সাদা পাতার সংবাদপত্র!

সকালবেলা পত্রিকা হাতে নিয়েই চমকে উঠি। প্রথম পাতার পুরোটাই ফাঁকা! টরন্টো স্টার-এর মতো পত্রিকা এভাবে পুরো পাতা ছেড়ে দিল? বিজ্ঞাপনী কৌশল? প্রথম ধাক্কায় এই ভাবনাই মাথায় আসে। পৃষ্ঠা উল্টে তৃতীয় পাতায় যেতেই বটম লিডে চোখ আটকে যায়: ‘নোট টু রিডার্স: আওয়ার ব্ল্যাঙ্ক ফ্রন্ট পেজ (পাঠকের প্রতি নোট: আমাদের সামনের ফাঁকা পাতা)’। নোটে টরন্টো স্টার-এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা জন বয়ন্টন পাঠকদের জানাচ্ছেন, ‘আপনার প্রিয় পত্রিকার প্রথম পাতাটি যে খালি রাখা হয়েছে, সেটি ভুল করে নয়। আমরা ইচ্ছা করে, সিদ্ধান্ত নিয়েই এটি  করেছি। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বার্তা নাটকীয়ভাবে তুলে ধরতে চেয়েছি আমরা।’

জন বয়ন্টনের খোলা চিঠি পড়তে পড়তেই আবার প্রথম পাতায় চোখ  যায়। প্রথম পাতার নিচের দিকের একটা লাইন, ‘ইমাজিন ইফ দ্য নিউজ ওয়াজ’ন্ট দেয়ার (ভাবুন তো এখানে সংবাদ যদি না থাকে)’। আবার প্রথম পাতার খবরহীন, ছবিশূন্য পাতাটায় চোখ ঘুরতে থাকে। কী আশ্চর্য! আপনা থেকেই মনে হতে থাকে, তাই তো! পত্রিকায় যদি কোনো খবরই না থাকে, তাহলে এই পত্রিকা আমি কেন কিনব? পাঠক কেন কিনবে? জন বয়ন্টনের পাঠকের জন্য নোটের একটা লাইন মাথায় ঘুরতে থাকে, ‘সংবাদপত্র থেকে স্থানীয় শিরোনাম (লোকাল হেডলাইনস) নাই হয়ে যাচ্ছে’। শিরোনাম নাই হয়ে যাওয়া মানেই তো খবর নাই হয়ে যাওয়া। মানে নাগরিকদের নাগাল থেকে তথ্য তিরোহিত হয়ে যাওয়া। কানাডীয়দের খবরশূন্য মানে তথ্যশূন্য করে ফেলা হচ্ছে নাকি!

প্রথম পাতার নিচের দিকে যেখানে ‘ইমাজিন ইফ দ্য নিউজ ওয়াজ’ন্ট দেয়ার’ লেখা, তার নিচে আরও কিছু বক্তব্য আছে। গুগল আর ফেসবুক তাদের মনোপলি ক্ষমতা ব্যবহার করে অনলাইন বিজ্ঞাপনের ৮০ শতাংশই নিজেদের পকেটে নিয়ে যায়। কানাডার সাংবাদিক এবং সংবাদপত্রের প্রকাশকেরা যে সংবাদ প্রকাশ করেন, কোনো পয়সা না দিয়েই সেগুলো ব্যবহার করে এই দুই বৃহৎ করপোরেট মুনাফা করছে।
তার নিচে লেখা রয়েছে, ‘অটোয়া নিডস টু অ্যাক্টস নাও টু প্রটেক্ট দ্য ফিউচার অব ইয়োর লোকাল নিউজ’।

এতক্ষণে পরিষ্কার হয়ে যায়, এটি আসলে একটি কর্মসূচি, আন্দোলনের কর্মসূচি। কানাডার বিভিন্ন পত্রিকার প্রকাশকদের প্রতিনিধিত্বশীল সংগঠন ‘নিউজ মিডিয়া কানাডা’-র ডাকে সাড়া দিয়ে পত্রিকার প্রথম পাতা পুরোটা খালি রেখেছে টরন্টো স্টার। জানা গেল, কানাডার ছোট-বড় মিলিয়ে শতাধিক পত্রিকা এই প্রতিবাদে অংশ নিয়েছে। নিউজ মিডিয়া কানাডা জানিয়েছে, শুক্রবার থেকে শুরু হওয়া তাদের এই আন্দোলন লাগাতার চলতে থাকবে। সংবাদপত্রগুলো আন্দোলনটাকে বলছে সংবাদ বাঁচানোর আন্দোলন, শিরোনাম বাঁচানোর আন্দোলন। সংবাদপত্রগুলো সরকারের কাছ থেকে কোনো সুবিধা পাওয়ার জন্য এই আন্দোলন শুরু করেনি। তারা স্পষ্ট করেই বলে দিয়েছে, কোনো ধরনের নতুন তহবিল, আর্থিক সুবিধা বা কর রেয়াত তারা চায় না। তারা শুধু চায় তাদের ন্যায্য অংশ পেতে সহায়ক একটি আইনি কাঠামো।

আইনি কাঠামো তৈরির দাবি জানাতে গিয়ে সংবাদপত্রগুলো যে প্রচারণা শুরু করেছে, তার বক্তব্যও বেশ পরিষ্কার। টরন্টো স্টার তার পাঠকদের বলছে, ‘আমাদের সংবাদপত্র, আমাদের গণতন্ত্র হামলার সম্মুখীন, আন্ডার অ্যাটাক’। এই বক্তব্য নিয়েই তারা পাঠকদের কাছে, সরকারের কাছে যাচ্ছে। নিউজ মিডিয়া কানাডার নামে এমপিদের চিঠি দিচ্ছে, পত্রিকায় খোলা চিঠি ছাপছে, পাঠকদের আহ্বান জানাচ্ছে খোলা চিঠিটি তাদের নিজেদের নামে নিজ নিজ এলাকার এমপিকে পৌঁছে দিতে।

টরন্টো স্টার তার চিঠিতে বলছে, ‘বিশ্বাসযোগ্য এবং নির্ভরশীল সাংবাদিকতা, যা আমাদের সরকারকে জবাবদিহির মধ্যে রাখে, সেটির অনুপস্থিতিতে দেশের গণতন্ত্র এবং সন্তানদের ভবিষ্যৎ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সত্যনির্ভর সংবাদের জন্য আমাদের পয়সা দিতে হয়। দুর্ভাগ্যবশত গুগল ও ফেসবুকের মতো বৃহৎ কোম্পানি কানাডীয় সংবাদমাধ্যমের যেসব খবর ব্যবহার করে, তার জন্য পয়সা দিতে অস্বীকৃতি জানাচ্ছে।’ এমপিদের উদ্দেশে জরুরি যে খোলা চিঠিটি প্রকাশ করেছে নিউজ মিডিয়া কানাডা, সেখানে প্রতিষ্ঠানটির প্রেসিডেন্ট জন হিন্ডস বলছেন, ‘গুগল ও ফেসবুক, ইতিহাসের সবচেয়ে ধনী দুটি করপোরেট কানাডার ইন্টারনেট প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করে। একটি সার্বভৌম জাতি হিসেবে আমরা সংবাদে কী দেখব, আর কী দেখব না, তার সিদ্ধান্ত নেয় তারা। কানাডীয়দের তৈরি করা খবর তারা নেয়,কিন্তু তার জন্য কোনো পয়সা দেয় না।’

চিঠিতে বলা হয়, কানাডার ছোট-বড় সব সংবাদমাধ্যম দুটি কারণে ভোগান্তির শিকার—১. ফেসবুক ও গুগল তাদের তৈরি করা কনটেন্ট ব্যবহার করে কোনো পয়সা না দিয়ে, ২. কানাডীয় ডিজিটাল বিজ্ঞাপন রাজস্বের শতকরা ৮০ ভাগই চলে যায় তাদের কাছে। আমেরিকান এই দুই কোম্পানি বিজ্ঞাপন রাজস্বের প্রায় সবটুকুই নিয়ে নেয়, কিন্তু কানাডীয় মিডিয়ার কনটেন্টের জন্য কোনো পয়সাই দেয় না। চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, সিনেমা, নাটক, গান, এমনকি টেলিভিশন শোর কনটেন্টের জন্যও পয়সা দিতে হয়, তাহলে নিউজ কনটেন্টের বেলায় কেন ভিন্ন আচরণ?

খোলা চিঠিতে নিউজ মিডিয়া কানাডা সরকারকে সতর্ক করে দিচ্ছে, সংবাদমাধ্যম নিজেদের গুটিয়ে নিলে এবং সোশ্যাল মিডিয়া ভুয়া ও বিভক্তির সংবাদ পরিবেশন করলে কী পরিস্থিতি হয়, তার জলজ্যান্ত উদাহরণ আমাদের দক্ষিণের প্রতিবেশীর (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র) পরিস্থিতি। চিঠিতে বলা হয়, ‘আমাদের গণতন্ত্রের মেরুদণ্ড হিসেবে স্বাধীন বহুমুখী সংবাদ প্রতিষ্ঠানগুলোর দিকে অবশ্যই সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে হবে।’

সরকারকে অস্ট্রেলিয়ার উদাহরণ অনুসরণের পরামর্শ দিচ্ছে নিউজ মিডিয়া কানাডা। অস্ট্রেলিয়া আইন করে দিয়েছে, সংবাদ কনটেন্ট ব্যবহার করলে গুগল ও ফেসবুক পত্রিকাগুলোকে মূল্য দিতে বাধ্য। কেবল অস্ট্রেলিয়া বা কানাডা নয়, পশ্চিমের দেশে দেশে সংবাদপত্রগুলো জোট বাঁধছে, নিজ নিজ সরকারের ওপর চাপ তৈরি করছে। নিউজ কনটেন্ট ব্যবহারের জন্য গুগল ও ফেসবুককে মূল্য পরিশোধে বাধ্য করতে আইনি কাঠামো নিশ্চিত করতে হবে। বাংলাদেশের সংবাদপত্রগুলোও বিষয়টি বিবেচনায় নিতে পারে।

শওগাত আলী সাগর কানাডা প্রবাসী বাংলাদেশি সাংবাদিক।