সর্বজনীন জাতীয় পেনশন নিয়ে কিছু সুপারিশ

সরকার সর্বজনীন নাগরিক পেনশন চালুর একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ বাস্তবায়নের নীতিকৌশল প্রণয়ন করে আগামী বছরের জুলাই থেকে একটি পাইলট স্কিম চালু করবে বলে সরকারি সূত্রে জানা গেছে। ২০২২-২৩ সালের বাজেট তৈরির প্রাক্কালে সর্বজনীন নাগরিক পেনশনের বিষয়টি নিয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত হতে যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, একটি পেনশন আইন প্রণয়ন ও আইনের আওতায় একটি পেনশন কর্তৃপক্ষ গঠন।

এ পর্যন্ত এই আইনের খসড়ার বিষয়ে যা জানা যায়, তা হচ্ছে ১৮ থেকে ৫০ বছর বয়সী ব্যক্তিরা নির্দিষ্ট একটি চাঁদা দিয়ে পেনশনের জন্য নিবন্ধিত হবেন। ন্যূনপক্ষে ১০ বছর এ চাঁদার ধারাবাহিকতা থাকলে তাঁরা নির্দিষ্ট বয়সসীমা অতিক্রম করার পর রাষ্ট্রীয় পেনশন পাওয়ার উপযুক্ততা অর্জন করবেন। তা ছাড়া বেসরকারি খাতকে পেনশন-ব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্তিরও একটি পথরেখা করা হচ্ছে বলে জানা গেছে। পেনশন আইন ও এ-বিষয়ক নীতিমালা চূড়ান্ত করার আগে জনমত গ্রহণ ও বিশেষজ্ঞ পরামর্শ গ্রহণের প্রয়োজন রয়েছে। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে বলব, মন্ত্রিপরিষদে পেশ করার আগে খসড়া আইনটি জনমতের জন্য প্রকাশ করুন। নির্দিষ্ট সময়ের পর জনমতগুলো সন্নিবেশ করে আইনের চূড়ান্ত খসড়া মন্ত্রিপরিষদের অনুমোদনের জন্য পেশ করুন।

আপাতত পেনশন–বিষয়ক যেসব খবর পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে, তার ভিত্তিতে কিছু মতামত সরকারের বিবেচনার জন্য উপস্থাপন করছি।

পেনশন আইন ও এ-বিষয়ক নীতিমালা চূড়ান্ত করার আগে জনমত গ্রহণ ও বিশেষজ্ঞ পরামর্শ গ্রহণের প্রয়োজন রয়েছে। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে বলব, মন্ত্রিপরিষদে পেশ করার আগে খসড়া আইনটি জনমতের জন্য প্রকাশ করুন। নির্দিষ্ট সময়ের পর জনমতগুলো সন্নিবেশ করে আইনের চূড়ান্ত খসড়া মন্ত্রিপরিষদের অনুমোদনের জন্য পেশ করুন

১. সর্বজনীন পেনশন–ব্যবস্থার ও প্রকার–প্রকৃতি: দেশের সামরিক–বেসামরিক, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা পেনশন–ব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত। সরকারি কর্মচারীদের প্রচলিত পেনশন–ব্যবস্থাকে বিশ্ববিদ্যালয়সহ স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলোতেও সম্প্রসারিত করা হয়েছে। তাঁদের সে জন্য পেনশন তহবিলে কোনো নগদ চাঁদা দিতে হয় না। সরকার প্রতিবছর জাতীয় সুরক্ষা খাতের মধ্য থেকে থোক বরাদ্দ দিয়ে সরকারি কর্মচারীদের পেনশনের অর্থ সংস্থান করে থাকে। প্রস্তাবিত সর্বজনীন পেনশন–ব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্তিকে ব্যক্তির ইচ্ছাধীন করে মাসে মাসে একটি নির্দিষ্ট ‘চাঁদা’ বা প্রিমিয়াম দেওয়ার কথা শোনা যাচ্ছে। পেনশন–ব্যবস্থার প্রকৃতি স্বেচ্ছাধীন বা স্বেচ্ছাধীন বিমা প্রকৃতির হচ্ছে, নাকি তা জনগণের নাগরিক অধিকারের অংশ হবে, সে বিষয় শুরুতেই মীমাংসা করা গুরুত্বপূর্ণ। পশ্চিমা বিশ্বে পেনশন নাগরিক অধিকারের হিসাবে স্বীকৃত এবং দেশের নাগরিকদের আয়কর প্রদান ও পেনশন প্রাপ্তি একটি অবিচ্ছেদ্য ও একীভূত পদ্ধতি।

২. পেনশনের আওতা ও অংশগ্রহণকারী: সর্বজনীন পেনশন–ব্যবস্থার আওতায় কারা থাকবেন, বিষয়টি স্বচ্ছ নয়। প্রস্তাবমতো যদি ১৮ থেকে ৫০ বছর বয়সীদের কাছ থেকে আর্থিক কিস্তি নিয়ে এ ব্যবস্থার সূচনা হয়, তাহলে বেশ কটি প্রশ্ন অমীমাংসিত থাকে, যা স্পষ্ট করা প্রয়োজন। এক. পঞ্চাশোর্ধ্ব মানুষকে কীভাবে এ ব্যবস্থার আওতায় আনা হবে। দুই. যাঁরা এখন ৬০ বছর বয়স অতিক্রম করেছেন, কিন্তু সরকারি চাকরি করেননি, তাঁদের জন্য কী বিধান হবে? তিন. ১৮ বছর বয়সী যাঁরা ৩০ বছর বয়সের মধ্যে সরকারি চাকরিতে যোগ দেবেন, তাঁদের একটা বিধান থাকতে হবে। চার. একই পরিবারের স্বামী-স্ত্রী দুজনে কি একই স্কিমে পেনশনধারী হতে পারবেন, নাকি একজনের ক্ষেত্রে তা প্রযোজ্য হবে এবং একজনের অবর্তমানে অন্যজন একই সুবিধা ভোগ করবেন।

৩. অর্থায়ন-পেনশনের ব্যবস্থা নিয়ে দেশের সাধারণ মানুষ বাদেও বোদ্ধাদের নিস্পৃহতার কারণ ছিল অর্থায়নবিষয়ক জটিলতা। সরকারি কর্মচারীদের বেতন-ভাতা-পেনশন জাতীয় বাজেটের ওপর একটি বড় চাপ। তার ওপর সর্বজনীন পেনশন এটি। এখন বিমাপদ্ধতির মতো কিস্তি–ব্যবস্থার মাধ্যমে পেনশন চালুর চিন্তাও সম্ভবত খুব একটা কার্যকর পদ্ধতি হিসেবে সমাদৃত হবে না। দূরের বাদ্য শুনে কিস্তি দেওয়ার মনোভঙ্গি এবং আমলাতান্ত্রিকতার প্রতি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি এ পদ্ধতির পথে একটি অন্যতম বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে।

৪. বাস্তবায়নের ধাপ বা স্তর: সর্বজনীন পেনশন একটি জটিল কর্মযজ্ঞ। এটি রাতারাতি সম্পূর্ণ বাস্তবায়নে যাওয়া সম্ভব না–ও হতে পারে। তাই এটিকে সুনির্দিষ্ট কিছু ধাপ স্থির করে অন্তত পাঁচ বছর সময় নিয়ে বাস্তবায়নের একটি রোডম্যাপ করা উচিত। এখানে টেকসই তহবিল, ভালো আইনি কাঠামো ও দক্ষ প্রশাসনিক সংগঠন প্রয়োজন।

উপরিউক্ত চারটি বক্তব্যের আলোকে কিছু সুপারিশ

১. বাংলাদেশের সর্বজনীন পেনশন–ব্যবস্থা হতে হবে ‘নাগরিক অধিকার’। এটি কোনো দারিদ্র্য বিমোচন বা বিমা–ব্যবস্থার অংশ বা আদলে স্বেচ্ছাধীন কার্যক্রম হলে পূর্ণ সুফল পাওয়া যাবে না বা তা কল্যাণরাষ্ট্রের সমীচীন সমপর্যায়ভুক্ত হবে না। দেশের আয়কর–ব্যবস্থার সঙ্গে পেনশন–ব্যবস্থা যুক্ত করতে হবে। কর প্রদানকারী নাগরিকদের সক্রিয় কর্মজীবন শেষে পেনশন পাওয়া একটি অধিকার হিসেবে স্বীকৃত হবে। পেনশন ও সামাজিক সুরক্ষা আইন ও নীতিমালা সেভাবে প্রণীত হওয়া উচিত। কর দেওয়া হবে নাগরিক কর্তব্য এবং পেনশন পাওয়া হবে নাগরিক অধিকার।

২. করব্যবস্থার সঙ্গে পেনশনকে যুক্ত করা হলে দেশে করদাতার সংখ্যা জ্যামিতিক হারে বাড়বে। এখন দেশে কর প্রদানকারীদের ট্যাক্সের বিপরীতে সরাসরি কোনো উপকার লাভ হয় না। পেনশন পাওয়ার গ্যারান্টি থাকলে দেশে করের ভিত্তি শক্তিশালী হবে। প্রত্যেক করদাতার নামে পেনশন হিসাব স্বয়ংক্রিয়ভাবে খোলা হয়ে যেতে পারে এবং করদাতার প্রদত্ত করের একটি শতাংশ (৫, ৭, ১০%) তাঁর পেনশন হিসাবে জমা হবে এবং সরকারের সমন্বিত একটি পেনশন তহবিলে সমুদয় অর্থ জমা হবে। প্রতিবছর সরকার প্রাপ্ত মোট ভ্যাটের ৫ থেকে ১০ শতাংশ পেনশন তহবিলে জমা করে দেবে। এ তহবিল এনবিআর সংরক্ষণ করবে। সরকার এ অর্থ বিনিয়োগ করবে এবং মুনাফার অর্থ এ তহবিলে ফিরে আসবে। করদাতার অর্থে তহবিল সৃষ্টি ছাড়া পেনশন তহবিল সৃষ্টির অন্য বিকল্প খোঁজা উচিত নয়।

আরও পড়ুন

৩. আগামী অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে বেসরকারি ব্যক্তি (চাকরি, ব্যবসা, চাষাবাদ বা যেকোনো পেশাধারী) নিয়মিত গত ১০ বছর কর দিয়ে যাঁরা ৬০ উত্তীর্ণ, তাঁদের জন্য দেয় করের অনুপাত ও জাতীয়ভাবে জীবনযাত্রার ব্যয়সূচক পর্যালোচনা করে পেনশনের ব্যবস্থা হোক। আগামী অর্থবছর থেকে করের অর্থ থেকে পেনশন তহবিল গঠন শুরু করা হোক।

৪. পেনশন হোল্ডারদের নানা শ্রেণিতে বিভক্ত করে পেনশনের হার ও পরিমাণ নির্ধারণ করা প্রয়োজন হবে। যেমন আনুষ্ঠানিক খাতের চাকরিজীবী, অনানুষ্ঠানিক খাতের চাকরিজীবী, প্রাতিষ্ঠানিক শিল্পপতি ও ব্যবসায়ী, স্বকর্মে নিয়োজিত ব্যক্তি, বেকার ও হতদরিদ্র। সরকারি চাকরিজীবীরা যেহেতু রাষ্ট্রীয় পেনশন পাচ্ছেন, তাঁরাও একটি শ্রেণি। দেশের সব কর্মক্ষম ও কর্মে নিয়োজিত মানুষের জন্য টিআইএন বাধ্যতামূলক হবে। প্রতিটি টিআইএনের বিপরীতে একটি পেনশন হিসাব থাকবে। প্রত্যেক নাগরিকের বয়স ৫০ ও ৫৫ অতিক্রমের পর তাঁদের পেনশন হিসাব পর্যালোচনা করে দেখা হবে এবং ৬০ বছর অতিক্রান্তের পর থেকে পেনশন পেতে থাকবেন। পর্যালোচনায় যাঁদের পেনশন হিসাবে পর্যাপ্ত অর্থ থাকবে না বা শূন্য থাকবে, তাঁদের বিষয়ে সরকার সিদ্ধান্ত নেবে।

ড. তোফায়েল আহমেদ স্থানীয় শাসন বিশেষজ্ঞ ও শিক্ষক