সরল সুখী দিনাজপুর

নিজের জমিতে কাজ করছেন মহব্বতপুরের কৃষক নাজমুল
নিজের জমিতে কাজ করছেন মহব্বতপুরের কৃষক নাজমুল

‘নিউ হোটেল, যাবেন?’ দিনাজপুর শহরের কালীতলায় বাস থেকে নেমে জিজ্ঞেস করি এক যুবক রিকশাচালককে। তিনি আমাকে হাত নেড়ে ডাকেন, ‘আসেন।’ ভাড়া জানতে চাইলে বললেন, ‘ভাড়া তো পনর ট্যাকা, কিন্তুক মুই আপনার কাছে বিশ ট্যাকা নিম।’ বললাম, ‘আমার কাছে পাঁচ টাকা বেশি নেবেন কেন?’
রিকশাচালক সব দাঁত বের করে প্রসারিত এক হাসি দিয়ে বললেন, ‘আপনে ঢাকাত থাকি আইলেন।’ এমন অনাবিল ও সরল হাসি দেখে বিরূপ হওয়া চলে না। তিনি আমাকে গন্তব্যের দিকে নিয়ে যেতে যেতে আমার কৌতূহলের জবাবে জানালেন তাঁর নাম আরিফুল, বয়স সাতাশ কিংবা আটাশ বছর, বিবাহিত, দুই মেয়ের বাবা, মেয়েরা স্কুলে যায়।
রিকশা চালিয়ে মাসে কত টাকা আয় হয়? এই প্রশ্নের উত্তরে আরিফুল বলেন, হাজার ছয়-সাতেক।
‘এই দিয়ে সংসার চলে?’
পেছনে ঘাড় ঘুরিয়ে আমার মুখের দিকে চেয়ে আবার হাসেন আরিফুল, সন্ধ্যার আলো-আঁধারিতে তাঁর রোদে পোড়া আঁধারময় মুখে সাদা দাঁতের সারি ফুলের মতো ফোটে: ‘হয়, চলে তো।’
‘কষ্ট হয় না?’
‘নাহ্, কিসের কষ্ট?’
রিকশা থেকে নেমে ভাড়া দেওয়ার সময় তাঁকে জিজ্ঞাসা করি, জীবনকে নিয়ে তিনি কী স্বপ্ন দেখেন। তিনি হাতের পিঠে গলার পাশের ঘাম মুছতে মুছতে হাসেন। ঘুরিয়ে জিজ্ঞাসা করি, ‘এই জীবনে কী চান?’
হেসে তিনি আমাকেই জিজ্ঞাসা করেন, ‘কী আর চাহিমো?’

২.
শান্ত, নিরিবিলি শহর দিনাজপুর: প্রায় সাড়ে তিন হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকা নিয়ে গঠিত উত্তরবঙ্গের একটি জেলার কেন্দ্র, রাজধানী ঢাকা থেকে সড়কপথে যার দূরত্ব ৪১৫ কিলোমিটার। ১৩টি উপজেলার ২ হাজার ১৩১টি গ্রামের প্রায় ৩২ লাখ মানুষের এই জেলা বছরে উৎপাদন করে ১৩ লাখেরও বেশি মেট্রিক টন খাদ্যশস্য, যার মধ্যে ৬ লাখ ৬৫ হাজার মেট্রিক টনই উদ্বৃত্ত।
দিনাজপুর শহরের রাস্তায় রাস্তায় হাঁটি আর মানুষগুলোর মুখের দিকে দেখি: তাদের অভিব্যক্তিতে জীবন-জীবিকার প্রচণ্ড চাপের আভাস নেই, নেই জীবিকার তাড়নায় শশব্যস্ত ছুটে চলা। রাস্তায়, অলিগলিতে নিঃশব্দে গড়গড়িয়ে চলে ইজিবাইক নামের ব্যাটারিচালিত ত্রিচক্রযান, যেগুলোর চালক ও যাত্রীদের মুখ দেখলে মনে হয় কত সুখী তারা। রাত ১০টায় দেখি মালদহপট্টির রাস্তার দুপাশের দোকানগুলোতে নির্বিঘ্নে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, কেনাকাটা করছেন নানা বয়সী নারীরা; সদর রাস্তায়ও দেখেছি মেয়েদের স্বচ্ছন্দে ঘুরে বেড়াতে। দিনাজপুর সদর থানার ওসি মোহাম্মদ খালেকুজ্জামানের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলে জানা গেল, দিনাজপুর শহরে মেয়েদের উত্ত্যক্ত করা, নারীর প্রতি সহিংসতা দেশের সাধারণ চিত্রের তুলনায় বেশ কম। তাঁর থানায় দিনে গড়ে কয়টি মামলা হয়, সেগুলোর মধ্যে নারী নির্যাতনের অভিযোগ থাকে কি না—এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি বললেন, দিনে মামলা হয় মাত্র দুই-তিনটা, মাসে গড়ে ষাট থেকে সত্তরটা। বেশির ভাগ অভিযোগ জমি নিয়ে বিরোধ আর মাদক ব্যবসা ও সেবনসংক্রান্ত, তবে কিছু কিছু নারী ও শিশু নির্যাতনের অভিযোগও আসে।
দিনাজপুর-৩ আসনের সরকারদলীয় সাংসদ ও হুইপ ইকবালুর রহিম বৃহস্পতিবার রাতে তাঁর বাড়িতে আলাপকালে বললেন, দিনাজপুরের মানুষ মোটের ওপর সুখে-শান্তিতে স্বাভাবিক জীবন যাপন করছেন। এখানে চুরি-ডাকাতি, ছিনতাই-রাহাজানি নেই; অবশ্য কিছু কিছু মোটরসাইকেল চুরির ঘটনা ঘটে। এ শহরে সন্ত্রাস নেই, সরকারি দল ও বিরোধী দলের মধ্যে মারামারি-কাটাকাটি নেই। উভয় দলের নেতাদের মধ্যে স্বাভাবিক সৌজন্য ও সদ্ভাব আছে।
তাঁর এই বক্তব্যের সমর্থন মিলল শুক্রবার দুপুরে দিনাজপুর জেলা বিএনপির সহসভাপতি মাহবুব আহমেদের সঙ্গে তাঁর বাড়িতে আলাপকালে। তিনিও বললেন, দিনাজপুরে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতাদের মধ্যকার সম্পর্ক চমৎকার। তবে ক্ষোভের সঙ্গে তিনি বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের ওপর পুলিশি নির্যাতন ও হয়রানির অভিযোগ করলেন।
সরকারি ও বিরোধী দলের নেতাদের মধ্যে সদ্ভাব আছে—এই কথা বললেন দিনাজপুর পৌরসভার মেয়র, জেলা বিএনপির যুগ্ম সম্পাদক ও স্বেচ্ছাসেবক দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সহসভাপতি সৈয়দ জাহাঙ্গীর আলমও। মেয়রকে জিজ্ঞাসা করলাম, তাঁর পৌরসভার সমস্যা কী? রাস্তাঘাটের বেহাল অবস্থা, বৃষ্টি হলেই জলাবদ্ধতা, বিপুলসংখ্যক ইজিবাইক চলাচল করার কারণে যানজট—এসব সমস্যার কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে তিনি ক্ষোভের সঙ্গে বললেন, তিনি এসব সমস্যা সমাধান করতে পারছেন না মূলত এই কারণে যে তিনি বিএনপির একজন নেতা হওয়ায় স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়সহ সরকারি প্রশাসন তাঁর সঙ্গে বিরূপ আচরণ করছে।

৩.
খুব ভোর থেকে বাহাদুর বাজারে ইংরেজি ভি আকৃতির দুটো চিকন রাস্তার দুই পাশে বসে যায় টাটকা তরিতরকারি ও শাকসবজির বাজার। ছোট ছোট কৃষক নিজেদের ফলানো এসব কৃষিপণ্য এখানে এনে পাইকারি দরে বিক্রি করেন। সকাল পেরোনোর আগেই বেচাবিক্রি শেষ করে তাঁরা ঘরে ফিরে যান, তখন জমে ওঠে তরিতরকারির খুচরো বাজার; তার পাশেই বসে মাছ-মাংসেরও বাজার। শুক্রবার সকালে সেখানে কথা হলো ছোট কৃষক খোরশেদ আলমের সঙ্গে: দুটি বস্তায় কচুর ছড়া আর এক পাশে কয়েক আঁটি পাতাসুদ্ধ ডাঁটাশাক নিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আগ্রহী খদ্দেরদের সঙ্গে হেসে হেসে খিস্তিখেউড় করছিলেন। তাঁর সঙ্গে আলাপে জানা গেল, নিজের তিন বিঘা জমিতে তিনি ধান, আলু ছাড়াও নানা ধরনের সবজি ফলান। নিজের উৎপাদিত ধানে তাঁর আট সদস্যের পরিবারের সারা বছরের ভাতের চাহিদা মেটে না, চাল কিনতে হয়। সবজি বিক্রি করে তিনি চাল কেনেন। মাত্র তিন বিঘা জমিতে ধান-আলু চাষের ফাঁকে ফাঁকে কতটুকুই আর সবজি ফলানো যায় যে তা বিক্রির টাকায় সারা বছরের ভাতের চাল কেনা যায়? আমার এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি হেসে বলেন, ‘হয় হয়, আল্লাহ দিলে হয়।’ আমি তাঁর এই জীবনসংগ্রামে দুঃখ-কষ্টের সন্ধান করতে গেলে তিনি তাঁর মুখের হাসি অটুট রেখে বলেন, ‘খাটিলে দুক্কু নাই।’
৪.
দিনাজপুর শহর থেকে সাত-আট কিলোমিটার দূরের গ্রাম মহব্বতপুরের যুবক কৃষক নাজমুলের সঙ্গে আলাপ হলো তাঁর এক চিলতে জমিতে। শুক্রবার দুপুরে কাঠফাটা রোদে তিনি তাঁর শিমগাছের গোড়ায় বালাইনাশক ছিটিয়ে ঘাস ও আগাছা মারছিলেন। মা-বাবা, এক বোন আর বউকে নিয়ে মোট পাঁচ সদস্যের সংসার ২৭ বছর বয়সী সুঠাম কৃষক নাজমুলের। তাঁর জমির পরিমাণ সাকল্যে পাঁচ বিঘা। দুই-আড়াই বিঘায় চাষ করেন ধান, অবশিষ্ট জমিতে ফলান বিভিন্ন মৌসুমে বিভিন্ন রকমের সবজি: আলু, পটোল, করলা, বেগুন, শিম, চিচিঙ্গা, ফুলকপি, মুলা, কচুর ছড়া ইত্যাদি।
সারা বছরের ভাতের সংস্থানের জন্য চাল কিনতে হয় কি না, আমার এই প্রশ্নের উত্তরে নাজমুল না-সূচক মাথা নাড়েন। সবজি চাষ করে তাঁর সংসারের সারা বছরের খরচ চলে, এমনকি কিছু লাভ থাকে বলে জানালেন নাজমুল। কিন্তু একটুখানি দুঃখের সঙ্গে বললেন, যখন সবজির খেতে মড়ক লাগে, তখন কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের স্থানীয় কর্মকর্তাদের কাছে ধরনা দিয়েও কোনো সহযোগিতা পান না। কখনো কখনো কোনো কোনো সবজির পুরোটাই নষ্ট হয়ে যায়। তখন লোকসান হয়, সে লোকসান পুষিয়ে উঠতে হয়তো একজন মজুর না নিয়ে তার জায়গায় নিজেকেই আরও বেশি খাটতে হয়।
‘আপনার এখনো ছেলেমেয়ে হয়নি, কিন্তু একদিন তো হবে? তারপর আপনার বোনকে বিয়ে দিতে হবে। খরচ বাড়বে, কিন্তু আপনার জমির পরিমাণ তো বাড়বে না। ভবিষ্যৎ নিয়ে কী ভাবেন?’ আমি এই কথা বলার পর তাঁর রোদে পোড়া শুকনো মুখে সরস হাসি দেখে স্পষ্ট বোঝা যায়, তাঁর মনে ভবিষ্যতের দুশ্চিন্তা ঢুকিয়ে দিতে পারিনি। নাজমুল হেসে বলেন, ‘ভালো করি আবাদ করলে সমস্যা হোবে না। ফসলের লাভ দিয়ে কিছু জমিও তো কিনতে পারি।’
‘বউ কিছু শখ-আহ্লাদের কথা বলে না?’ জিজ্ঞাসা করি।
‘তা বলে মাঝে মাঝে,’ লাজুক হেসে বলেন নাজমুল, ‘তাতে সমস্যা নাই, বেশি কিছু তো আর চায় না।’

৫.
জীবনের কাছে সামান্যই চাওয়া রিকশাচালক ৩৫ বছর বয়সী রিকশাচালক শাহাবুদ্দিনেরও। বুধবার রাত সাড়ে ১০টায় দিনাজপুর শহরের লিলির মোড়ে বিড়ি টানতে টানতে তিনি আমাকে বলেন, তিনি রিকশা চালান ২০ বছর ধরে। অনেক রিকশাচালক এখন ইজিবাইকের চালক হয়েছেন, কিন্তু ইচ্ছা করেই রিকশা চালানো ছাড়েননি। কারণ, রিকশা তাঁর নিজের কিন্তু ইজিবাইক কেনার সামর্থ্য তাঁর নেই। ‘হামার পাও আছে,’ নিজের রিকশায় যাত্রীর আসনে হেলান দিয়ে বসে হাঁটু দোলাতে দোলাতে বলেন শাহাবুদ্দিন। মাসে আয় কত, জিজ্ঞাসা করলে বলেন, হাজার ছয়েক, কোনো কোনো মাসে সাত হাজারও হয়।
‘ছয় হাজার টাকা দিয়ে মাস চলে?’
‘ভালো চলে।’
‘আর কোনো মাসে সাত হাজার হলে?’
‘ফাটাফাটি!’
মশিউল আলম: সাংবাদিক।
[email protected]