সহিংসতার বিরুদ্ধে এক হও

সৃষ্টির আদিকাল থেকে নারী-পুরুষের সম্মিলিত উদ্যোগ, ত্যাগ ও অবদানের ভিত্তিতে পরিবার, সমাজব্যবস্থা ও সভ্যতা বিকাশ লাভ করলেও কালের পরিক্রমায় গৃহে ও বহিঃসমাজে নারী ও পুরুষের লিঙ্গ-বিভাজিত ভূমিকাকে কেন্দ্র করে ক্রমেই পুরুষশাসিত সমাজব্যবস্থার প্রচলন এবং সেই ধারাবাহিকতায় সূচিত হয় নারীর প্রতি বৈষম্য ও সহিংসতা, যা আজ বিশ্বজুড়ে প্রকট আকার ধারণ করছে। যদিও সময়ের বিবর্তনে সর্বজনীন মানবতা, সামাজিক সুশাসন এবং টেকসই উন্নয়নের পূর্বশর্ত হিসেবে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে নারীর প্রতি বৈষম্য ও সহিংসতা নিরসন তথা নারীর মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার আবশ্যকতা প্রমাণিত হয়েছে। তা সত্ত্বেও একবিংশ শতাব্দীর দ্বারপ্রান্তে এসেও পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি দেশে মাত্রাভেদে নারী বৈষম্য ও সহিংসতার শিকার হচ্ছে।
জাতিসংঘের অধিকাংশ সদস্যরাষ্ট্রে তত্ত্বগতভাবে নারীর সম-অধিকারের স্বীকৃতি এবং নারীর প্রতি সহিংসতা দণ্ডনীয় অপরাধরূপে চিহ্নিত হলেও নারীর প্রতি সহিংসতা একাকী সর্বজনীন রূপ ধারণ করেছে এবং সেই পরিপ্রেক্ষিতে নারী-পুরুষের সমতা অর্জন ও নারীর প্রতি সহিংসতা নিরসন আজ একটি বৈশ্বিক সংগ্রামে পরিণত হয়েছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৯১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের উইমেন্স গ্লোবাল লিডারশিপ ইনস্টিটিউট ২৫ নভেম্বরকে নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। পরবর্তী সময়ে ১৯৯৩ সালে ভিয়েনায় অনুষ্ঠিত বিশ্ব মানবাধিকার সম্মেলনে এই দিবসটিকে আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয় এবং বিশ্বজুড়ে নারী নির্যাতন নিরসনের উদ্দেশ্যে জাতিসংঘের সব সদস্যরাষ্ট্রকে আন্তরিক অঙ্গীকার, দৃশ্যমান উদ্যোগ ও ব্যাপক প্রচারণার মাধ্যমে পালনের আহ্বান জানানো হয়। জাতিসংঘের মহাসচিব এ বছর আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন দিবস পালনের প্রতিপাদ্য বিষয় হিসেবে নির্বাচন করেছেন ‘অরেঞ্জ দ্য ওয়ার্ল্ড: ইউনাইট টু অ্যান্ড ভায়োলেন্স অ্যাগেইনস্ট উইমেন অ্যান্ড গার্লস’। বাংলায় বলা যায়, ‘বিশ্বকে কমলায় রাঙাও: নারী ও কন্যাশিশুদের প্রতি সহিংসতার বিরুদ্ধে এক হও।’

>নারী-পুরুষের মধ্যে সম্পদের বিরাট অসমতা নারীর অধস্তনতাও পুরুষের নিয়ন্ত্রকের ভূমিকাকে সুদৃঢ় করছে। যদিও নারী জিডিপিতে বিরাট অবদান রাখছে, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের ৭০ শতাংশ নারী ভূমিজ এবং আর্থিক সম্পদবঞ্চিত

এ বছরের কার্যক্রমে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে এ জন্য তিনটি কারণে। প্রথমত, এ বছর বেইজিং কার্যক্রমের (পিএফএ) ২০ বছর পূর্তি। বেইজিং এজেন্ডার ১২টি চিহ্নিত সমস্যা ও করণীয়র মধ্যে নারীর প্রতি সহিংসতা নিরসন লক্ষ্য থাকা সত্ত্বেও তা ছিল সবচেয়ে দুর্বল বাস্তবায়ন। দ্বিতীয়ত, এমডিজির সমাপ্তি এবং তৃতীয়ত, বিগত সেপ্টেম্বর মাসে জাতিসংঘের সব রাষ্ট্রের সম্মতিক্রমে গৃহীত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ, যা বাস্তবায়নের মূল ভিত্তি হবে লিঙ্গবৈষম্য নির্মূল করে নারী-পুরুষের সক্ষমতার পূর্ণ বিকাশ ও টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিতকরণ। এই উদ্দেশ্য সামনে রেখে এ বছর আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবসের কার্যক্রমকে ২৫ নভেম্বর থেকে ১০ ডিসেম্বর (বিশ্ব মানবাধিকার দিবস)—এই ১৬ দিনব্যাপী বিস্তৃত করা হয়েছে এবং বিশ্বজুড়ে নারী নির্যাতন নির্মূলকল্পে রাষ্ট্র, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, সুশীল সমাজ, মিডিয়া ও ব্যক্তি নাগরিক পর্যায়ে অঙ্গীকার ও কার্যক্রমকে দৃশ্যমান এবং সক্রিয় করতে আহ্বান জানানো হয়, যাতে এ ব্যাপারে বিশ্বজুড়ে ব্যাপক সাড়াজাগানো প্রচারণা ও সচেতনতা সৃষ্টি হয়। গত বছর ৭০টি দেশে এ কর্মসূচি পালিত হয় কমলা রঙের প্রতীক ব্যবহার করে—নিউইয়র্কের জাতিসংঘ ভবন, বিভিন্ন রাষ্ট্রদূত ভবন, এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিং, পানামা খালের প্রশাসন ভবন, মিসরের পিরামিড ইত্যাদি বিশ্বখ্যাত স্থাপনায় বিরাট আকারের কমলা রঙের পতাকা উত্তোলন করা হয়। কমলা রঙের প্রতীকের মাধ্যমে নারী নির্যাতনে জিরো টলারেন্স ব্যক্ত করা হয়। এবারও তাই বিশ্বজুড়ে কমলা রঙের প্রতীকের মাধ্যমে নারী নির্যাতনের বিপক্ষে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে জাতিসংঘের পক্ষ থেকে।
স্বাধীনতার চার দশকে অর্থনৈতিক ও মানবিক উন্নয়নে বাংলাদেশের অর্জন একটি বৈশ্বিক উদাহরণ (ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম, গ্লোবাল জেন্ডার গ্যাপ রিপোর্ট ২০১৫)। নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন ও অতিসম্প্রতি ভারতের রাষ্ট্রপতি বাংলাদেশের উন্নয়নকে দক্ষিণ এশিয়ার সেরা হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। বাংলাদেশের এই ঐতিহাসিক রূপান্তরে নারীর ভূমিকা ছিল অপরিসীম। বিশেষ করে মানব উন্নয়ন সূচকে যথা নারীশিক্ষার প্রসার, প্রজনন হার ও শিশুমৃত্যুর হার উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস, ডায়রিয়া নির্মূল, পুরুষের তুলনায় নারীর গড় আয়ুষ্কাল বৃদ্ধি ইত্যাদিতে নারীরাই নেতৃত্ব দিয়েছে। উপরন্তু ক্ষুদ্রঋণ সুচারুরূপে ব্যবহারের মাধ্যমে পরিবারের দারিদ্র্য হ্রাস এবং রপ্তানিমুখী শ্রমবাজারে বিপুলসংখ্যক নারীর অংশগ্রহণ অর্থনীতিতে নারীর অবদানের এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। চার দশকে দেশের খাদ্য উৎপাদন বেড়েছে তিন গুণ—কৃষক হিসেবে স্বীকৃত না হয়েও প্রায় ৯০ লাখ ১১ হাজার নারী (বিবিএস) কৃষি খাতে কাজ করছে, যার অধিকাংশই মজুরিবিহীন শ্রমিক।
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে নারীর অ-অর্থনৈতিক ও স্বীকৃতিহীন অবদান নিরূপণে সিপিডির গবেষণায় (ড. ফাহমিদা খাতুন) প্রতীয়মান হয়, নারীর সম্পন্ন করা কাজ, যা জাতীয় আয়ের অংশ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয় না, তা জিডিপির প্রায় ৭৬.৮ শতাংশের সমপরিমাণ। বাংলাদেশের নারী আজ আর অবরোধবাসিনী, কর্মহীন ও পরনির্ভর নয়। তা সত্ত্বেও পুরুষশাসিত সমাজের বিধিবিধান অনুযায়ী সম্পদে ও সুযোগে নারীর প্রবেশগম্যতা সীমিত হওয়ায় নারীর অধস্তন অবস্থান ও পুরুষের নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা সুদৃঢ় হয়, যা নারী নির্যাতনের প্রবণতা সৃষ্টি করে। বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান নারী নির্যাতনের আর একটি প্রধান কারণ হলো বাল্যবিবাহের রীতি। বিভিন্ন গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে, নারী-পুরুষের সমতা অর্জনের পথে বিরাট একটি বাধা বাল্যবিবাহ। প্রায় ৬৪ শতাংশ মেয়ের বিয়ে হচ্ছে আইনসম্মত বয়স ১৮ বছরের আগেই, যা মেয়েটির সক্ষমতা অর্জনের ও আত্মবিকাশের পথ রুদ্ধ করে তার অসহায়ত্ব বৃদ্ধি করে। ইউনিসেফ প্রতিবেদন (২০১৪) অনুযায়ী, দক্ষিণ এশিয়ায় কিশোরী নির্যাতনের শীর্ষে বাংলাদেশ। বিবিএস জরিপে (২০১২) দেখা গেছে, প্রায় ৮০ শতাংশ নারী তাদের স্বামী কর্তৃক মানসিক বা শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়ে থাকেন।
গৃহ পরিধির বাইরে পাবলিক স্পেসে শিক্ষা এবং কর্মক্ষেত্রেও কন্যাশিশু ও নারী উত্ত্যক্তকরণ, যৌন নির্যাতন, ধর্ষণ, হত্যা বা আত্মহত্যায় প্ররোচনার শিকার হচ্ছে। দেশে নারী ও শিশু নির্যাতন রোধে যথাযথ আইন প্রণীত হওয়া সত্ত্বেও নারীর প্রতি পারিবারিক ও সামাজিক নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি ও সুশাসনের অভাবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নারী নিরাপত্তা ও আইনি সুরক্ষা লাভে বঞ্চিত হয়।
বাংলাদেশে নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক প্রতিবাদ দিবস পালনের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত আমাদের সংবিধান প্রদত্ত (ধারা ১০) সর্বস্তরে ‘নারী-পুরুষের সমান অধিকার লাভের নিশ্চয়তা’ বাস্তবায়নের সুদৃঢ় পদক্ষেপ নেওয়া। নারী-পুরুষের মধ্যে সম্পদের বিরাট অসমতা নারীর অধস্তনতাও পুরুষের নিয়ন্ত্রকের ভূমিকাকে সুদৃঢ় করছে। যদিও নারী জিডিপিতে বিরাট অবদান রাখছে, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের ৭০ শতাংশ নারী ভূমিজ এবং আর্থিক সম্পদবঞ্চিত (প্রথম আলো)। অন্যদিকে নারীর ক্ষমতা অর্জনের মাধ্যমে ক্ষমতায়িত ও আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার আদায়ের সুযোগ সংকুচিত।
এই প্রেক্ষাপটে ২৫ নভেম্বর থেকে ১০ ডিসেম্বর ১৬ দিনব্যাপী দেশজুড়ে আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবসের দৃশ্যমান কর্মসূচি পালন করে সমগ্র বিশ্বের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করতে হবে। জাতিসংঘের মহাসচিবের আহ্বান অনুযায়ী দেশের বিশেষ স্থাপনাসমূহে কমলা রঙের পতাকা উত্তোলন, সরকারি, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, সুশীল সমাজ ও ব্যক্তি নাগরিক পর্যায়ে, বিশেষত মিডিয়ার পক্ষ থেকে নারীর প্রতি সহিংসতা নিরসনের পক্ষে জন–উদ্বুদ্ধকরণ কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে।
সরকারের পুনঃ অঙ্গীকার ব্যক্ত করতে হবে সব লিঙ্গবৈষম্যমূলক আইনের সংস্কার, সিডও সনদের পূর্ণ বাস্তবায়ন, নারী ও শিশু নির্যাতন রোধে বিদ্যমান আইনসমূহের যথাযথ প্রয়োগ ও দ্রুত বাস্তবায়নের পক্ষে সুশীল সমাজ ও নারী আন্দোলন কর্তৃক আলোচনা, বিতর্ক ও প্রচারণার মাধ্যমে তরুণ সমাজকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে দেশে নারী নির্যাতনের প্রতি জিরো টলারেন্সের মনোভাব সৃষ্টি করতে।
সালমা খান: অর্থনীতিবিদ, নারীনেত্রী।