হলো, তাহলে সরকার করোনার চিকিৎসা দিতে প্রথম ঢেউ থেকে কী শিখল? নাকি সংক্রমণের হার কমে যাওয়ায় আমজনতার মতোই নাক-মুখ থেকে মাস্ক থুতনিতে নামিয়ে দিয়েছিল সরকার? স্বাস্থ্যমন্ত্রীর ভাষায়, যেটি হলো ‘বেশি খুশি’। তা সেই খুশির আমেজ কি সরকারের বিভিন্ন দপ্তরেও লেগেছে? তা না হলে তো এমন অবস্থা হওয়ার কথা নয়।

ধরুন, আপনি প্রথমবার কোনো খানাখন্দে ভরা রাস্তা দিয়ে যাচ্ছেন। যেহেতু আগে এ সম্পর্কে ধারণা ছিল না, তাই হোঁচট খেতেই পারেন। কিন্তু কিছুদিন পর আবার একই রাস্তায় হাঁটার সময়েও যদি আপনি পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা না নেন এবং খানাখন্দ এড়িয়ে যেতে না পারেন, তবে দোষ নিজের ঘাড়েই বর্তায়। করোনা চিকিৎসার ক্ষেত্রেও সরকারের পরিস্থিতি তেমনই বোধ হচ্ছে।

সরকারের বিভিন্ন সিদ্ধান্তেও বৈপরীত্য পরিলক্ষিত হচ্ছে। একদিকে দেশে পর্যটন ও বিনোদন কেন্দ্রগুলো বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে, জনসমাগম না করার নির্দেশনা দিচ্ছে সরকার। অন্যদিকে সরকারেরই একটি বিভাগের অধীনে লক্ষাধিক শিক্ষার্থীর অংশগ্রহণে হচ্ছে ভর্তি পরীক্ষা। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে এ নিয়ে ঢের আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, শিক্ষার্থীদের সঙ্গে অভিভাবকও যাওয়ায় ভিড় বেশি হয়েছে ইত্যাদি ইত্যাদি। এমন অবস্থায় কেউ নিজেদের সন্তানকে একা ছেড়ে দেবে, তেমনটা আশা করা বোকামি। কিন্তু যাঁরা মহামারি পরিস্থিতিতে এমন পরীক্ষা আয়োজন করলেন, তাঁদের বেলা? জীবনের চেয়ে কি পরীক্ষার মূল্য বেশি হয়ে গেল? নাকি পরীক্ষার হলে করোনা থাকে না?

এসব প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার কেউ অবশ্য নেই। উত্তর হয়তো কেউ দিতেও চায় না। কারণ, উত্তর দিতে গেলে জবাবদিহির প্রসঙ্গ আসে। সেই কাঠগড়ায় দাঁড়ানোর ইচ্ছা বা আগ্রহ কারও মধ্যেই দেখা যায় না আর। তাই বাসে অর্ধেক যাত্রী নেওয়ার কথা থাকলেও আদৌ তা মানা হচ্ছে কি না, সেটি দেখতে সরকারি কর্তৃপক্ষের কড়াকড়ি চোখে পড়ে না। যদিও যাত্রীদের দিয়ে যেতে হয় দ্বিগুণের কাছাকাছি ভাড়া, সঙ্গে বিনা মূল্যে মেলে হয়রানি।

সুতরাং এ দেশের অনেক মানুষের যেমন থুতনিতে মাস্ক, সরকারের অবস্থাও তা থেকে খুব একটা ভিন্ন নয়। তাই সাধারণ জনগণকে নসিহত দেওয়ার পাশাপাশি আমাদের সরকারও যেদিন প্রকৃত অর্থে সচেতন হবে, সেদিনই করোনা থেকে সত্যিকারের স্বস্তি মিলতে পারে। নইলে কোনো না কোনোরূপে ভোগান্তিতে ভুগে যেতেই হবে।

অর্ণব সান্যাল লেখক ও সাংবাদিক
[email protected]