সাংসদ যখন বেকারত্ব নিয়ে ভাবেন

বেকারত্ব সমস্যার সমাধান দিয়ে আলোচনায় সাংসদ রেজাউল করিম
ছবি: প্রথম আলো

সম্প্রতি একজন সাংসদ তাঁর বক্তব্যের জন্য আলোচনায় এসেছেন। তিনি দেশের বেকারত্ব সমস্যা নিয়ে যথেষ্ট উদ্বিগ্ন। চাকরিজীবী নারী ও পুরুষের মধ্যে বিয়ে বন্ধ করার জন্য একটি আইন প্রণয়নের দাবি জানিয়েছেন তিনি। তিনি মনে করছেন, এতে দেশের বেকারত্ব সমস্যার সমাধান হবে! ইউরোপ-আমেরিকা কিংবা এশিয়ার উন্নত দেশগুলোতে তো নারী-পুরুষ সবাই চাকরি করছেন। একে অপরকে বিয়েও করছেন। তাঁদের বেকারত্ব সমস্যা তো আমাদের মতো প্রবল নয়। তাঁদের তরুণ প্রজন্মকে তো লেখাপড়া শেষ করে দিনের পর দিন বেকার বসে থাকতে হয় না। তাহলে আমাদের কেন হয়?

মাননীয় সাংসদ তাহলে ঠিক কোন ধারণার বশবর্তী হয়ে এই বক্তব্য দিলেন? তাঁর কাছে কি কোনো তথ্য আছে? কিংবা কোনো পরিসংখ্যান? কোন কারণে আমাদের দেশে বেকার ছেলেমেয়ের সংখ্যা বেশি? তিনি তো আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে কথা বলতে পারতেন। দেশে পাবলিক কিংবা প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির সংখ্যা তো দিন দিন বাড়ছে। কিন্তু সে অনুযায়ী কি আমাদের শিক্ষার মান বাড়ছে? কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বাড়িয়ে আদৌ কি বেকারত্ব সমস্যার সমাধান করা সম্ভব?

কেন আমরা কারিগরি শিক্ষার দিকে মনোযোগ দিচ্ছি না? উন্নত বিশ্বে তো স্কুল পাস করে সবাই ইউনিভার্সিটিতে পড়তে যায় না। তাদের অনেকে ভকেশনাল কিংবা কারিগরি শিক্ষায় চলে যায়। এতে অল্প সময়ে হাতে-কলমে বাস্তবে প্রয়োগ করা যায়, এমন শিক্ষা নিয়ে তারা সহজেই চাকরিজীবনে প্রবেশ করতে পারে। এরপর চাকরিজীবনে প্রবেশ করে যদি মনে হয় আরও উচ্চশিক্ষার দরকার, তখন অনেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ভর্তি হয়। তারা তো ১৮ বছর হলেই চেষ্টা করে কাজে নেমে পড়তে।

আমরা কি চাকরির উপযোগী সঠিক শিক্ষাব্যবস্থার দিকে ঝুঁকছি, নাকি বড় বড় ডিগ্রি হাতে নিয়ে বেকার তৈরি করছি, সেটা নিয়ে তো সংসদে তর্কবিতর্ক হতে পারত। এই সব বড় ডিগ্রি আমাদের তরুণ প্রজন্মকে যেকোনো সাধারণ কাজ করতে নিরুৎসাহিত করছে কি না, সেটা নিয়েও তো সাংসদেরা তর্ক করতে পারতেন। এ ছাড়া বেকারত্ব সমস্যার আরও হাজারটা কারণ থাকতে পারে, যার হয়তো পরিসংখ্যান কিংবা বৈজ্ঞানিক ভিত্তি আছে। এসব কোনো কিছুর ধারেকাছে না গিয়ে তিনি বলে বসলেন বিয়ে বন্ধের কথা!

আমার ঠিক জানা নেই, সাংসদ হওয়ার পর তাঁদের কোনো সাধারণ প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় কি না। তাঁরা শুধু আইন প্রণয়ন কিংবা নীতিনির্ধারণ করেন না, দেশের অনেক মানুষ তাঁদের আদর্শ মানেন, নেতা মনে করেন। অনেক মানুষ তাঁদের দেখে অনুপ্রেরণা পান, তাঁদের কথায় প্রভাবিত হন। কিছু মৌলিক বিষয়ে বোধ করি প্রশিক্ষণ নেওয়া সময়ের দাবি। নইলে দেখা যাবে এ ধরনের মন্তব্য একবিংশ শতাব্দীতে এসেও আমাদের শুনতে হচ্ছে।

আবার তর্কবিতর্ক করতে গেলে মূল বিষয় বাদ দিয়ে একে অপরের সমালোচনা করতেই বেশি পছন্দ করেন তাঁরা। আপনি একটা সমাজকে কীভাবে পরিচালনা করতে চান, একটা দেশকে কীভাবে এগিয়ে নিতে চান—এই নিয়ে আপনার একধরনের মতাদর্শ থাকতেই পারে। অন্য কারও ভিন্ন মতাদর্শও থাকতে পারে। এ নিয়ে আপনারা হাটে, মাঠে, ঘাটে ও সংসদে হাজারটা তর্কবিতর্ক করতেই পারেন। কিন্তু সেটা ব্যক্তি পর্যায়ে নিয়ে যেতে হবে কেন?

ইংল্যান্ডকে বলা হয় গণতন্ত্রের পুণ্যভূমি। আপনারা কি কখনো ইংল্যান্ডের সাংসদদের বিতর্ক করতে দেখেছেন? আমি যখন ইংল্যান্ডে পিএইচডি করেছি, নিয়মিতই ওদের পার্লামেন্টের তর্কবিতর্কগুলো দেখতাম। তারা এক দল আরেক দলের সদস্যদের কতভাবেই না সমালোচনা করে। শুধু এক দল আরেক দলকে নয়, একই দলের এক সদস্য অন্য সদস্যদের মতামতকে হাজার রকমভাবে সমালোচনা করে বেড়ান। কারণ, তাঁরা সবাই সমাজ ও দেশকে নিজেদের দর্শন বা নিজেদের মতাদর্শের ভিত্তিতে এগিয়ে নিতে চান। সবাই সবার মতামত দেন, সমালোচনা করেন। এরপর যেটা গৃহীত হয়, সে অনুযায়ী দেশ পরিচালিত হয়।

ইংল্যান্ডের পার্লামেন্টের আলোচনা যদি আপনি একদিন দেখেন, আপনার হয়তো মনে হবে, তাঁরা মনে হয় একজন আরেকজনের ভয়াবহ শত্রু! অথচ যেই না রাজনৈতিক আলোচনা শেষ, গিয়ে দেখবেন তাঁরা সপ্তাহান্তে একই সঙ্গে ডিনার করছেন, হাসাহাসি করছেন কিংবা আড্ডা দিচ্ছেন। অর্থাৎ রাজনীতির বাইরের জীবনে কেউ কারও শত্রু নন। এই যে তাঁরা একে অপরের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে বেড়াচ্ছেন, এর জন্য অন্যরা কিন্তু এটাকে খারাপ চোখে দেখছেন না কিংবা বলে বেড়াচ্ছে না তাঁরা তো বেইমান!
কারণ, তাঁদের রাজনৈতিক দর্শন তো আর এতে পরিবর্তিত হচ্ছে না। যখনই আবার রাজনীতি নিয়ে আলোচনা শুরু করবেন, দেখা যাবে, শুরু হয়ে গেল বিতর্ক! অর্থাৎ রাজনৈতিক দর্শন এক জায়গায় আর ব্যক্তিগত জীবন আরেক জায়গায়।

অথচ আমাদের দেশে এক দল আরেক দলের মুখও দেখতে চায় না! আপনারা তো রাজনীতি করেন দেশের জন্য, নিজের জন্য নিশ্চয়ই নয়। আপনারা সংসদে যান দেশের আইন প্রণয়ন করার জন্য, নীতিনির্ধারণ করার জন্য। নিজেদের জন্য নিশ্চয়ই নয়। আপনাদের রাজনৈতিক মতাদর্শ আপনাদের কাছে থাকুক, আরও দৃঢ় হোক। কিন্তু সেটা ব্যক্তি পর্যায়ে যেতে হবে কেন? কেন আপনারা ব্যক্তিবিশেষকে আক্রমণ করে কথা বলেন? কেন আপনারা রাজনীতির বাইরে একজন আরেকজনের বন্ধু হতে পারেন না? কেন আপনারা রাজনীতি শেষে স্বাভাবিকভাবে একে অপরের সঙ্গে কথা বলতে পারেন না?

আপনাদের দেখেই না আপনাদের কর্মী-সমর্থকেরা শিখবেন। আপনারা যদি এমন সংস্কৃতি নিজেদের মধ্যে চালু করেন, তাহলে একসময় বাংলাদেশের সাধারণ মানুষও বুঝতে শিখবে রাজনৈতিক দর্শন ও মতাদর্শ যার যার কাছে। ব্যক্তিজীবন চলবে তার সাধারণ নিয়মে। জীবনের সব পর্যায়ে রাজনীতি নিয়ে আসার তো কোনো দরকার নেই।

লেখাটা শুরু করেছিলাম একজন সাংসদের সম্প্রতি দেওয়া একটা বক্তব্য নিয়ে। তিনি তো বেকারত্ব সমস্যা দূর করতে চান। এ জন্যই হয়তো এমন বক্তব্য দিয়েছেন। কিন্তু তিনি কি বেকারদের কারও মতামত নিয়ে দেখেছেন আদৌ তাঁরা এমনটা চান কি না? তিনি হয়তো এর ধারেকাছেও যাননি। এমন কোনো পরিসংখ্যান কি কোথাও আছে, যেখানে তরুণ প্রজন্ম বলেছে, চাকরিজীবী নারী-পুরুষের বিয়ে বন্ধে তাদের মত আছে? তাহলে সাংসদ এই কথা বললেন কেন? তাঁর এই কথার ভিত্তি কী? তিনি কেন রাজনীতি করেন? কাদের জন্য তিনি সংসদে গেছেন? তিনি তাহলে কাদের প্রতিনিধিত্ব করছেন?

ড. আমিনুল ইসলাম প্রভাষক, ক্রিয়েটিভিটি অ্যান্ড ইনোভেশন বিভাগ।
এস্তনিয়ান এন্ট্রাপ্রেনিউরশিপ ইউনিভার্সিটি। [email protected]