সাদা এখন আর রং নয়, সাদা এখন মতাদর্শের নাম

হামিদ দাবাশি
ছবি: টুইটার থেকে সংগৃহীত

যুক্তরাষ্ট্রে নতুন করে বর্ণ এবং বর্ণবাদ ইস্যুতে জনগণের মধ্যে আলোচনা-সমালোচনা বাড়ছে। বর্ণ এবং বর্ণবাদের অর্থ যেসব আমেরিকান নাগরিক ভালোভাবে বোঝে, তাদের মধ্যেও এখন এ পরিভাষার অর্থ সম্পর্কে বিভ্রান্তি দেখা যাচ্ছে। তাদের অনেকের মধ্যে এ ভাবনা ঢুকে যাচ্ছে, যাদের শরীরের চামড়ার রং সাদা, অর্থাৎ শারীরিকভাবে শ্বেতাঙ্গ, তাদের সবার আমেরিকার বর্ণবাদের ইতিহাসের জন্য অনুতপ্ত হওয়া উচিত।

কিন্তু এটি একটু ভুল নৈতিক বিচার। কোনো ব্যক্তির চেহারার দিকে তাকিয়ে শুধু তার গায়ের চামড়ার রং বিবেচনায় নিয়ে তার চরিত্র সম্পর্কে সিদ্ধান্তে আসা চরম বর্ণবাদী আচরণ। শুধু শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদীরা এ ধরনের ভাষ্য প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে নিজেদের কায়েমি স্বার্থ প্রতিষ্ঠা করতে চায়। তারা ‘সাদা’ বলতে শুধু সাদা গাত্রবর্ণকে বোঝায় না, ‘সাদা’কে তারা বর্ণভিত্তিক শ্রেষ্ঠত্ববাদী মতাদর্শ হিসেবে দেখে এবং সেই মতাদর্শ মরিয়া হয়ে প্রচার করে থাকে।

শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদীদের মধ্যে বর্তমানে ক্রিস্টোফার রুফোকে সবচেয়ে কট্টর প্রতিক্রিয়াশীল প্রোপাগান্ডিস্ট হিসেবে ধরা হয়। আমেরিকান শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদীদের অন্যতম এই প্রতিনিধি গায়ের রং সাদা এমন মার্কিন নাগরিকদের মধ্যে এ প্রচার চালিয়ে থাকেন যে সাদা চামড়ার মানুষ হওয়ার জন্য তাদের সবাইকে দোষারোপ করা হচ্ছে। এই শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদীদের মূল উদ্দেশ্য সাদা চামড়ার মানুষের মনের মধ্যে এমন ভয় ঢুকিয়ে দেওয়া, যাতে তাদের সারাক্ষণ মনে হয় অশ্বেতাঙ্গরা তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী এবং অশ্বেতাঙ্গরা তাদের বর্ণভিত্তিক ন্যায়বিচার প্রশ্নে তাদের অপরাধীর কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে থাকে।

এ ধরনের অনুভূতি পরস্পরের প্রতি অবিশ্বাস ও বিদ্বেষ বাড়িয়ে দেয়। এ ক্ষেত্রে ‘সাদা’ বলতে পরিষ্কারভাবে একটি মতাদর্শকে বোঝানো হয়ে থাকে। এ ‘সাদা’ মতাদর্শের মূল ভাব হলো আপনি তখনই যথার্থ ‘হোয়াইট’ বা ‘সাদা’ হতে পারবেন, যখন ‘ব্ল্যাক’, ‘ব্রাউন’, ‘রেড’, ‘ইয়েলো’ ইত্যাদি বর্ণের মানুষ হিসেবে পরিচিত লোকদের চেয়ে ‘হোয়াইট’ মানুষ অনেক ইস্যুতে অগ্রাধিকার পাবে—এমন ধারণাকে আপনি যখন কায়মনে স্বীকার করে নেবেন।

সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রে সেই গায়ের রংভিত্তিক শ্রেষ্ঠত্ব দাবির দিকে ঝুঁকেছে শ্বেতাঙ্গদের একটি উগ্র অংশ। কিন্তু সাদা ত্বকের বহু মানুষ আছে, যারা গায়ের রঙের ভিত্তিতে নিজেদের শ্রেষ্ঠ ও অন্যদের তুচ্ছ মনে করতে ঘৃণাবোধ করে। এসব মানুষের কাছে ‘সাদা’ একটি রং। তাদের কাছে ‘সাদা’ মানে কোনো আদর্শ নয়

সেই অর্থে ‘সাদা’ শব্দটি বর্ণবাদভিত্তিক শ্রেষ্ঠত্ব দাবি করার আদর্শিক নিবন্ধন হিসেবে কাজ করছে। মানবজাতির মধ্যে কেউ ‘সাদা’, ‘কালো’, ‘লাল’ ‘হলুদ’ হিসেবে জন্ম নেয় না। ক্ষমতাবানেরা নিজেদের শাসনকে সংহত করতে মানুষকে বিভিন্ন শ্রেণিতে বিভক্ত করার জন্য যতগুলো অনুষঙ্গ বেছে নেয়, গায়ের চামড়ার রং তার একটি। পূর্ব এশীয়দের বলা হয়, ‘ইয়েলো’, পশ্চিম এশীয়দের বলা হয় ‘ব্রাউন’, আমেরিকান আদিবাসীদের বলা হয় ‘রেড’, আফ্রিকানদের ডাকা হয় ‘ব্ল্যাক’ বলে। এরা সবাই ককেশীয় ‘সাদা’কে ঘিরে রেখেছে। এদের মধ্যে ‘সাদা’ সবচেয়ে অভিজাত হিসেবে নিজেকে দাবি করে এসেছে এবং অন্যরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তা প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে মেনে নিয়েছে। এর মাধ্যমে ইউরোপীয়রা নিজেদের বর্ণবাদভিত্তিক শ্রেষ্ঠত্বের কথা প্রচার করেছে এবং উত্তর আফ্রিকা ও অস্ট্রেলিয়ায় উপনিবেশ গড়ে তোলায় এ মতাদর্শ তাদের সহায়তা করেছে।

ইউরোপীয়দের উপনিবেশের সময় ইউরোপকে ‘আলোকিত সমাজ’ এবং তাদের জীবনধারাকে ‘বিজ্ঞানভিত্তিক’ বলে যে প্রচার করা হতো, তার পেছনে মূল উদ্দেশ্য ছিল তাদের শ্রেষ্ঠত্ব সবার কাছ থেকে স্বীকার করিয়ে নেওয়া। উপনিবেশভুক্ত অঞ্চলের মানুষের কাছে এই ইউরোপীয়দের প্রথম পরিচয় ছিল তারা সাদা চামড়ার মানুষ। সেই অনুভূতিকেই শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদীরা নিজেদের প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠায় ব্যবহার করেছে।

এভাবেই ব্রিটিশরা ভারতকে শাসন করেছে, ফরাসিরা আলজেরীয়দের শাসন করেছে, বেলজিয়ানরা কঙ্গোকে শাসন করেছে। এভাবে বহুদিন ধরে সাদা চামড়াকে শ্রেষ্ঠত্বের প্রতীক হিসেবে প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চলেছে।

সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রে সেই গায়ের রংভিত্তিক শ্রেষ্ঠত্ব দাবির দিকে ঝুঁকেছে শ্বেতাঙ্গদের একটি উগ্র অংশ। কিন্তু সাদা ত্বকের বহু মানুষ আছে, যারা গায়ের রঙের ভিত্তিতে নিজেদের শ্রেষ্ঠ ও অন্যদের তুচ্ছ মনে করতে ঘৃণা বোধ করে। এসব মানুষের কাছে ‘সাদা’ একটি রং। তাদের কাছে ‘সাদা’ মানে কোনো আদর্শ নয়।

আল–জাজিরা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত

হামিদ দাবাশি কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক