সময়ে এক ফোঁড় নয় ফোঁড়ের সমান

ভিসার মেয়াদ স্বয়ংক্রিয়ভাবে বৃদ্ধির দাবিতে কারওয়ান বাজারে সৌদি প্রবাসীদের বিক্ষোভছবি: প্রথম আলো

বাঙালির অতি পুরোনো বচন—লক্ষ্মীকে পায়ে ঠেলতে নেই। অর্থাৎ যে উপকার করে তাকে অনাদর করতে নেই। যেসব বাংলাদেশি প্রবাসী শ্রমিক বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জন করেন, তাঁরা লক্ষ্মী। তাঁদের সুবিধা–অসুবিধার দিকে দৃষ্টি রাখা রাষ্ট্রের অবশ্যকর্তব্য। কিন্তু আমাদের প্রজাতন্ত্রে তাঁদের কোনো অভিভাবক নেই। রাষ্ট্রের বেতনভুক কর্মকর্তা আর অভিভাবক দুই জিনিস।

ছুটিতে দেশে এসে করোনা মহামারির কারণে আটকে পড়েছেন প্রায় ৮০ হাজার প্রবাসী কর্মী। তাঁদের প্রায় সবাই সৌদি আরবে কাজ করেন। সাত মাস পর কর্মস্থলে ফিরে যাওয়ার সুযোগ এসেছে, কিন্তু ফ্লাইটের অভাব। তাঁরা ফিরতি টিকিটের জন্য এয়ারলাইনসের অফিসে গিয়ে কোনো সদুত্তর না পেয়ে রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ করেন। রাষ্ট্রের কর্তাব্যক্তিদের কাছে তাঁদের উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা, বেদনা ও শারীরিক কষ্টের কোনো মূল্য না থাকতে পারে, কিন্তু তাঁদের উপার্জিত অর্থের মূল্য অস্বীকার করবে কে? ৮০ হাজার কর্মী যখন কাজে গিয়ে যোগ দেবেন, তখন তাঁরা প্রতি মাসে যদি মাত্র ১০ ডলার করে দেশে পাঠান, তাহলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সিন্দুকে ৮ লাখ ডলার জমা হবে। যদি ১০০ ডলার পাঠান, দেশে আসবে ৮০ লাখ ডলার। সৌদি নির্দেশমতো যদি ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে কাজে গিয়ে যোগদান করতে না পারেন, তাঁরা চাকরি হারাবেন। যাহোক, শেষ পর্যন্ত জানা গেছে, সৌদি সরকার প্রবাসী কর্মীদের ইকামা (কাজের বৈধ অনুমতিপত্র) ও ভিসার মেয়াদ নতুন করে ২৪ দিন বাড়িয়েছে।

প্রবাসী কর্মীদের বিক্ষোভের পরিপ্রেক্ষিতে তাঁদের ইকামা ও ভিসার মেয়াদ তিন মাস বাড়াতে ২২ সেপ্টেম্বর সৌদি সরকারকে অনুরোধ করে চিঠি দিয়েছিল পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। প্রশ্ন হলো সে চিঠি এত দেরিতে কেন? যদি বিক্ষোভ না হতো, তাহলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কী করত? চিঠি দিত?

বিদেশি শ্রমিক নিয়োগের প্রশ্নে সৌদি আরবের বিধিবিধান সব দেশের ক্ষেত্রেই সমান প্রযোজ্য। করোনা মহামারির মধ্যেই শ্রীলঙ্কার শ্রমিকেরা দেড় মাস আগেই গিয়ে কাজে যোগদান করেছেন। ফিলিপাইনের কর্মীরা গেছেন আরও আগে। ওই সব দেশে করোনা পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ায় তাঁদের সৌদিতে যেতে সমস্যা হয়নি। বাংলাদেশের করোনা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত থাকায় আমাদের প্রবাসী কর্মীদের সমস্যা হয়েছে। ভারতের অবস্থাও তা–ই।

পররাষ্ট্রমন্ত্রীর অনেক উক্তিই উপভোগ্য। অনেক সময়ই তিনি দেশের স্বার্থে বক্তব্য না দিয়ে অন্য দেশের হয়ে বক্তব্য দেন। তাঁর বক্তব্য তথ্যনির্ভরও নয়, কূটনীতিকসুলভও নয়—মনোদ্ভূত। ভারতের ব্যবসায়ীরা যখন পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করলেন, তখন তিনি আগ বাড়িয়ে যা বললেন তার সঙ্গে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্রের বক্তব্যের মিল ছিল না।

আমরা গ্রাম্য রাজনীতিতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি। তাই আধুনিক কূটনীতির ভাষার চেয়ে ভিলেজ পলিটিকসের ভাষা প্রয়োগ করি। বিপন্ন প্রবাসী কর্মীরা প্লেনের টিকিটের জন্য যখন কারওয়ান বাজার এলাকায় সড়কে বিক্ষোভ করছিলেন, তখন পররাষ্ট্রমন্ত্রী তাঁদের ভয় ধরিয়ে দেন। তিনি বলেন, বিক্ষোভকারীদের ভিডিও দেখে সৌদি সরকার তাঁদের ভিসা না–ও দিতে পারে। তিনি বলেন, সৌদি সরকার আইনশৃঙ্খলা বিষয়ে অত্যন্ত কড়া। যদি তারা দেখে আন্দোলনকারীরা জটলা করছেন, হয়তো তাঁদের ভিসা বাতিল করে দেবে কিংবা কাজ বাতিল করে দেবে। তখন কিছু করার থাকবে না। এই কথা বলে সৌদি সরকারের হাতে একটা তলোয়ার ধরিয়ে দেওয়া হলো। আমাদের শ্রমিকদের ভিসা বাতিল করলে পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, নেপাল বা ফিলিপাইন থেকে তারা কর্মী নেবে।

আমরা রেমিট্যান্সের বড় অঙ্ক নিয়ে অহংকার করি। কিন্তু যাঁদের দৌলতে ওই অর্থের অঙ্ক, তাঁদের সামান্যতম মর্যাদা দেওয়া হয় না বরং করা হয় অপমান। পররাষ্ট্রমন্ত্রী একবার বলেছিলেন, এঁরা দেশে আসায় চুরি–ডাকাতির মতো অপরাধ বেড়ে যাবে। ভিয়েতনাম থেকে ফেরত পাঠানোদেরসহ ৩৮৪ প্রবাসী শ্রমিক বর্তমানে কারাগারে। তাঁদের সবার বিরুদ্ধে অভিযোগের ধরন একই। মানবাধিকার কমিশনের উচিত আটক প্রবাসী শ্রমিকদের বিষয়টি খতিয়ে দেখা। কেউ দেশবিরোধী কাজ করলে কঠিন শাস্তি তাঁর অবশ্যপ্রাপ্য। কিন্তু ভিত্তিহীন অভিযোগে কেউ হেনস্তা হলে তা খুব বড় মানবাধিকার লঙ্ঘন।

ছুটিতে এসে করোনার কারণে যাঁরা আটকে পড়েন এবং যাঁদের ফেরত পাঠানো হয়, সরকারের উচিত ছিল তাঁদের তালিকা করা। কার কবে ভিসার মেয়াদ শেষ হবে, কার কাজে যোগদানের তারিখ কবে, কার ফিরতি টিকিট আছে বা নেই—এসব কাজ করার জন্য প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয় এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কয়েক মাস সময় পেয়েছিল। তারা কিছুই করেনি। কর্মীরা বিমানের টিকিটের জন্য বিক্ষোভ না করলে সরকার যে কিছুই করত না, তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই।

স্টেট মেশিনারির আমরা বাংলা করেছি রাষ্ট্রযন্ত্র। বস্তুত রাষ্ট্র একটি যন্ত্রের মতোই। যন্ত্রের সব কটি অংশই যদি একসঙ্গে সক্রিয় না থাকে, তাহলে যন্ত্রটি বিকল হয়ে যায়। আমাদের রাষ্ট্রের যন্ত্রাংশগুলো যে যার মতো চলে। সব বিভাগ সমন্বয় করে কাজ করার প্রয়োজন বোধ করে না। এই সমন্বয়হীনতার কারণে নাগরিকদের দুর্ভোগের শেষ নেই।

এক প্রবাসী কর্মী বিমানের টিকিট পেয়েছেন বৃহস্পতিবার রাত ৯টা ৪৭ মিনিটে। তাঁর ফ্লাইট রাত সাড়ে ১২টায়। মহাখালী করোনা পরীক্ষার অফিস কাঁটায় কাঁটায় বিকেল পাঁচটায় বন্ধ হয়ে যায়। অথচ এ ধরনের জরুরি পরিস্থিতিতে কাজ করতে হবে পাঁচটার পরও। প্রয়োজনে রাত ১০–১২টা পর্যন্ত। এর মধ্যে বিদ্যুৎ ছিল না বলে করোনা পরীক্ষার ল্যাব বন্ধ ছিল, সে জন্য সবার করোনা টেস্ট করা সম্ভব হয়নি। সৌদি যাত্রীর মাথায় হাত।

মহাখালী এলাকায় বিদ্যুৎ কেন বন্ধ রইল? বিদ্যুৎ বিভাগের সংস্কারের কাজ চলছে, তাই বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ। সংস্কারের কাজ দু–চার দিন বন্ধ রাখা যেত অথবা বিকল্প ব্যবস্থা করা যেত। শেষ পর্যন্ত ভোগান্তি ও ক্ষতি নাগরিকদের।

অর্থনৈতিক কূটনীতির কথা আজকাল শোনা যায়। তার জন্য বিশেষ দক্ষতাসম্পন্ন কূটনীতিক চাই। তা ছিলেন সত্তরের শেষ ও আশির দশকে এমনকি নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত। বর্তমানে আমাদের দূতাবাস ও মিশনগুলোতে সে রকম দক্ষতা ও আন্তরিকতাসম্পন্ন কর্মকর্তা আছেন, তেমন প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

সৌদিতে মাত্র কিছুদিন আগেই নতুন রাষ্ট্রদূত যোগ দিয়েছেন। তিনিও পেশাদার কূটনীতিক নন। যেখানে বাংলাদেশের লাখ লাখ কর্মী রয়েছেন, সেখানে আরবি জানা দক্ষ ও পেশাদার কূটনীতিকদেরই দায়িত্বে থাকা দরকার, যাঁরা সৌদি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সুসম্পর্ক স্থাপন করে প্রবাসী নাগরিকদের স্বার্থ রক্ষা করতে পারেন।

সৌদি এয়ারলাইনস ও বিমানের টিকিটের জন্য যাঁরা ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন, তাঁরা কোনো রাজনৈতিক দলের লোক নন। বিক্ষোভ আর আন্দোলন এক জিনিস নয়। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় নাকে তেল দিয়ে না ঘুমালে রাস্তায় তাঁদের জটলা করতে হতো না। আর একটি বচন দুনিয়ার সব দেশেই প্রচলিত: সময়ে এক ফোঁড় নয় ফোঁড়ের সমান।

সৈয়দ আবুল মকসুদ: লেখক ও গবেষক