সহাবস্থানের কফিনে শেষ পেরেক কি ২১ আগস্ট

২০০৪ সালের ২১ আগস্ট রাজধানীর বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলায় হতাহতদের এভাবেই পড়ে থাকতে দেখা যায়ফাইল ছবি

টমাস বাবিংটন ম্যাকলে (১৮০০-৫৯) বাঙালি চরিত্র সম্পর্কে বলেছেন, ‘মোষের যেমন শিং আছে, মৌমাছির আছে হুল, গ্রিক সংগীতে যেমন মেয়েদের সৌন্দর্য, তেমনি বাঙালিদের বিশেষত্ব প্রতারণা। প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করার সুন্দর অজুহাত দেখায়; প্রতারণা, মিথ্যা হলফ, জালিয়াতি এসব—তারা আত্মরক্ষার্থে কিংবা অন্যের ক্ষতি করার জন্য অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে দ্বিধা করে না; গাঙ্গেয় নিম্নাঞ্চলের লোকদের স্বভাবই এ রকম (আকবর আলি খানের অনুবাদ)।’

ম্যাকলেকে আমরা বাঙালিবিদ্বেষী উপনিবেশবাদী বলে উড়িয়ে দিতে পারি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে মন্তব্য করেছেন, ‘পরশ্রীকাতরতা এবং বিশ্বাসঘাতকতা আমাদের রক্তের মধ্যে রয়েছে।...ঈর্ষা, দ্বেষ সকল ভাষায়ই পাবেন, সকল জাতির মধ্যেই কিছু কিছু আছে, কিন্তু বাঙালির মধ্যে আছে পরশ্রীকাতরতা।’

যে সমাজের ছবিটি এ রকম, সেখানে সংহতি আশা করা দুরাশা। মারামারি-কাটাকাটি সেখানে নৈমিত্তিক ব্যাপার হবে। তারপরও আমরা দাবি করি, আমরা মানুষ হয়েছি, প্রগতির পথে ছুটছি, উন্নতির শিখর স্পর্শ করছি। কিন্তু বাস্তবে আমাদের আচরণ দেখলে এই দাবি ধোপে টেকে না। বাংলাদেশের রাজনীতির চালচিত্র দেখলে ম্যাকলে আর বঙ্গবন্ধুর মন্তব্যের সারবত্তা খুঁজে পাওয়া যায়। এর একটি বিকৃত রূপ আমরা দেখেছি ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট।

সেদিন কী ঘটেছিল, তা আমরা জানি। কেন ঘটেছিল, কারা ঘটিয়েছিল, তা নিয়ে তর্ক আছে। সমাজটা যেমন বিভক্ত, ২১ আগস্ট নিয়েও তেমনি আছে পরস্পরবিরোধী বয়ান। এ নিয়ে তর্ক চলতেই থাকবে। এ দেশের রাজনীতিটাই যে এ রকম। সরকার বদল হলে সরকারি বয়ানও বদলে যায়—এ আর নতুন কী?

মার্ক্সীয় সাহিত্যে রাষ্ট্রকে একটি বলপ্রয়োগকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। এটি যখন যার হাতে থাকবে, সে এটি ব্যবহার করবে তার প্রতিপক্ষকে দমন করতে। এ দেশে গণতন্ত্রের স্ফুরণ ও বিকাশ তেমন হয়নি। ক্ষমতায় থাকলে গণতন্ত্রী, ক্ষমতাচ্যুত হলে ভিকটিম। মিউজিক্যাল চেয়ারের মতো এই খেলা চলছে দশকের পর দশক। এই পরিক্রমার একটি স্টেশন হলো ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট। কিন্তু এটি তো এক দিনে হয়নি। রাজনীতিটা যে ধারায় চলছিল, ২১ আগস্ট ছিল তার অনিবার্য পরিণতি। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টকে সামরিক অভ্যুত্থান বলে না হয় চালিয়ে দেওয়া যায়; কিন্তু ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট? দুটোর সঙ্গেই রাষ্ট্রশক্তি নানাভাবে জড়িয়ে ছিল। এর মধ্যেও আছে কিছু ‘গ্রে-এরিয়া’, যা নিয়ে কথা বলাটা এখনো ‘ট্যাবু’। এ দেশে ক্ষমতা পেয়েও সবাই তুষ্ট হন না। তাঁদের চাই একচ্ছত্র ক্ষমতা।

১৯৫৪ সালের পর এ দেশে দলীয় সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনই শতভাগ অবাধ ও সুষ্ঠু হয়নি। শুরুর দিকে দখলদারির মাত্রা ছিল কম। ক্রমে বেলা হলো। চর দখলের লড়াই বিস্তৃত হলো। লাঠিয়াল বাহিনী আরও আগ্রাসী হলো। ১৯৭৩ সালের ৭ মার্চের নির্বাচনে দাউদকান্দির আসনে খন্দকার মোশতাক আহমদের কারচুপির নির্বাচন থেকে শুরু করে ১৯৯৪ সালের ২০ মার্চ মাগুরায় কাজী সলিমুল হকের জবরদস্তি জয়—দুটোয় চিত্রনাট্য একই ধাঁচের। তত দিনে দেশে দ্বিদলীয় রাজনীতি বেশ জোরদার হয়েছে। কেউই ছেড়ে দেওয়ার পাত্র নয়। সুতরাং রাজনীতি হয়ে পড়ল সংঘাতময়। ওই সময় উঠল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি। জেদাজেদির রাজনীতি এমন পর্যায়ে গেল যে ১৯৯৬ সালে দুটি নির্বাচনের আয়োজন করতে হলো। রাজনীতির দুই পরাশক্তির জেদাজেদির ফাঁক গলে অবলীলায় যুদ্ধাপরাধী জামায়াতে ইসলামীর পুনর্বাসন হয়ে গেল। কী চমৎকার দেখা গেল! ১৯৯৬ সালের ৪ জুন গোলাম আযম বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার উদ্দেশে বললেন, ‘স্বেচ্ছাচারিতা ও জেদের রাজনীতি দিয়ে দেশ চলে না। গত পাঁচ বছরে ক্ষমতাসীন নেত্রীর জেদের কারণে দেশে এত অশান্তি, হানাহানি ও হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদের অপচয় হয়েছে। এই পাঁচ বছরে তাদের দুর্নীতি, লুটপাট এবং অন্যায়ভাবে প্রশাসনকে ব্যবহারের বিচার জনগণ একদিন করবে।’ (সংগ্রাম, ৫ জুন ১৯৯৬)

১৯৯৬ সালের ১২ জুনের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে সরকার গঠন করে। বিএনপি ১১৬ আসনে জয়ী হয়ে দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে শক্তিশালী বিরোধী দল হিসেবে জায়গা করে নেয়। ২২ জুন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান তাঁর বিদায়ী ভাষণে রাজনৈতিক নেতাদের অনুরোধ জানিয়ে বলেন, ‘নতুন জাতীয় সংসদকে কেন্দ্র করে আপনারা এমন রাজনৈতিক রীতি-রেওয়াজ গড়ে তুলুন, যেন ভবিষ্যতে আর কোনো দিন রাজনৈতিক কোনো সমস্যা সমাধানে রাজপথের আশ্রয় না নিতে হয়, সন্ত্রাসী শক্তি পোষণ করতে না হয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের হাতে মারণাস্ত্র তুলে দিতে না হয়।’ বিচারপতির এই আবেদন ছিল অরণ্যে রোদন।

১৫ আগস্ট আমাদের রাজনীতিতে একটি গভীর ক্ষত তৈরি করেছে। তখন বিএনপি ছিল না। কিন্তু বিএনপির রাজনৈতিক ভিত্তি তৈরি হয়েছে ১৫ আগস্টকে ঘিরে। ১৯৯৬ সালে আপস-মীমাংসার একটা সুযোগ তৈরি হয়েছিল। বিএনপি সুযোগটি নিতে পারত। ১৯৯৬ সালের ১১ নভেম্বর জাতীয় সংসদে ইনডেমনিটি আইন বাতিলের বিল আলোচ্যসূচিতে রাখা হয়েছিল। স্পিকারের ‘পক্ষপাতমূলক আচরণের’ ছুতো তুলে বিএনপির সদস্যরা সংসদ অধিবেশন থেকে ওয়াকআউট করেন। এই ওয়াকআউটের মাধ্যমে তারা একটা বার্তা দিল, তারা এই আইনের বাতিল চায় না। এর অর্থ হলো ১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ডের বিচার করা যাবে না—এই অবস্থান বিএনপি বজায় রাখল।

২১ বছর পর ক্ষমতায় ফিরে এসে আওয়ামী লীগ বিনয়ী হয়নি। বিজয়নগরে বিএনপির মহিলা দলের নেত্রী মনি বেগমের শাড়ি নিয়ে টানাটানি করল পুলিশ। ব্যাপারটা শুধু লজ্জার নয়, অসভ্যতার চূড়ান্ত। বিএনপির চার নেতা—খন্দকার মোশাররফ হোসেন, আবদুল মান্নান, গয়েশ্বর চন্দ্র রায় ও মির্জা আব্বাসকে অকারণে গ্রেপ্তার করা হলো। ১৯৯৭ সালের ৭ এপ্রিল হাইকোর্ট এই চার নেতাকে বিশেষ ক্ষমতা আইনে আটক রাখার আদেশ অবৈধ ঘোষণা করে সরকারকে নির্দেশ দেন প্রত্যেককে এক লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে। এরপর শুরু হয়ে গেল পুরোনো খেলা, বিরোধী দলের যখন-তখন ওয়াকআউট, সংসদ বর্জন ও হরতাল ডাকা।

১৯৮০-এর দশকে এরশাদ যখন শত্রু, তখন দুই দলের শীর্ষ নেতারা অনেক কাছাকাছি এসেছিলেন, যুগপৎ আন্দোলন করেছিলেন। এখন এরশাদ দৃশ্যপটে নেই। তাঁরা দুজন পরস্পরের ঘোর দুশমন।

এভাবেই তৈরি হচ্ছিল সংঘাতের প্রেক্ষাপট। একুশ শতকে এসে যখন বিভিন্ন দেশ নতুন নতুন স্বপ্ন দেখছে, রূপকল্প তৈরি করছে, তখন এ দেশে প্রতিপক্ষকে নির্মূল করার রাজনীতি হলো আরও বেগবান। ২০০১ সালের সরকারে দ্বিতীয়বারে এসে খালেদা জিয়া আরও কিছু পদক্ষেপ নেন, যা ছিল প্রতিপক্ষের জন্য উসকানিমূলক। ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর নানা জায়গায় নির্যাতন চালানো হয়। তাদের বড় অপরাধ, তারা আওয়ামী লীগের ‘ভোটব্যাংক’। ২০০২ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর ‘রাজনৈতিক কারণে’ দায়ের করা তিন হাজার মামলা তুলে নেওয়া হয়। জেল থেকে খালাস পান বিএনপির কর্মী-সমর্থক ৩৮ হাজার ১৯০ জন আসামি। তার দুই বছরের মাথায় বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে আওয়ামী লীগ অফিসের সামনে ঘটল ভয়াবহ গ্রেনেড ও বোমা হামলা।

নির্মূলের রাজনীতির এই ভয়ংকর রূপ এর আগে খুব কম দেখা গেছে। বিএনপি থেকে প্রচার করা হলো, আওয়ামী লীগ নিজেই বোমা ফাটিয়ে নাটক ফেঁদেছে। বিএনপি নেতাদের মুখে এমন কথাও শোনা গেছে যে শেখ হাসিনা নাকি নিজেই ভ্যানিটি ব্যাগে করে বোমা নিয়ে গিয়েছিলেন। বিষয়টা নিয়ে তাঁরা মর্মান্তিক কৌতুক করলেন। প্রকারান্তরে এই হামলার দায় নিয়ে নিলেন নিজেদের ঘাড়ে। তাঁরা যুক্তি দিলেন, যদি সত্যি সত্যিই শেখ হাসিনাকে হত্যার পরিকল্পনা থাকত, তাহলে তিনি বেঁচে আছেন কীভাবে? অর্থাৎ শেখ হাসিনাকে ‘মরিয়া প্রমাণ করিতে হইবে তিনি মরিয়াছেন।’

সহাবস্থান ও সমঝোতার রাজনীতিতে সেদিনই কি শেষ পেরেকটা ঠুকে দেওয়া হয়েছিল? কে জানে! রাজনীতিবিদেরাই তো বলেন, রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই।

মহিউদ্দিন আহমদ লেখক ও গবেষক