‘সাটিকাপ’ মেরে থাকা বুদ্ধিজীবী ও সাধারণের চিন্তার মুক্তি

চট্টগ্রামের হাটহাজারী ও রাউজানে যাঁরা ‘মানবিক বাজার’ চালু করেছেন, তাঁরা প্রত্যন্ত গ্রামের।ছবি : প্রথম আলো

প্রতিটি সমাজে বুদ্ধিজীবীদের একটা ন্যায়সংগত ভূমিকা থাকবে, এটাই প্রত্যাশিত। চিন্তার সৃষ্টি ও মুক্তিতে তাঁরা পথ দেখাবেন, নেতৃত্ব দেবেন—এ রকম আশা সাধারণত করা হয়। আমাদের সমাজে বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা নিয়ে তর্ক-বিতর্ক সব সময় কমবেশি হয়েছে। বুদ্ধিজীবীরাও নানা বিষয়ে তাঁদের মতামত দিয়েছেন, আলোচনা করেছেন। মূলত এসব মতামত, আলোচনা ঘিরেই পরবর্তী সময়ে পক্ষে-বিপক্ষে নানা প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে।

কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা একেবারেই নিষ্প্রভ। সমাজে কোনো বুদ্ধিজীবী আদৌ আছেন কি না, থাকলেও তাঁরা কোন পাড়ায় বাস করেন, তা একটা জিজ্ঞাসা বটে। কারণ, বর্তমান সময়ে রাষ্ট্র, সমাজ ও ব্যক্তিজীবন কঠিন সংকট ও নানা চড়াই-উতরাই পার করলেও বুদ্ধিজীবীদের এ ক্ষেত্রে কোনো ভূমিকা দৃশ্যমান নয়। আর যেটুকু দৃশ্যমান, তা বরং দৃশ্যের বাইরে থাকলেই ভালো হতো বলে অনেকের অভিমত।

সমাজে বুদ্ধিজীবী কারা, কোন শ্রেণির মানুষ, এর সংজ্ঞা নির্ধারণ করেছে জাতির জ্ঞান ও মননের চর্চাকেন্দ্র হিসেবে খ্যাত বাংলা একাডেমি। তাদের প্রকাশিত ‘শহীদ বুদ্ধিজীবীকোষ’ গ্রন্থে বলা হয়েছে, ‘বুদ্ধিজীবী অর্থ লেখক, বিজ্ঞানী, চিত্রশিল্পী, কণ্ঠশিল্পী, সকল পর্যায়ের শিক্ষক, গবেষক, সাংবাদিক, রাজনীতিক, আইনজীবী, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, স্থপতি, ভাস্কর, সরকারি ও বেসরকারি কর্মচারী, চলচ্চিত্র ও নাটকের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি, সমাজসেবী ও সংস্কৃতিসেবী। যারা দেশের স্বাধীনতাকে ভিত্তি করে দেশ ও দেশের মানুষের কল্যাণের জন্য তাদের বিচার, বুদ্ধি ও বিচক্ষণতা দিয়ে দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষার্থে কাজ করে।’ অপরদিকে বাংলা একাডেমি প্রকাশিত অভিধানে ‘বুদ্ধিজীবী’ বলতে তাদের বোঝানো হয়েছে, ‘যাঁরা সমাজ ও সংস্কৃতিসচেতন এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানে দক্ষ, সুশিক্ষিত মানুষ; যাঁরা বুদ্ধির বলে বা বুদ্ধির কাজ দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করে থাকেন।’

দুটি সংজ্ঞাই ঠিক আছে। তবে সংজ্ঞার নিক্তিতে বুদ্ধিজীবী মাপা যাবে না। জ্ঞানী লোকমাত্রই বুদ্ধিজীবী হতে পারেন না। যিনি জ্ঞানের চর্চা করেন, সাধারণের মধ্যে কেবল ছড়িয়ে দেন না, তাঁদের চিন্তাজগতে পরিবর্তন আনতে সচেষ্ট হন, তাঁকে বুদ্ধিজীবী বলা যেতে পারে। গত বছর সাংবাদিক, লেখক মাহবুব মোর্শেদ বাংলাদেশে মাত্র ৬১ জন বুদ্ধিজীবীকে খুঁজে পেয়েছিলেন। তাঁদের নাম তিনি ফেসবুকে প্রকাশ করেছিলেন, যা বেশ আলোচনার জন্ম দিয়েছিল। আমাদের বিশ্বাস, দেশে বুদ্ধিজীবীর সংখ্যা এত কম হতে পারে না। এক লাখ, দুই লাখ না হলেও হাজার পঞ্চাশেক বুদ্ধিজীবী অন্তত থাকা উচিত বা রয়েছে বলে ধরে নেওয়া যায়।

দেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির পাগলা সারমেয় ঘেউ ঘেউ করেই চলেছে। চারদিকে যেন দরিদ্র মানুষের অসহায়ত্বের নির্মম প্রদর্শনী। গ্যাস, পানির দাম বাড়ানোর জন্য বৈঠক চলছে। আমলাদের এক কলমের খোঁচায় শিগগিরই হয়তো বেড়েও যাবে। এ নিয়ে আমাদের বুদ্ধিজীবী মহলের কোনো উচ্চবাচ্য চোখে পড়ে না। ষাটের দশকের উজ্জ্বল প্রগতিবাদী সমাজ এখনকার তরুণদের জন্য যেন সন্দেহপ্রবণ মনের কষ্টকল্পনা।

সংখ্যা যা-ই হোক, এই বুদ্ধিজীবীরা কোথায় কীভাবে আছেন, কেউ জানে না। অফলাইন, অনলাইন, কোথাও তেমন দৃশ্যমান নন তাঁরা। অথচ বুদ্ধিজীবীদের কাজ ঝিমিয়ে পড়া গোষ্ঠীকে ধাক্কা দিয়ে জাগিয়ে তোলা, অসচেতন মানবজমিনে সচেতনতার বীজ বপন করা। কিন্তু তাঁরা সে দায়িত্ব পালন করছেন তো না-ই, উল্টো নিজেরাই যেন ‘সাটিকাপ’ মেরে (লুকিয়ে থাকা) আছেন! তবে কোনো কোনো বুদ্ধিজীবী নীরবেও কাজ করেন। নীরবে করা কাজ একসময় সরবে সামনে আসে।

দেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির পাগলা সারমেয় ঘেউ ঘেউ করেই চলেছে। চারদিকে যেন দরিদ্র মানুষের অসহায়ত্বের নির্মম প্রদর্শনী। গ্যাস, পানির দাম বাড়ানোর জন্য বৈঠক চলছে। আমলাদের এক কলমের খোঁচায় শিগগিরই হয়তো বেড়েও যাবে। এ নিয়ে আমাদের বুদ্ধিজীবী মহলের কোনো উচ্চবাচ্য চোখে পড়ে না। ষাটের দশকের উজ্জ্বল প্রগতিবাদী সমাজ এখনকার তরুণদের জন্য যেন সন্দেহপ্রবণ মনের কষ্টকল্পনা।

আরও পড়ুন

এই ঢাকা শহরে যেদিন লাখ লাখ টাকা খরচ করে একটি বিয়ের অনুষ্ঠানে প্রতিবেশী দেশ থেকে বিনোদনপটিয়সীদের উড়িয়ে আনা হয়, সেদিন সাশ্রয়ী দামে কেজি পাঁচেক চাল, এক কেজি ডালের জন্য তীব্র রোদের মধ্যে তিন-চার ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকেন আমাদের কোনো মা বা বোন। বৈষম্যভরা আমাদের সমাজের এ এক করুণ চিত্র। অথচ এ নিয়ে আলোচনা কোথায়?

সমাজে নানা মোড়কে, আবরণে নারীর প্রতি জুলুম চলছেই। গরিবের বস্তিঘর থেকে শুরু করে উচ্চবিত্তের ড্রয়িংরুমে এখন নয়া নয়া ব্র্যান্ডের মাদকের উপস্থিতি। দেশের সড়কগুলো নিয়ে নতুন করে বলার কিছু নেই। আজ এ মায়ের বুক খালি হচ্ছে, তো কাল ও মায়ের। পরশুদিন হয়তো মা-ই চলে যাচ্ছেন। জনগণের ভোটাধিকার, বাক্‌স্বাধীনতা, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপব্যবহারের মতো বড় বড় বিষয় তো রয়েছেই। বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণায় বিনিয়োগ কম, রাজনৈতিক লেজুড়দের শনৈঃশনৈঃ উন্নতি। গুণের কদর কম, চারদিকে কেবল দেখনদারি। মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম চেতনা সাম্প্রদায়িকতা ও বৈষম্যমুক্ত, সাম্যের সমাজ গড়া থেকে অনেক পিছিয়ে দেশ। সব মিলিয়ে অস্থিরতায় সমাজের এই মাথা গরম।

এই যখন অবস্থা, তখন বুদ্ধিজীবী, শিক্ষিত সমাজের একটা ভূমিকা থাকবে, এটা জন-আকাঙ্ক্ষা। কিন্তু হতাশার কথা হলো, সেই ভূমিকায় তাঁরা নেই।

বুদ্ধিজীবীকে যদি ভাবনার স্বকীয়তা বজায় রাখতে হয়, তবে তাঁকে অবশ্যই রাষ্ট্রকাঠামো থেকে নিরাপদ দূরত্বে থাকতে হবে, এ কথা বলে গেছেন চিন্তাবিদ জ্যঁ পল সার্ত্র। দার্শনিক এডওয়ার্ড সাঈদও বলেছেন, বুদ্ধিজীবী এমন একজন ব্যক্তি, যিনি স্বাধীনতা ও ন্যায়বিচারের স্বার্থে একটি সুচিন্তিত মতামত ও দৃষ্টিভঙ্গি জনগণের সামনে তুলে ধরেন। কোনো প্রতিবন্ধকতাই সত্য প্রকাশ থেকে তাঁকে কক্ষচ্যুত করতে পারে না।
সেই রকম মানুষ কোথায় এই সমাজে?

বুদ্ধিজীবীদের একটি অংশ আছে ক্ষমতাবান গোষ্ঠীর সভাকবি হয়ে। প্রভাবশালীদের হাতে দ্রাক্ষারস পান করেই তাদের জীবনের সব সার্থকতা। কিছু আছে, তাদের প্রধান কাজ স্বজনতোষণ। নিজেদের বলয়ের মধ্যে থাকা গোষ্ঠীর পরস্পর পৃষ্ঠমাজন। চিরকালেই ছিল এই সব বুদ্ধিজীবী। এদের কাজকর্মে বিরক্ত হয়ে আহমদ ছফা ১৯৭২ সালে বলেছিলেন, ‘একাত্তরে বুদ্ধিজীবীরা যা বলেছিলেন, তা শুনলে বাংলাদেশ স্বাধীন হতো না। আর এখন যা বলেন, তা শুনলে বাংলাদেশ স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে দাঁড়াতে পারবে না।’ রুশ বিপ্লবের নেতা ভ্লাদিমির লেনিন ম্যাক্সিম গোর্কিকে লেখা চিঠিতে বুর্জোয়া শ্রেণির বুদ্ধিজীবীদের তুলনা করেছিলেন ‘বিষ্ঠা’র সঙ্গে। বলেছিলেন, ‘এরা পুঁজির পা চাটা, এরা জাতির মগজ নয়, জাতির বিষ্ঠা।’

দুই.
এই যখন অবস্থা, তখন আমরা সাধারণ মানুষের মধ্যেই একধরনের চিন্তার মুক্তি দেখতে পাচ্ছি। তাদের চিন্তার আকাশে সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের মেঘেরা ভেসে বেড়াচ্ছে যেন। চট্টগ্রামের হাটহাজারী ও রাউজানে যাঁরা ‘মানবিক বাজার’ চালু করেছেন, তাঁরা প্রত্যন্ত গ্রামের। কেউ তাঁদের শিখিয়ে দেয়নি বা করতে বলেনি। তাঁরা চারপাশে ‘মানবিকতার বিপর্যয়’ দেখেই ‘মানবিক বাজার’ গঠনের উদ্যোগ নিয়েছেন। এ উদ্যোগের ফলে আশপাশের অতিদরিদ্র মানুষও বিনা পয়সায় কিছু আনাজপাতি পাচ্ছে।

কিংবা নারায়ণগঞ্জের সেই জনপ্রতিনিধি, যিনি হাত লাগিয়ে করোনায় মৃত ব্যক্তিদের লাশ দাফন, সৎকার করেছেন; যখন পিতা-মাতার মরদেহের কাছে যেতে চাননি কোনো সন্তানও। চট্টগ্রামের সেই সংগঠন, যারা কয়েক হাজার লাশ দাফন করেছে, তীব্র শ্বাসকষ্টে ভুগতে থাকা মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছে অক্সিজেন সিলিন্ডার।

আরও পড়ুন

এ রকম বহু উদাহরণ দেওয়া যায়। আমি একবার ঢাকার কামরাঙ্গীরচরে একটি গণপাঠাগারে গিয়েছিলাম গবেষণার কাজে। সেখানে বই নিয়ে পাঠকেরা আর ফেরত দেন না। সাধারণ সম্পাদক, যিনি একজন ইটবালুর ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, তাঁকে এ বিষয়ে প্রশ্ন করলে ম্যাট্রিক পাস না করা এই ভদ্রলোক বলেছিলেন, ‘আমরা বিশ্বাস করি, যাঁরা বই নিয়ে আর ফেরত দিচ্ছেন না, তাঁরা একদিন ঠিকই ফেরত দেবেন। বই পড়ার অভ্যাস তৈরি হওয়ার পর তাঁদের মধ্যেই একধরনের বোধ তৈরি হবে যে বই নিয়ে ফেরত না দেওয়া অন্যায়। এর পর থেকে তাঁরা ঠিকই বই ফেরত দেবেন।’

এই ঘটনাগুলোকে কি সাধারণ মানুষের চিন্তার মুক্তি হিসেবে ব্যাখ্যা করা যায়? ইতালির বামপন্থী বুদ্ধিজীবী আন্তনিও গ্রামসি কারাগারে বসে লিখে গেছেন, সব মানুষই বুদ্ধিজীবী, কিন্তু সমাজে সবার ভূমিকা বুদ্ধিজীবীর নয়; অর্থাৎ কেবল মোটা মোটা বই পড়েই বুদ্ধিজীবী হওয়া যাবে, ব্যাপারটা তা নয়। হাটহাজারী, রাউজানের ওই উদ্যোক্তারা, নারায়ণগঞ্জের জনপ্রতিনিধি, কামরাঙ্গীরচর চরের সংগঠকই প্রকৃত বিচারে বুদ্ধিজীবী। সমাজের মানুষও তাঁদের স্বীকৃতি দিচ্ছে। সমাজে এ ধরনের বুদ্ধিজীবীদের কাজ করার পরিসর আরও বাড়ানোর সুযোগ তৈরি করতে হবে। এখন মানুষের বিপদে সাটিকাপ মারা বুদ্ধিজীবীরা কী করবেন, তাঁরাই ঠিক করুন।

কাজী আলিম-উজ-জামান প্রথম আলোর উপবার্তা সম্পাদক।
ই-মেইল: [email protected]