সমাজ পরিবর্তনে আত্মশুদ্ধির ভূমিকা

ভালো মানুষ হওয়ার জন্য আত্মশুদ্ধি অপরিহার্য। সমাজের সব স্তরে শুদ্ধ মানুষই নিরাপদ ও কল্যাণ সমাজ বিনির্মাণ করতে পারে। বিশেষত সমাজের দায়িত্বশীল, ক্ষমতাশীল ও প্রভাব–প্রতিপত্তিসম্পন্ন লোক যাঁরা সমাজ পরিচালনা করেন, তাঁদের আত্মশুদ্ধি প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি এবং সবার আগে। কারণ, তাঁদের ভালো-মন্দের প্রভাব পুরো সমাজে ছড়ায় বা সমাজকে প্রভাবিত করে।

আত্মশুদ্ধির মাধ্যমেই মহানবী (সা.) আদর্শ সমাজ ও কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। হজরত ইব্রাহিম (আ.) দোয়া করেছিলেন, ‘হে আমাদের পরোয়ার দেগার! তাদের মধ্যে থেকেই তাদের নিকট একজন রাসুল প্রেরণ করুন, যিনি তাদের কাছে আপনার আয়াতসমূহ তিলাওয়াত করবেন, তাদের কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দেবেন এবং তাদের তাজকিয়া বা পবিত্র করবেন।’ (সুরা-২ বাকারা, আয়াত: ১২৯)।

তাযকিয়া হলো অভ্যন্তরীণ পবিত্রতা, আত্মিক উন্নতি, চারিত্রিক উৎকর্ষ। লালসা, অন্যায় বাসনা, পরনিন্দা, মিথ্যা, হিংসা, পরশ্রীকাতরতা, আত্মপ্রচার, অহংকার, কার্পণ্য ইত্যাদি থেকে মুক্ত হওয়া।

আত্মশুদ্ধির বিষয়গুলো কোরআন মাজিদে তাকওয়া ও তাজকিয়া নামে রয়েছে এবং হাদিস শরিফে ইহসান নামে এসেছে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘শপথ মানুষের-নফসের এবং যিনি তা স্থাপিত করেছেন। অতঃপর তাকে সৎকর্ম ও মন্দকর্মের জ্ঞানদান করেছেন। প্রকৃত তারাই সফল হলো যারা আত্মশুদ্ধি অর্জন করল, তারা ধ্বংস হলো যারা আত্মাকে কলুষিত করল। (সুরা-৯১ শামস, আয়াত: ৭-১০)।

তাকওয়া মানে সতর্কতা, সাবধানতা। তাকওয়া মানুষকে পাপ থেকে দূরে রাখে এবং সৎকাজে অনুপ্রাণিত করে। আল্লাহ তাআলা বলেছেন, ‘হে মুমিনগণ! তোমরা তাকওয়া অর্জন করো, আল্লাহকে ভয় করো এবং সত্যবাদীগণের সঙ্গী হও।’ (সুরা-৯ তওবা, আয়াত: ১১৯)। ‘সাবধান! আল্লাহওয়ালাগণের কোনো ভয় নেই এবং তারা দুশ্চিন্তাগ্রস্তও হবে না, যারা ইমান আনে এবং তাকওয়া অর্জন করে।’ (সুরা-১০ ইউনুস, আয়াত: ৬২-৬৩)।

ষড় রিপু তথা কাম, ক্রোধ, লোভ, মদ, মোহ, মাৎসর্য মানবের জ্ঞান বা বিবেককে বাধাগ্রস্ত করে, তাই এ প্রবৃত্তিগুলো রিপু তথা শত্রু নামে অভিহিত। এসবের সুনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার মানুষকে সুসভ্য ও উন্নততর করে। এগুলোর যথেচ্ছ ও অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার মানুষকে পশুরও অধম করে দেয়। অধঃপতনের অতল তলে নিমজ্জিত করে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আর অবশ্যই আমি বহু দানব ও মানব জাহান্নামের জন্য পয়দা করেছি, তাদের অন্তর রয়েছে তার দ্বারা তারা অনুধাবন করে না, তাদের চক্ষু রয়েছে তা দ্বারা তারা দেখে না, তাদের কর্ণ আছে উহা দ্বারা তারা শ্রবণ করে না। তারা পশুতুল্য বরং তারা তারও অধম। তারা হলো গাফিল-উদাসীন-অমনোযোগী।’ (সুরা-৭ আরাফ, আয়াত: ১৭৯)।

পঞ্চেন্দ্রিয়—চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিব, ত্বক ও দেহের প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গের সঠিক সংযত ব্যবহার নিশ্চিত করা, দেহ–মনকে অন্যায়-নিষিদ্ধ কাজ ও হারাম বস্তু থেকে বিরত রাখাই ইবাদত। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘মানবদেহে এমন একটি অঙ্গ আছে, যা পরিশুদ্ধ হলে তার পুরো শরীর সঠিকভাবে কাজ করে আর তা যদি নষ্ট হয়ে যায় তার সমস্ত দেহই বিনষ্ট হয়; জেনে রাখো, তা হলো কলব।’ (বুখারি: ৫০)।

নবীজি (সা.) আরও বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি তার চরিত্র রক্ষা করবে ও জবানের হেফাজত করবে, আমি তার জান্নাতের জিম্মাদার।’ (তিরমিজি)।

এই দেহ ও অঙ্গপ্রত্যঙ্গ রোজ হাশরে শেষ বিচারের দিনে আমাদের বিপক্ষে সাক্ষ্য দেবে। কোরআনের ভাষায়, ‘আজ আমি তাদের মুখে সিলমোহর করে দিলাম, তাদের হাত আমার সঙ্গে কথা বলবে, তাদের চরণগুলো সাক্ষ্য দেবে তাদের কৃতকর্মের।’ (সুরা-৩৬ ইয়া-সিন, আয়াত: ৬৫)।

বিদায় হজের ভাষণে মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘আরাফাত দিবস যেমন ফজিলতপূর্ণ, আরাফাতের প্রান্তর যেমন সম্মানিত, মক্কা নগরী যেমন পবিত্র, কাবাঘর যেমন মর্যাদাপূর্ণ; সকল মানুষের জীবন, সম্পদ ও সম্মান অনুরূপ সম্মানীয় ও সুরক্ষিত’। (আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া)।

ইসলামি শরিয়তের দলবিধির পঞ্চ উদ্দেশ্য বা মাকাসিদে শরিয়া হলো মানুষের জীবন সুরক্ষা, সম্পদ সুরক্ষা, জ্ঞান সুরক্ষা, বংশ সুরক্ষা, ধর্মবিশ্বাস সুরক্ষা। (মাকাসিদুশ শরিয়া)। শেষ বিচারের দিনে পাঁচটি প্রশ্ন হবে ‘জীবনের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য, যৌবনের কর্ম-কাল, আয়ের উৎস ও ব্যয়ের খাত এবং জ্ঞান অনুযায়ী আমল-অনুশীলন।’ (তিরমিজি: ২৩৫৩ ও ২৪১৬)।

সুশাসন ও ন্যায়বিচার সব নাগরিকের অধিকার, রাষ্ট্র ও সমাজের স্থিতিশীলতার জন্য এটি অপরিহার্য অনুষঙ্গ। জনগণের জান-মালের নিরাপত্তা, ইনসাফভিত্তিক সমাজ বা কল্যাণ রাষ্ট্রের স্বার্থে সর্বস্তরে তাকওয়া ও আত্মশুদ্ধি নিশ্চিত করা, শুদ্ধাচারের চর্চা এবং নৈতিক শিক্ষার প্রসার সময়ের দাবি, যা ধর্মীয় অনুশাসন অনুসরণেই সম্ভব।

মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী: বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতির যুগ্ম মহাসচিব

[email protected]