সাবেক প্রধানমন্ত্রীর তথ্যই যখন সবার ইনবক্সে চলে যায়

বিএনপিরই উচিত ছিল খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্যের সর্বশেষ তথ্য জানিয়ে সবাইকে আশ্বস্ত রাখা।

গত শনিবার রাত থেকেই সামাজিক মাধ্যমে সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়া নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছিল। প্রথমে বিএনপি স্বীকারই করতে চায়নি যে খালেদা জিয়ার কোভিড পরীক্ষা করা হয়েছে। কিন্তু শনিবার রাতেই গণমাধ্যমকর্মীদের কাছে খালেদা জিয়ার করোনায় আক্রান্ত হওয়ার তথ্য চলে আসে। তবে সংবাদটি তারা প্রকাশ করেনি। গত রোববার সকালে গণমাধ্যমকর্মীরা নিশ্চিত হয়ে সংবাদটি প্রকাশ করেন। প্রমাণ হিসেবে বিভিন্ন দৈনিকের অনলাইন সংস্করণে কোভিড পরীক্ষার ফলাফলও জুড়ে দেওয়া হয়। এরপর থেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের দেয়ালে দেয়ালে ঘুরতে থাকে খালেদা জিয়ার কোভিড পরীক্ষার ফলাফল।

এ প্রতিবেদন কারা, কীভাবে গণমাধ্যমের কাছে ছড়িয়ে দিল? এতে রোগীর গোপনীয়তা লঙ্ঘিত হলো কি না—এসব প্রশ্ন উঠেছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। পক্ষ-বিপক্ষ—দুই পক্ষই নানা যুক্তিতর্ক তুলে ধরেছে। কিন্তু স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছা যায়নি। তবে একটি বিষয়ে সবাই একমত হবেন, এ ঘটনা রোগীর অধিকার ও মানবাধিকারের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।

এ ঘটনায় সংশ্লিষ্ট সব পক্ষেরই দায় আছে। মনে রাখতে হবে, খালেদা জিয়া এখন অন্তরীণ। বিশেষ শর্ত সাপেক্ষে বাড়িতে অবস্থান করলেও কার্যত তিনি জেলেই আছেন। একজন কারাবন্দী ব্যক্তির রোগের কাগজপত্র মানুষের হাতে হাতে ঘুরে বেড়ানো খুবই দুর্বল নিরাপত্তার চিহ্ন বহন করে। এ ঘটনা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল, দেশে কারও তথ্যই আর নিরাপদ নেই। সাবেক প্রধানমন্ত্রীর তথ্য যখন সবার ইনবক্সে চলে যায়, তখন সাধারণ মানুষের তথ্যের নিরাপত্তা আশা করাটাই বোকামি।

কোভিড পরীক্ষা ছাড়াও জনসাধারণকে বিভিন্ন কাজে বিভিন্ন জায়গায় আঙুলের ছাপ থেকে শুরু করে ব্যক্তিগত নানা তথ্য দিতে হয়। এসব তথ্য কখন, কার হাতে, কোথায় চলে যাচ্ছে, কেউ জানে না। আমাদের তথ্যপ্রযুক্তির নিরাপত্তা কতটা আমরা সবাই জানি। যেকোনো মুহূর্তে যেকেউ আপনার-আমার তথ্য হাতিয়ে নিতে পারে। আর প্রতিষ্ঠানের ভেতর থেকে কেই সরবরাহ করলে তো কথাই নেই। ইদানীং যে হারে টেলিফোনের কথাবার্তা ফাঁস হচ্ছে, তাতে মনে হয় না তৃতীয় কোনো পক্ষ তথ্য হাতাচ্ছে। সংশ্লিষ্টদের মধ্য থেকেই এসব তথ্য সরবরাহ করা হচ্ছে।

বিএনপিও পরিস্থিতি দক্ষতার সঙ্গে সামাল দিতে পারেনি। এমনিতেই দলটি কিছুদিন ধরে সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। তাদের কৌশল, নীতি ও আচরণে অপরিপক্বতার ছাপ স্পষ্ট। প্রথমে অস্বীকার করলেও পরে বিষয়টি ভাইরাল হয়ে গেলে তাদের যেন হুঁশ আসে। তারা অভিযোগ করে, খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত তথ্যের গোপনীয়তা লঙ্ঘন করা হয়েছে। কিন্তু বিএনপি বা খালেদা জিয়ার পরিবার কী কারণে বা কেন কোভিডে আক্রান্ত হওয়ার তথ্য গোপন রাখতে চেয়েছিল, তা বোধগম্য হচ্ছে না।

শুরু থেকেই বিএনপির উচিত ছিল বিষয়টি নিয়মিতভাবে দিনে কয়েকবার সংবাদমাধ্যমকে জানানো। খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্যের সর্বশেষ পরিস্থিতি জানিয়ে সবাইকে আশ্বস্ত রাখা। এই মহামারির দুর্যোগে যে কেউই আক্রান্ত হতে পারে। তাই গোপন না রেখে, লুকোচুরি না করে, সবাইকে অবগত রাখাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন গত বছর কোভিডে আক্রান্ত হয়েছিলেন। ওই সময় নিয়মিতভাবেই তাঁর সর্বশেষ পরিস্থিতি নিয়ে ব্রিফ করা হয়েছে।

এ ছাড়া অনেক রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধান কোভিডে আক্রান্ত হয়েছেন। রাষ্ট্র বা সরকারপ্রধান, রাজনৈতিক নেতা, জনপ্রিয় ব্যক্তি রোগব্যাধি, বিশেষ করে কোভিডে আক্রান্ত হলে গণমাধ্যম স্বভাবতই এসব সংবাদ সংগ্রহ করতে চাইবে। কোনো না কোনোভাবে তথ্য তারা সংগ্রহ করবেই। এটাই গণমাধ্যমের কাজ। তাই বলে ব্যক্তিগত গোপনীয় তথ্য জনসমক্ষে প্রকাশ করে দেওয়া সমীচীন নয়।

এ ইস্যুতে বিএনপি এখন কী করতে পারে? সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যুক্তিতর্ক করা ছাড়াও বিএনপির উচিত হবে আদালতের দ্বারস্থ হওয়া। বিশ্বের অনেক দেশে তথ্য সুরক্ষা আইন আছে। এসব দেশে গ্রাহক বা রোগীর তথ্য কোনো কারণে ফাঁস হলে বা তৃতীয় কোনো পক্ষের হাতে গেলে মামলার বিধান রয়েছে। বিশেষ করে রোগীর তথ্য কোনোভাবেই প্রকাশ করা যাবে না যদি রোগী নিজ থেকে না বলেন। খালেদা জিয়ার তথ্য দুভাবে ফাঁস হতে পারে। এক. খালেদা জিয়ার কাছের কেউ গণমাধ্যমকে দিয়েছেন। অথবা যাঁরা এই প্রতিবেদন তৈরি করেছেন, তাঁদের কেউ দিয়েছেন। যদি লিখিত কোনো প্রতিবেদনের কপি খালেদা জিয়াকে না দেওয়া হয়ে থাকে, তবে প্রতিবেদন তৈরি জায়গা থেকেই তথ্য পাচার হতে পারে।

তথ্য ফাঁসের অভিযোগে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে মামলা করতে পারে বিএনপি বা খালেদা জিয়া নিজে। যদি খালেদা জিয়ার আশপাশে অবস্থানকারী কেউ এই তথ্য পাচার করে থাকেন, তবে তাঁর বিরুদ্ধেও মামলা করা উচিত হবে। তথ্য ফাঁসের বিরুদ্ধে কথা বলতে হবে। সাধারণ নাগরিকদের পথ দেখাতে পারে বিএনপি। শুধু খালেদা জিয়া বা বিএনপি না, এযাবৎকালে যাঁদের টেলিফোন সংলাপ ফাঁস হয়েছে, তাঁদের সবারই উচিত হবে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আইনের আশ্রয় নেওয়া। নাগরিকের যেমন তথ্য পাওয়ার অধিকার আছে, তেমনি ব্যক্তিগত তথ্যের গোপনীয়তা বজায় রাখার অধিকারও আছে। অনেকেই প্রশ্ন করতে পারেন, মামলা করলেই কি সুবিচার পাওয়া যাবে? সুবিচার নাই পেতে পারেন। কিন্তু কয়েক শ মানুষ বা হাজার খানেক মানুষ আদালতে মামলা করলে তা ইতিহাসের পাতায় লিপিবদ্ধ হয়ে থাকবে। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম জানতে পারবে, আজকের সময়ে কী হয়েছিল।

মারুফ মল্লিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক