সাদেক-আজিজকেও কি হার মানালেন নূরুল হুদা

প্রধান নির্বাচন কমিশনার মো. নূরুল হুদা।
ফাইল ছবি

প্রশ্নটি ছিল সহজ, কিন্তু জবাবটি ধাক্কা খাওয়ার মতো। ১৭ অক্টোবর প্রথম আলোর অনলাইন ভোটে প্রশ্ন রাখা ছিল; ঢাকা-৫ ও নওগাঁ-৬ আসনের উপনির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে—সিইসির এ বক্তব্যের সঙ্গে আপনি কি একমত? জবাবে ৯১ শতাংশ ভোটার মত দিয়েছেন যে নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি। মাত্র ৬ শতাংশ ভোটার মত দিয়েছেন যে নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে। ৩ শতাংশ ভোটার মন্তব্য করতে রাজি নন।

দেশে নির্বাচন ও ভোটের অবস্থাটা কোথায় গিয়ে ঠেকেছে, তা বোঝার জন্য এ ছোট জরিপই যথেষ্ট। এরপরও বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশন নির্বাচন করছে, সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার দোহাই দিচ্ছে। যদিও নির্বাচন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সংবিধানের দোহাই দিয়ে এ ধরনের হাস্যকর নির্বাচন করার কোনো মানে নেই। বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন করে ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে আনার উপায়ও নির্বাচন কমিশনের অজানা নয়।

সর্বশেষ উপনির্বাচনে ঢাকা-৫ আসনে ১০ দশমিক ৪৩ শতাংশ ভোট পড়েছে। ভোটার ছিলেন ৪ লাখ ৭১ হাজার। এর মধ্যে আওয়ামী লীগের প্রার্থী মো. কাজী মনিরুল ৪৫ হাজার ৬৪২, বিএনপির প্রার্থী সালাহউদ্দিন আহমেদ ২ হাজার ৯৩৭ এবং জাতীয় পার্টির মীর আবদুস সবুর ৪১৩ ভোট পেয়েছেন। আমরা যাঁকে জনপ্রতিনিধি বলব, তিনি একটি আসনে ১০ শতাংশের কম ভোটে নির্বাচিত। এ লজ্জা কার—প্রার্থী, ভোটার না নির্বাচন কমিশনের? এ পরিস্থিতির দায় মূলত সরকারের হলেও বক্তৃতাসর্বস্ব বিরোধী দলও দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে।

স্বৈরাচার এইচ এম এরশাদের সময়ে নির্বাচনে কারচুপি হয়েছে, মানুষ প্রতিবাদও করেছে। প্রতিবাদ হয়েছে বিএনপির আমলেও। সে সময় প্রতিবাদ করার পরিবেশ ছিল। বিরোধী দল অন্দোলন করেছে। এখন বিরোধী দলের আন্দোলন নেই বলে মানুষ নীরবে প্রতিবাদ করছে। সুষ্ঠু ও সুস্থ রাজনীতিই তাদের সরব করতে পারে, ভোটকেন্দ্রমুখী করতে পারে

গত ২১ মার্চ অনুষ্ঠিত ঢাকা-১০ আসনের উপনির্বাচনে মাত্র ৫ শতাংশ ভোট পড়েছিল। তবে এবার নওগাঁ-৬ আসনের উপনির্বাচনে ভোট পড়েছে ৩৬ দশমিক ৪৯ শতাংশ। অন্যান্য উপনির্বাচনে ভোটের সংখ্যা খুবই কম। ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সর্বশেষ নির্বাচনে ২৭ দশমিক ১৫ শতাংশ ভোট পড়েছে।

ঢাকা ও নওগাঁর উপনির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি কম হওয়ার কারণ হিসেবে করোনাভাইরাস মহামারির পাশাপাশি ‘খণ্ড নির্বাচন’ নিয়ে মানুষের আগ্রহ কম হওয়ার কথা বলেছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নূরুল হুদা। তাঁর দাবি, উপনির্বাচন ‘সুষ্ঠু’ হয়েছে। যদিও জনমত জরিপে তাঁর বক্তব্য সঠিক প্রমাণিত হয় না।

নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়ার মাপকাঠি বলতে যদি শুধু মারামারি, হানাহানি বা প্রাণহানি না হওয়া বোঝানো হয়, সেটি ভিন্ন কথা। সিইসি সেটিই বোঝাতে চাইছেন। সিইসি বলেন, ‘নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে। দুই উপনির্বাচনে আমাদের কাছে কোনো অভিযোগ নেই। কোথাও কোনো অসুবিধার সৃষ্টি হয়নি।’ এটা যেন অনেক বড় স্বস্তি তাঁর জন্য। তবে নির্বাচনব্যবস্থা থেকে ভোটারদের ঝেঁটিয়ে বিদায় করার কৃতিত্ব অনেকটাই তাঁর। দেশের নির্বাচনব্যবস্থা ও ভোটের ইতিহাসে তিনি অন্যভাবে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন, যেমনটি আসে সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার এম এ আজিজ বা এ কে এম সাদেকের নাম। সমালোচিত ও বিতর্কিত ওই দুটি কমিশনকে ছাড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা চলছে কি না, সেই প্রশ্ন উঁকি দেয় মনে।

প্রশ্ন হচ্ছে এমন বিতর্কিত নির্বাচনে বিরোধী দল বিএনপিই–বা কেন অংশ নেয়। এর আগে জাতীয় নির্বাচনের পর বিএনপি ঘোষণা দিয়েছিল, ‘বর্তমান সরকার এবং নির্বাচন কমিশনের অধীন আর কোনো নির্বাচনে অংশ নেবে না বিএনপি।’ (প্রথম আলো, ১৭ জানুয়ারি ২০১৯)

তাহলে আপনারা এমন নির্বাচনে কেন যাচ্ছেন? জবাবে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘আমরা নির্বাচনে গিয়ে বারবার প্রমাণ করতে চাই, এই সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না, হয় না। যে নির্বাচন কমিশন আছে, এদের লজ্জা–শরম বলতে কিচ্ছু নেই। এটা একটা ঠুঁটো জগন্নাথ।’ (দৈনিক ইত্তেফাক, ২০ অক্টোবর ২০২০)।

এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, সরকার ও নির্বাচন কমিশনকে প্রশ্নবিদ্ধ করতেই নির্বাচনে অংশ নিয়েছে বিএনপি। তারা জেতার জন্য নয়, অভিযোগ করার জন্যই নির্বাচনে অংশ নেয়। (দৈনিক ইত্তেফাক, ২০ অক্টোবর ২০২০)।

নির্বাচন নিয়ে এ রাজনৈতিক বাগ্‌যুদ্ধ চলছে এবং চলবে। কিন্তু যাদের ঘাড়ে বন্দুক রেখে গুলি করা হচ্ছে, সেই নির্বাচন কমিশন কি একবার পূর্বসূরিদের পরিণতির কথা মনে রেখেছে? এম এ আজিজ রাজনৈতিক টানাপোড়েনের মধ্যে ২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারি নবম জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেছিলেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ফখরুদ্দীন আহমদ তফসিল বাতিল করেন। পদত্যাগ করেন এম এ আজিজ। একবার তাঁকে খুঁজে না পেয়ে রাজধানীর মগবাজারের একটি হাসপাতালে একদল সাংবাদিক হাজির
হয়েছিলাম। তিনি কোমরের বেল্ট খুলে প্রমাণ করার চেষ্টা করলেন যে তিনি অসুস্থ। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে তাঁর বেল্ট খুলে অসুস্থতা প্রমাণ করার অসহায় ছবি ছাপা হয়েছিল। এর আগে বিচারপতি এ কে এম সাদেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার থাকা অবস্থায় তাঁর কমিশনের অধীনে অনুষ্ঠিত হয় ১৯৯৬ সালের বিতর্কিত ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচন। সেই নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সংসদের মেয়াদ ছিল ৯ দিন।

সাদেক-আজিজ-হুদা—ভোটব্যবস্থায় এ তিনজন সিইসির নাম বিশেষভাবে ‘স্মরণীয়’ হয়ে থাকবে। রাজনৈতিক দল হয়তো অতীতের ভুল সংশোধনের সময় পায়। কিন্তু নির্বাচন কমিশনের সেই সংশোধনের সুযোগ নেই। সাদেক–আজিজ কমিশনকেও হার মানালেন হুদা।

স্বৈরাচার এইচ এম এরশাদের সময়ে নির্বাচনে কারচুপি হয়েছে, মানুষ প্রতিবাদও করেছে। প্রতিবাদ হয়েছে বিএনপির আমলেও। সে সময় প্রতিবাদ করার পরিবেশ ছিল। বিরোধী দল অন্দোলন করেছে। এখন বিরোধী দলের আন্দোলন নেই বলে মানুষ নীরবে প্রতিবাদ করছে। সুষ্ঠু ও সুস্থ রাজনীতিই তাদের সরব করতে পারে, ভোটকেন্দ্রমুখী করতে পারে।

শরিফুজ্জামান সাংবাদিক

[email protected]