সাগর-রুনি হত্যা: তদন্ত যত পেছায় তত খুশি হয় খুনিরা

সাগর সরওয়ার ও মেহেরুন রুনি
সংগৃহীত

কিছুদিন পরপর আদালত থেকে একটি খবর পাওয়া যায়; ওই খবরে সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের সময় কতবার পেছানো হলো, সেই তথ্য থাকে। সব তথ্যই মোটামুটি এক, শুধু সংখ্যার পরিবর্তন হয়। মঙ্গলবারের সংখ্যাটি ছিল ৭৪, অর্থাৎ ৭৪ বারের মতো সময় নিয়েছে তদন্ত কর্তৃপক্ষ র‌্যাব। ‘র‌্যাব-পুলিশ চাইলে সব পারে’, এ কথা সাগর-রুনির হত্যাকারীদের খুঁজে বের করার বেলায় খাটেনি।

দীর্ঘ আট বছর ধরে চাঞ্চল্যকর একটি মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের সময় এভাবে পেছানোর নজির নেই। বিচারের দীর্ঘসূত্রতা হয় নানা কারণে, কিন্তু তদন্তের এই দীর্ঘসূত্রতা অনেকটাই নজিরবিহীন। মামলাটি যে ‘নো ক্লু, আইও ফজলু’—এমন পরিস্থিতির দিকে এগোচ্ছে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। তদন্তে ঘটনার সূত্র বা জড়িত ব্যক্তিদের খুঁজে না পেলে কিছুটা ব্যঙ্গ করে এটা বলা হয়।

তদন্তের ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ব্যর্থতার অন্যতম উদাহরণ হয়ে রইল সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যা মামলা। এ নিয়ে নিহত দুজনের পরিবার ও স্বজনেরা ক্ষুব্ধ ও ব্যথিত। দুই সাংবাদিকের বয়স্ক মায়েদের চোখের পানি শুকিয়ে এসেছে, তাঁরা এখন জীবনসায়াহ্নে। হত্যাকাণ্ডের সময় বাসায় ছিল সাগর-রুনির সাড়ে ৪ বছরের ছেলে মাহির সরওয়ার মেঘ, তার বয়স এখন ১২ পার হয়েছে।
মামলাটি ঘিরে দেশজুড়ে মানুষের আগ্রহও রয়েছে। সাংবাদিক পরিচয় পেলে অনেকেই জানতে চান, ওই মামলার অগ্রগতি কত দূর, আসলে কারা জড়িত? সাধারণ মানুষ বা স্বজনদের আগ্রহ থাকলেও সরকার, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এমনকি সাংবাদিকদের আগ্রহ বা আন্তরিকতা অনেকটাই কমে গেছে। সাংবাদিক ইউনিয়ন বা ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির অগ্রাধিকার তালিকায় বিষয়টি আর আছে বলে এখন মনে হয় না। অর্থাৎ এ ঘটনার বিচারের জন্য বাইরের কোনো চাপ সেই অর্থে নেই।

নৃশংস এই জোড়া খুনের বিচার না হওয়ার লজ্জা সবার আগে সাংবাদিকদের, যাঁরা তাঁদের দুই সহকর্মী হত্যার বিচার দাবিতে সেই অর্থে সোচ্চার হতে পারেননি। এ প্রসঙ্গ এলেই কিছু সাংবাদিক নেতার দিকে সন্দেহের তির ছোড়া হয়। আন্দোলন স্তিমিত করার জন্য তাঁদের দায়ী করা হয়। মানবাধিকার সংগঠনগুলোরও তৎপরতা নেই। এ ঘটনায় রাষ্ট্র, সরকার, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর লজ্জাও কম নয়। এত বড় রোমহর্ষক ও চাঞ্চল্যকর মামলার তদন্ত শেষ হলো না!


ঢাকার চাঞ্চল্যকর সগিরা মোর্শেদ খুনের মামলার প্রকৃত রহস্য উদ্‌ঘাটিত হয়েছে—ঘটনা ঘটেছিল ৩০ বছর আগে। জঙ্গিবিরোধী বেশির ভাগ অভিযান নিখুঁতভাবে সম্পন্ন হয়েছে। চট্টগ্রামের এসপিপত্নী মাহমুদা আক্তার মিতু, কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের ছাত্রী সোহাগী জাহান তনু এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক নুবান আহমেদ হত্যারও বিচার হয়নি। কিন্তু হত্যাকাণ্ডের জট খুলেছে, কী হয়েছিল সে সম্পর্কে মানুষ একটি ধারণা অন্তত পেয়েছে।

সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ড নিয়ে জল্পনা-কল্পনা কম হয়নি। ব্যক্তিগত সম্পর্ক, একে অপরকে খুন করা, তেল-গ্যাস ইস্যুসহ নানা বিষয় নিয়ে শুধু আলোচনাই হলো—কোনো সুরাহা হয়নি। গত মঙ্গলবার এ মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের দিন ধার্য করা হয়েছিল। তবে যথারীতি নির্ধারিত দিনে প্রতিবেদন দাখিল করতে পারেননি র‍্যাবের তদন্ত কর্মকর্তা। তাই ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মিল্লাত হোসেন আগামী ১৪ অক্টোবর প্রতিবেদন দাখিলের নতুন দিন ধার্য করেছেন।

২০১২ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি রাতে রাজধানীর পশ্চিম রাজাবাজারের ভাড়া বাসায় খুন হন মাছরাঙা টেলিভিশনের বার্তা সম্পাদক সাগর সরওয়ার এবং এটিএন বাংলার জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক মেহেরুন রুনি। পরদিন ভোরে তাঁদের ক্ষতবিক্ষত লাশ উদ্ধার করা হয়।

ঘটনাস্থলে গিয়ে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন বলেছিলেন, ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে হত্যার রহস্য উদ্‌ঘাটন করা হবে। ২০১২ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়েই মহীউদ্দীন খান আলমগীর ১০ অক্টোবরের মধ্যে সাগর-রুনির হত্যারহস্য উদ্‌ঘাটিত হবে বলে আশা প্রকাশ করেছিলেন। এরপর ৯ অক্টোবর ‘চমক দেওয়া’ সংবাদ সম্মেলনে একজনকে ধরতে ১০ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেন। পরে সেই ব্যক্তিকে ধরা হয়, কিন্তু ঘটনার রহস্য আর উন্মোচিত হয়নি।

সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের পর প্রথমে রাজধানীর শেরেবাংলা নগর থানার পুলিশ ও পরে গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) এই মামলার তদন্তভার পায়। দায়িত্ব পাওয়ার ৬২ দিনের মাথায় ২০১২ সালের ১৮ এপ্রিল হাইকোর্টে ব্যর্থতা স্বীকার করে ডিবি। এরপর আদালত র‍্যাবকে মামলার তদন্তের নির্দেশ দেন। সেই থেকে র‍্যাব মামলাটি তদন্ত করছে।

গত ৩ মার্চ অগ্রগতি প্রতিবেদনে র‌্যাব আদালতকে জানায়, ‘ডিএনএ পরীক্ষার প্রাথমিক তথ্যানুযায়ী সাগরকে বাঁধার জন্য ব্যবহৃত চাদর এবং রুনির টি-শার্ট হতে প্রাপ্ত নমুনা পরীক্ষণে প্রতীয়মান হয় উক্ত হত্যাকাণ্ডে কমপক্ষে দুজন অপরিচিত পুরুষ জড়িত ছিল।’ এ অপরিচিত অপরাধী শনাক্তকল্পে ডিএনএ পরীক্ষাকারী যুক্তরাষ্ট্রের দুটি ল্যাব কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ অব্যাহত রাখার কথা জানিয়েছে র‌্যাব।

এই পরিস্থিতি সম্পর্কে কথা হচ্ছিল সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহদীন মালিকের সঙ্গে। তিনি বলছিলেন, কেবল বিচারের দীর্ঘসূত্রতার কথা বলা হয়, কিন্তু তদন্তের দীর্ঘসূত্রতার বড় দৃষ্টান্ত হয়ে রইল সাগর-রুনির হত্যাকাণ্ড। পারিবারিক, পেশাগত বা ব্যবসায়িক—এসব কারণে সাধারণত এমন হত্যাকাণ্ড ঘটে থাকে। তাঁদের হত্যা করে কার লাভ এবং কে, কাকে ভাড়া করেছে—এসব প্রশ্নের সুরাহা এত দিনে যেহেতেু হয়নি, আর হবে বলেও মনে হয় না।

তাহলে কি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী হাল ছেড়ে দেবে? ডিবি তো বলেই দিয়েছিল, তারা এটি পারবে না। এরপর হাইকোর্ট বলেছেন র‌্যাবকে তদন্ত করতে। র‌্যাব বিষয়টি নিয়ে বিব্রত, এটি ধারণা করা যায়। কারণ সাংবাদিকেরা যখন বিষয়টি নিয়ে র‌্যাবের সঙ্গে যোগাযোগ করেন, তখন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বিব্রত ও বিরক্ত হন।


র‌্যাব যদি এই তদন্ত শেষ না করতে পারে, তাহলে হাইকোর্টকে তা জানাতে পারে। দেশে আরও তদন্ত সংস্থা রয়েছে। পিবিআই, সিআইডিসহ বিভিন্ন সংস্থা উল্লেখযোগ্য তদন্ত সম্পন্ন করেছে। তারাও চেষ্টা করে দেখতে পারে। আর যদি রাজনৈতিক সদিচ্ছার বিষয় যুক্ত থাকে, সেটিও বলে দেওয়া ভালো। তবে হত্যার বিচার একমাত্র খুনিরা ছাড়া রাষ্ট্র, সরকার ও প্রত্যেক নাগরিক চাইবে।

এটা বিশ্বাস করতে চাই না যে সাগর-রুনি হত্যায় জড়িত খুনিদের খুঁজে পাওয়া অসম্ভব। অত্যাধুনিক প্রযুক্তির যুগে কোনো ঘটনাই আড়াল করে রাখা যায় না। জঙ্গিবাদ দমনে সরকারের সদিচ্ছা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকার পাশাপাশি প্রযুক্তিই কিন্তু পথ দেখিয়েছে। সেই সদিচ্ছা ও প্রযুক্তির সমন্বয়ে সাগর-রুনি হত্যার তদন্তও দ্রুত শেষ হবে—এটাই সবার প্রত্যাশা।

শরিফুজ্জামান: সাংবাদিক।
[email protected]