সাতকানিয়ায় কে আওয়ামী লীগ, কে জামায়াত

সদ্য সমাপ্ত ইউপি নির্বাচনে চট্টগ্রামের সাতকানিয়ায় প্রকাশ্যে আগ্নেয়াস্ত্র হাতে মহড়া
ফাইল ছবি

সাম্প্রতিক ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনে চট্টগ্রামের সাতকানিয়া উপজেলায় প্রকাশ্যে আগ্নেয়াস্ত্র হাতে মহড়া দিতে দেখা গেছে কয়েকজন প্রার্থীর কর্মী-সমর্থককে। গ্রামীণ জনপদে উদ্যত অস্ত্র হাতে ধাবমান দুর্বৃত্তদের ছবি প্রথম আলোসহ বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। এসব ছবি দেশের সাধারণ মানুষকে ভীত ও বিস্মিত করলেও সাতকানিয়া সম্পর্কে যাঁদের পূর্বধারণা আছে, তাঁরা অনেকেই এটিকে প্রায় ‘স্বাভাবিক’ ঘটনা হিসেবেই নিয়েছেন।

স্বাভাবিক কেন? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পেতে হলে আমাদের ফিরে তাকাতে হবে ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে প্রায় বছরজুড়ে চলা ঘটনাবলির দিকে। ২০১৩ সালে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মৃত্যুদণ্ড (আপিলের পর দণ্ডমাত্রা হ্রাস পায়) ঘোষিত হলে দেশের যে কয়টি অঞ্চলে ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল, সাতকানিয়া ছিল তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা। পুলিশসহ ছয়জনের প্রাণহানি, পাঁচ শতাধিক গাড়ি ভাঙচুর, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে হামলা, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বাড়িঘর ও উপাসনালয়ে হামলাসহ হেন কোনো ঘটনা নেই, যা সেখানে ঘটেনি। সেই সময়ের একটি ঘটনা প্রকৃতিপ্রেমিকেরা কিছুতেই ভুলতে পারবেন না। বৈদ্যুতিক করাত দিয়ে স্বল্প সময়ের মধ্যে কী নির্মম নৈপুণ্যে রাস্তার দুপাশের শত শত বিশাল গাছ কেটে ধুলায় লুটিয়ে দিয়েছিল দুর্বৃত্তরা!

চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক সে সময় বন্ধ ছিল ৯ থেকে ১০ দিন। ঢাকা ও চট্টগ্রামের ৩০ থেকে ৪০ হাজার পর্যটক আটকা পড়েছিলেন কক্সবাজার ও সেন্ট মার্টিনে। সবচেয়ে বিপদে পড়েছিলেন সীমিত সামর্থ্যের মানুষ, যাঁরা নির্দিষ্ট সময়ের হিসাব কষে টাকাকড়ি নিয়ে ভ্রমণে গিয়েছিলেন। সে সময় কক্সবাজারের জেলা প্রশাসন ও নাগরিক সমাজ, সর্বোপরি হোটেল-মোটেলের স্বত্বাধিকারীরা নানা উদ্যোগ নিয়ে এই পর্যটকদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। বিনা মূল্যে বা স্বল্পমূল্যে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন তাঁরা। এমনকি কপর্দকহীন কিছু পর্যটকের জন্য লঙ্গরখানা পর্যন্ত খুলতে হয়েছিল তখন। ট্রলারে কক্সবাজার থেকে আটকে পড়া পর্যটকদের সমুদ্রপথে চট্টগ্রামে পাঠানোর ব্যবস্থাও নেওয়া হয়েছিল।

কারা চালিয়েছিল তাণ্ডব? কোনো সংশয় না রেখেই বলা চলে দলীয় নেতার মৃত্যুদণ্ডের প্রতিবাদে এই অরাজকতা সৃষ্টি করেছিলেন জামায়াত-শিবিরের কর্মী-সমর্থকেরা। তা ছাড়া সাতকানিয়া তাঁদের দুর্গ হিসেবে পরিচিত। ১৯৭৩ সালের পর এখানকার সংসদীয় আমলে আওয়ামী লীগ কখনো জয় পায়নি। ১৯৯১ সালের পর থেকে তিনবার জামায়াত ও একবার বিএনপি প্রার্থী এখানে জয় লাভ করেন। সুতরাং জামায়াত-শিবিরের এ ঘাঁটিতে যাবতীয় হিংসাত্মক কার্যক্রমের দায় জামায়াতের কাঁধেই বর্তায়। সেই সময় বহু আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীর বাড়িঘর, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানেও হামলা হয়েছিল। সরকারি দলের নেতা-কর্মীরা পালিয়ে বেড়াচ্ছিলেন এবং জামায়াতের ভয়ে মামলা করার সাহস পর্যন্ত পাননি।

সাম্প্রতিক ইউপি নির্বাচনে উঠে এসেছে সেই চিত্রই। এ নির্বাচনে ১৬টি চেয়ারম্যান পদে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় চারজনসহ মোট ১২টি আসনে জয় পেয়েছেন আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা। বাকি দুটিতে বিদ্রোহী (আওয়ামী লীগ) ও দুটি আসনে স্বতন্ত্র (বিএনপি) প্রার্থীরা জয়ী হয়েছেন। জামায়াতের ঘাঁটিতে আওয়ামী লীগের প্রবল বাহুবলের প্রদর্শন ও নির্বাচনে অধিকাংশ আসন জিতে নেওয়ার ঘটনা বিস্ময়ের জন্ম দিয়েছে সন্দেহ নেই, তবে তার কার্যকারণ সূত্রটিও পরিষ্কার এলাকাবাসীর কাছে।

সেই দুঃসহ স্মৃতিচারণার পর এ প্রশ্ন মনে আসা স্বাভাবিক, সাম্প্রতিক কালে ইউপি নির্বাচনে যারা প্রকাশ্যে অস্ত্র হাতে ভোটারদের ভয়ভীতি দেখিয়েছে, তারা কারা? কোন দলের অনুগত? যদি তারা আওয়ামী লীগ সমর্থক হয়, তাহলে এত দিন তারা কোথায় ছিল? ২০১৩-১৪ সালে সামান্য প্রতিরোধের সাহস-সামর্থ্য যাদের ছিল না, তারা এখন এত শক্তিধর হয়ে উঠল কী করে? আর যদি এই অস্ত্রধারীরা জামায়াতের সমর্থক হয়, তাহলে তারা এখন কার হয়ে লড়ছে?

এসব বিষয়ে উত্তর দেওয়ার কেউ নেই। কারণ, স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী-সমর্থক যাঁরা দীর্ঘদিন পিঠে কুলো বেঁধেও দলীয় আনুগত্য থেকে বিচ্যুত হননি, তাঁরা এখন হতাশ। সাতকানিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি মোজাম্মেল হকের কথায় অবশ্য কিছুটা ধারণা পাওয়া গেল। তাঁর মতে, ‘সাঈদীর রায়ের পর জামায়াত শিবিরের যারা সহিংসতায় জড়িত হয়ে পড়েছিল, তাদের অনেকেই এখন আওয়ামী লীগের স্থানীয় কোনো কোনো নেতার ছত্রচ্ছায়ায় আছে। তাদেরই কেউ কেউ এবারের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বা বিদ্রোহী প্রার্থীর পক্ষে সহিংসতায় জড়িয়ে পড়েছে।’ অর্থাৎ অন্তত কর্মী-সমর্থক পর্যায়ে এখানে আওয়ামী লীগ ও জামায়াতকে আলাদা করা কঠিন হয়ে পড়েছে এখন।

আরও পড়ুন

সাম্প্রতিক ইউপি নির্বাচনে উঠে এসেছে সেই চিত্রই। এ নির্বাচনে ১৬টি চেয়ারম্যান পদে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় চারজনসহ মোট ১২টি আসনে জয় পেয়েছেন আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা। বাকি দুটিতে বিদ্রোহী (আওয়ামী লীগ) ও দুটি আসনে স্বতন্ত্র (বিএনপি) প্রার্থীরা জয়ী হয়েছেন। জামায়াতের ঘাঁটিতে আওয়ামী লীগের প্রবল বাহুবলের প্রদর্শন ও নির্বাচনে অধিকাংশ আসন জিতে নেওয়ার ঘটনা বিস্ময়ের জন্ম দিয়েছে সন্দেহ নেই, তবে তার কার্যকারণ সূত্রটিও পরিষ্কার এলাকাবাসীর কাছে।

সাতকানিয়ায় আওয়ামী লীগের পরিবর্তনটা আসে ২০১৪ সালের নির্বাচনে জামায়াত ঘরানার ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত আবু রেজা মোহাম্মদ নদভীকে মনোনয়ন দেওয়ার পর। তিনি জামায়াতের কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য ও একাধিকবার সংসদ নির্বাচনে জামায়াতের প্রার্থী মরহুম মুমিনুল হকের জামাতা। আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে নদভী পরপর দুই দফায় সাংসদ নির্বাচিত হন। তাঁর স্ত্রী ও এককালের জামায়াতের অঙ্গসংগঠন ইসলামী ছাত্রী সংস্থার সদস্য রিজিয়া রেজা চৌধুরী বর্তমানে কেন্দ্রীয় মহিলা আওয়ামী লীগের সদস্য। এই ধারাবাহিকতার ষোলোকলা পূর্ণ হয়েছে এবার চরতী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান পদে মরহুম মুমিনুল হকের ছেলে ও আবু রেজা মো. নদভীর শ্যালক মো. রুহুল্লাহকে আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন দেওয়ার পর। তৃণমূল থেকে পাঠানো প্রস্তাবিত প্রার্থীর তালিকায় তাঁর নাম ছিল না। কিন্তু কেন্দ্র থেকে সরাসরি মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে তাঁকে এবং জামায়াত অধ্যুষিত এ এলাকায় নির্বাচিত হয়েছেন এই নব্য আওয়ামী লীগার মো. রুহুল্লাহ।

সবকিছু দেখেশুনে মনে হয়, সাতকানিয়া আছে সাতকানিয়াতেই, শুধু যা কিছু রূপান্তর বা পরিবর্তন, তা ঘটে গেছে এখানকার আওয়ামী লীগে।

  • বিশ্বজিৎ চৌধুরী প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক, কবি ও সাহিত্যিক

    [email protected]