সরকার কি তরুণদের মনের ভাষা বোঝে

সময়মতো পরীক্ষা অনুষ্ঠানের দাবিতে শিক্ষার্থীরা রাস্তা অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন

এ দেশে বায়ান্ন থেকে শুরু করে যত আন্দোলন-সংগ্রাম হয়েছে, সব সময় নেতৃত্বে ছিলেন ছাত্র–তরুণেরা। যেমন বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন, ছেষট্টির ছয় দফা আন্দোলন। আর উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান তো তৈরিই হয়েছে আসাদ-মতিউরদের আত্মদানের বিনিময়ে। নেতৃত্ব দিয়েছে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। রাজনীতিকেরা ছিলেন পেছনের সারিতে। পাকিস্তান আমলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে তরুণদের চিত্ত আন্দোলিত করতে পেরেছিলেন, সে–ও ছাত্র-তরুণদের আকাঙ্ক্ষাকে সামনে নিয়ে আসার কারণে। তরুণমন চেয়েছিল পাঞ্জাবিদের নিগড় থেকে মুক্তি। শেখ মুজিবের ‘ভায়েরা আমার’ আহ্বানে সেই মুক্তির প্রতিধ্বনি শুনতে পেয়েছিলেন তাঁরা।

স্বাধীনতার পর সমাজমানসে যে বড় রকমের পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা তৈরি হলো, আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব তা উপলব্ধি করতে পারেনি। অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষকের মতে, সেই আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে পারতেন বামপন্থীরা। কিন্তু তাঁরা তা না করে, এক পক্ষ সরকারের বিরোধিতা করতে গিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতারই বিরোধিতা করে বসল। অপর পক্ষ অন্ধভাবে ক্ষমতাসীনদের সমর্থন জোগাতে থাকল। জাসদের রাজনীতির আমরা যতই সমালোচনা করি না কেন, একটি কথা স্বীকার করতে হবে, তারা স্বাধীনতা-উত্তর তরুণদের আকাঙ্ক্ষা বুঝতে পেরেছিল।

স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে যত সরকার এসেছে, কেউ তরুণদের আশা-আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে মিলিয়ে রাজনৈতিক কর্মসূচি বিন্যস্ত করতে পারেনি। ফাঁকা স্লোগানে তাদের আকৃষ্ট করতে চেয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকার ষাটের দশকের ধারায় রাজনীতি করতে গিয়ে তরুণদের সমর্থন হারাল। সেই সময়ে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ নির্বাচনের ফলাফলই এর প্রমাণ। সরকারপন্থী এক তুখোড় ছাত্রনেতা সে সময় আক্ষেপ করে বলেছিলেন, ‘এত সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক ভর্তি করালাম, ছাত্র সংসদ নির্বাচনে বিরোধী পক্ষই জিতে যায়।’

আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব সেই যে তরুণদের আস্থা হারাল, পরবর্তী সময়ে আর সেই আস্থা পুনরুদ্ধার করতে পারেনি। ডাকসু নির্বাচনে তারা একবারই জিতেছিল বাম-জাসদের সঙ্গে আসন ভাগাভাগি করে। বর্তমান সরকারের আমলেও একবার ডাকসু নির্বাচন হয়েছিল। সেই নির্বাচনে ভিপিসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ পদ পেয়ে যান কোটা সংস্কার আন্দোলনের মাধ্যমে গড়ে ওঠা সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের নেতারা। অনেকের মতে, নির্বাচন সুষ্ঠু হলে সব পদই তাঁরা পেতেন এবং সরকার সমর্থক সংগঠনটিকে শূন্য হাতে ফিরে যেতে হতো। এরপর সরকার কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচন দিতে সাহস পায়নি। একটি গণতান্ত্রিক দেশে ৩১ বছর ধরে ছাত্র সংসদের নির্বাচন হয় না। যদিও এই সরকারের অনেক মন্ত্রী ছাত্রজীবনে ছাত্র সংসদের নির্বাচিত নেতা বা নেত্রী ছিলেন। আপনি আচরি ধর্ম বলে যে কথাটি আছে, আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব তার বিপরীতে চলতেই অভ্যস্ত।

অনেকে বলতে পারেন, এসব পুরোনো কাসুন্দি কেন ঘাঁটছি। ঘাঁটছি এ কারণে যে আমরা বেশ আড়ম্বর করে স্বাধীনতার ৫০ বছর উদ্‌যাপন করছি। এই ৫০ বছরে তরুণদের চাওয়া-পাওয়ার হিসাব নেওয়া দরকার। তাঁরা যদি রাষ্ট্রের অভিভাবকদের জিজ্ঞাসা করেন, যে প্রক্রিয়ায় আপনারা নেতা হয়েছেন, সেই প্রক্রিয়ায় তাঁদের নেতা হওয়ার পথ কেন রুদ্ধ করছেন? তাহলে কী জবাব দেবেন? এই প্রশ্ন কেবল এখন যাঁরা ক্ষমতায় আছেন, তাঁদের কাছে নয়; এর আগে যাঁরা ক্ষমতায় ছিলেন, তাঁদের কাছেও।

দ্বিতীয় কারণ হলো, সাম্প্রতিক কিছু ঘটনায় সরকারের খামখেয়ালি সিদ্ধান্ত। ২০১৬-১৭ সালে যখন শিক্ষার্থীরা কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন করছিলেন, তখন সরকারের ওপর মহল থেকে প্রথমে একে অগ্রাহ্য করা হলো। কিন্তু কোনো হুমকি–ধমকি, পুলিশের লাঠিপেটা, জলকামান তরুণদের নিবৃত্ত করতে পারল না। সারা দেশে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ল। এরপর সরকার কোটা সংস্কারের বদলে পুরো কোটাপদ্ধতিই বাতিল করে দিল। এমনকি সরকার গঠিত কমিটিও কোটা বাতিলের সুপারিশ করেনি। ছাত্ররাও চাননি। এই কোটা আন্দোলন করতে গিয়ে বহু ছাত্র-তরুণ ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের হাতে মার খেলেন। ডাকসুর ভিপি নুরুল হক যেখানেই যেতেন, ছাত্রলীগের একশ্রেণির নেতা-কর্মী তাঁর ওপর চড়াও হতেন।

গেল শতকের সত্তর ও আশির দশকে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা পেছানোর দাবিতে শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করতেন। এখন শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করছেন পরীক্ষা এগিয়ে আনার দাবিতে। করোনার কারণে প্রায় এক বছর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ আছে।

এরপর ২০১৮ সালে বিমানবন্দর সড়কের ফুটপাতে দুই কলেজশিক্ষার্থী বাসের চাপায় মারা গেলে ছাত্র-তরুণেরা নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনে নামেন। ঢাকাসহ কয়েকটি বড় শহরে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব তাঁরা নিজেদের হাতে নিয়ে নেন। মন্ত্রী থেকে সাংসদ, সচিব থেকে ব্যবসায়ীদের উল্টো পথে আসা গাড়ি আটকে দেন। এ আন্দোলনে স্কুলের শিক্ষার্থীরাও যোগ দেয়। কিন্তু তারা আইন নিজের হাতে নেয়নি। লাইসেন্সবিহীন গাড়ি পুলিশের কাছে সোপর্দ করেছে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য। প্রবীণ নেতা পঙ্কজ ভট্টাচার্য এর নাম দিয়েছিলেন কিশোর বিদ্রোহ। সরকার কিশোর-তরুণদের সেই বিদ্রোহ দেখে ভয় পেয়ে যায়। তারা ছাত্রদের দাবি মেনে নিয়ে জাতীয় সংসদে সড়ক পরিবহন আইনও পাস করে। যদিও পরিবহনমালিক-শ্রমিকদের বিরোধিতার কারণে সেই আইন এখনো কার্যকর হয়নি।

অতি সম্প্রতি শিক্ষার্থীরা আবার রাজপথে নেমেছেন সময়মতো পরীক্ষা অনুষ্ঠানের দাবিতে। গেল শতকের সত্তর ও আশির দশকে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা পেছানোর দাবিতে শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করতেন। এখন শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করছেন পরীক্ষা এগিয়ে আনার দাবিতে। করোনার কারণে প্রায় এক বছর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ আছে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সবকিছু ভেবেচিন্তে পরীক্ষা নেওয়ার সময়সূচি ঘোষণা করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ পরীক্ষার্থীদের সুবিধার জন্য ১৩ মার্চ হল খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এর মধ্যে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা তালা ভেঙে হলে ঢুকে পড়েন। বিক্ষোভ শুরু হয় অন্যান্য ক্যাম্পাসেও। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাত্রদের পড়াশোনার কথা চিন্তা করে কমিটির মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নির্দেশ দেন। মন্ত্রিপরিষদ সচিব ব্রিফিং করে তা সাংবাদিকদের জানিয়েও দিলেন। এর দুই ঘণ্টা পর শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি ঘোষণা করলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের হল খুলবে ১৭ মে এবং পরীক্ষা ও ক্লাস হবে ২৪ মে থেকে। তাঁর এ ঘোষণার পর যেসব বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ হল খোলা ও পরীক্ষার সময়সূচি ঘোষণা করেছিল, তারা তা প্রত্যাহার করে নেয়। সরকার সমর্থক শিক্ষাবিদেরা চাকরি রক্ষার স্বার্থে শিক্ষামন্ত্রীর সিদ্ধান্তকে ত্বরিত সাধুবাদ জানাতে থাকেন।

কিন্তু শিক্ষার্থীরা সরকারের এহেন তুঘলকি সিদ্ধান্ত মানেননি। প্রথমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা রাস্তা অবরোধ করে পরীক্ষার আগের ঘোষিত সময়সূচি পুনর্বহাল করতে কর্তৃপক্ষকে বাধ্য করেন। গত বৃহস্পতিবার জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা শাহবাগে এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ভুক্ত গার্হস্থ্যবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থীরা নীলক্ষেত মোড়ে বিক্ষোভ করেন। পুলিশ বাধা দিলে কয়েকজন শিক্ষার্থী আহত হন। টিভিতে দেখলাম, ছাত্রীরা কাঁদতে কাঁদতে আকুতি জানাচ্ছেন, ২০১৯ সালে যে পরীক্ষা দেওয়ার কথা ছিল, ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতেও শেষ হয়নি। পরীক্ষা না হওয়ায় তাঁরা কোথাও দরখাস্তও করতে পারছেন না।

ইতিমধ্যে এক বছর পার হয়ে গেছে। শিক্ষার্থীদের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলা চলতে পারে না। সবকিছু খুলে যাওয়ার পর স্বাস্থ্যঝুঁকির দোহাই দিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা কতটা যৌক্তিক?

এরই মধ্যে সরকারি দলের কেউ কেউ শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মধ্যে ষড়যন্ত্রের গন্ধ পাচ্ছেন। আসলে সরকারের যাঁরা নীতিনির্ধারক, তাঁরা তরুণদের মনের ভাষা বোঝেন না, বুঝতে চান না। এ কারণে কোটা সংস্কার, নিরাপদ সড়ক কিংবা পরীক্ষার দাবিতে গড়ে তোলা আন্দোলনেও তাঁরা ষড়যন্ত্র খোঁজেন।

সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি

[email protected]