সাম্প্রদায়িক দুষ্টচক্রের আস্তানা কোথায়?

সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ছড়িয়ে সংখ্যালঘুদের ঘরবাড়ি তছনছ
ছবি প্রথম আলো

আপনি দেখলেন, গ্রামের পারে যে নদী তার ওপারে জড়ো হয়েছে কয়েক হাজার মানুষ। তাদের হাতে লাঠি-দা, মুখে হিংসামাখা স্লোগান। তারা আপনাদের শাস্তি দিতে চায়। আপনি নিজেও বুঝতে পারছেন না, গ্রামের মানুষকেও বোঝাতে পারছেন না, কী দোষে তারা হামলা করবে। ভুল বা অপরাধ যিনি করেছেন, সেই যুবকটিকে তো আপনারাই পুলিশের হাতে সোপর্দ করেছেন। তাঁর কাজে আপনারাও ভয়ানক বিরক্ত। তাহলে কেন দুর্বলের জীবন ও ঘর-সংসারের ওপর এমন হুমকি?

গত বুধবার সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলার নোয়াগাঁও গ্রামের ঘটনা আরও মারাত্মক হতে পারত যদি আক্রমণকারী ও আক্রান্তদের মাঝখানে প্রকৃতি নিজেই দয়াপরবশ হয়ে একটি নদী পেতে না রাখত। হেফাজতে ইসলামের একজন নেতাকে অপমান করে দেওয়া ফেসবুক পোস্টের দ্বারা উত্তেজিত জনতা আর শ খানেক দরিদ্র কৃষক পরিবারের বসতির মাঝখানে প্রকৃতির তৈরি ওই নদীই বাধা। এই বাধা যদি না থাকত, তাহলে প্রশাসন আসার আগেই এই জনতার বড় অংশটাকেই নোয়াগাঁওয়ের হিন্দু বসতির ওপর লেলিয়ে দেওয়া যেত।

কিন্তু তা হয়নি। নদীকে পেছনে রেখে পুলিশ, প্রশাসন, উপজেলা চেয়ারম্যান ও ধর্মীয় নেতারা উত্তেজিত মাথাগুলোকে ধীরে ধীরে শান্ত করেছেন। প্রশাসনের মনে হয়েছে, ঘটনা দ্বিতীয়বারের মতো সামলানো গেল। আগের দিন সন্ধ্যার উত্তেজনার পর আলেম-ওলামাদের নিয়ে বৈঠক করে প্রশাসন নিশ্চিত হতে চেয়েছিল যে পরদিন সকালে কোনো উত্তেজনা, কোনো মিছিল হবে না। হেফাজতে ইসলামের নেতারাও তাঁদের সেভাবে আশ্বস্ত করেছিলেন।

তারপরও কারা হামলা করল? পুলিশ বলি, সাংবাদিক বলি, প্রশাসন বলি, সবাইকেই খুঁজে বের করতে হবে এর উত্তর।

পরদিন সকালে যথারীতি মিছিল বের হয়। প্রশাসন সময় করে আসতে পেরেছিল। স্থানীয় উপজেলা চেয়ারম্যান, ইউএনও ও পুলিশ নদীর পাড়ে জমায়েত হওয়া জনতাকে মোটামুটি সামলেও ফেলেছিল। কিন্তু দেখা গেল, কয়েক হাজারের জমায়েত থেকে ৬০-৭০ জনের ছোট্ট একটি দল নদী সাঁতরে ওপারে হিন্দু গ্রামের দিকে যাচ্ছে। ওপারে উঠে তারা ঝটিকা অভিযানে দৌড়াতে দৌড়াতে গ্রামের ঘরবাড়িতে হামলা চালাতে চালাতে বেরিয়ে যায়।

এই ছোট দলটি কারা? কোথা থেকে এসেছিল? হামলার জন্য মাত্র ২০ মিনিট সময় নিয়েছিল তারা। একটি সাম্প্রদায়িক ‘ঘটনা’ ঘটিয়ে তুলতে এর বেশি আর কী চাই?

যেখানেই সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা তৈরি হয়, সেখানেই অতি উৎসাহী, দাঙ্গাবাজ, সমাজবিরোধী, বিশেষ অভিসন্ধিপ্রবণ লোক, সুযোগসন্ধানীদের এই ভূমিকায় দেখা যায়। সাম্প্রতিক সব কটি সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ও হামলার ঘটনায় জনতাকে উত্তেজিত করা, প্রচারণা চালানো এবং হামলায় নেতৃত্বদানকারী ছোট একটা গোষ্ঠীর সুচারু দক্ষতার প্রমাণ পাওয়া যায়। এই লেখক নিজে যতগুলো সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার ঘটনা সরেজমিনে বুঝতে গিয়েছেন; প্রায় সব কটিতেই উত্তেজিত ধর্মপ্রাণ জনতার মধ্যে একদল সমাজবিরোধীর পরিকল্পিত প্রচেষ্টার আলামত দেখা গেছে। এ বিষয়ে সরকারি তদন্ত ও গণমাধ্যমের ভাষ্য মিলিয়ে বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক হাঙ্গামার এই আদল বা প্যাটার্নটা বিশেষভাবে খেয়াল করার মতো।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া, রংপুর, কুড়িগ্রাম বা তার আগের সাঁথিয়ায় কিংবা রামুতে, এমনকি সাঈদীকে চাঁদে দেখার কথিত গুজবের পরিবেশে চালানো ধ্বংসযজ্ঞের সময়ও এটা দেখা গেছে। যে জনতা সহজেই উত্তেজিত হয়, যাদের কাল্পনিক শত্রুর বিরুদ্ধে ঠেলে দেওয়া সম্ভব হয়, তাদের দায়ও আমাদের যেমন নিতে হবে; তেমনি কী সমাজ আমরা বানালাম, তার হিসাব মেলাতে হবে। রাজনৈতিকভাবে প্রান্তিক এবং ভেতর-বাইরের চাপে তটস্থ মানুষের ক্ষোভ-বিক্ষোভকে সহজেই ভিন্ন খাতে বইয়ে দেওয়া সম্ভব। এটা অনেকটা ঝিকে মেরে স্বামীর ওপর রাগ ঝাড়ার মতো ব্যাপার।

বাংলাদেশের নরসিংদী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও সিলেটের সুনামগঞ্জ একই বেল্টে পড়ে। প্রায়ই এসব এলাকায় তুচ্ছ ঘটনায় গ্রামে গ্রামে আদিম কায়দায় ‘যুদ্ধ’ হয়। গ্রামবাসীকে লেলিয়ে দিয়ে প্রায়ই প্রভাবশালী ব্যক্তিরা ফায়দা লোটেন। সাম্প্রদায়িক বলে বর্ণিত ঘটনায় এই গ্রামে গ্রামে ‘যুদ্ধের’ ব্যাকরণও কাজ করে থাকতে পারে। এই মানসিকতার ব্যাখ্যা সমাজতত্ত্ব করবে, রাজনীতিবিদ্যা করবে। কিন্তু জনতাকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে গোষ্ঠীস্বার্থ চরিতার্থকারীদের পরিচয় বের করা সরকারের দায়িত্ব।

এই দায়িত্ব যদি তারা পালন করত, তাহলে অনেক ঘটনাই ঘটতে পারত না। প্রায় সব সাম্প্রদায়িক হামলার আগে প্রশাসন বিভিন্ন পক্ষকে নিয়ে বৈঠক করে, সমঝোতায় আনে প্রভৃতি। কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকলে তাকে গ্রেপ্তারও করে। কিন্তু তাতেই যে ক্ষোভের আগুন নেভে না, তা আর কতবার আগুনে হাত পুড়িয়ে শিখতে হবে? যত বড় নেতা বা সংগঠনই হোক, কয়েক ঘণ্টার মধ্যে চার গ্রামের মানুষকে খেপিয়ে দাঙ্গাবাজ বানানো যায় না। এর জন্য পরিকল্পনা, অর্থায়ন ও কর্মী দল লাগে।

শাল্লায় যদি প্রশাসনের গোয়েন্দা ও সোর্সরা থাকতেন, তাহলে তাঁরা জানতে পারতেন যে পরদিন মিছিল ও হামলার আয়োজন চলছে। আশা করি, প্রশাসন এর ব্যাখ্যা দেবে। পাশাপাশি মাওলানা মামুনুল হকের চরিত্রহননের অভিযোগে আটক হিন্দু যুবককে অপরাধ প্রমাণের আগে দোষী সাব্যস্ত করা যাবে না। তাঁকে প্রচলিত আইনে বিচারের আওতায় আনার পাশাপাশি খতিয়ে দেখা হোক, দরিদ্র ও বেকার এই যুবক নিজেই কি তাঁর ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে পোস্ট দিয়েছিলেন, নাকি তা হ্যাক করা হয়েছিল? শোনা যাচ্ছে, তাঁর বিরুদ্ধে ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনে মামলা করা হবে। মানবাধিকারবিরোধী ও অগণতান্ত্রিক এই আইন ছাড়াও আরও আইন আছে। আমরা সেদিকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।

ভারতে কয়েক দশকের সাম্প্রদায়িক হামলা নিয়ে গবেষণা করেছেন অধ্যাপক আশীষ নন্দী ও তাঁর দল। জাতিসংঘের ইউনেসকোর অর্থায়নে বাবরি মসজিদ হামলা ও দাঙ্গা নিয়ে ‘ক্রিয়েটিং আ ন্যাশনালিটি’ শীর্ষক ওই জরিপ ও গবেষণার সিদ্ধান্তে তাঁরা বলছেন, ‘প্রশাসন চাইলে ৩-৬ ঘণ্টার বেশি কোনো দাঙ্গা চলতে পারে না। যদি পারে, তাহলে বুঝতে হবে, সরকার চেয়েছে বলেই হয়েছে।’

বাংলাদেশে দাঙ্গা-হাঙ্গামা বেশিক্ষণ চলতে পারে না। অধিকাংশ ঘটনাই হয় ঝোড়ো কালবৈশাখী কায়দায়। শুধু প্রশাসন চায় না বলেই হয় না, তা নয়। জনগণও চায় না। এ জন্যই সুযোগসন্ধানীরা বেশি একটা সময় হাতে পায় না। এ জন্যই দেখা যায়, মিছিলে হাজার লোক এলেও হামলায় জড়িত হয় মাত্র কয়েক ডজন। আমাদের এত বড় রাষ্ট্রযন্ত্র, সরকারের সব কাজ করিয়ে দিতে এত দক্ষ পুলিশ বাহিনী এই গুটিকতেক লোককে কবজা করতে পারে না, তা বিশ্বাস হওয়ার কথা না।

এ ধরনের প্রতিটি ঘটনায় হিন্দু সমাজের প্রান্তিক মানুষেরাই আক্রান্ত হন। আপন জন্মভূমির ওপর বিশ্বাস ভঙ্গ হয় তাঁদের। সেই বিশ্বাস ও আস্থা ধরে রাখা ছাড়া নিজেদের মানবিক ও গণতান্ত্রিক বলে দাবি করার সুযোগ কম। উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপান যাঁরা, তাঁরা সাম্প্রদায়িকতার রিং মাস্টার।

মানুষের ধর্মবিশ্বাসকে ব্যবহার করে দেশবিরোধী, সমাজবিরোধীরা যে সম্প্রদায়ের সহাবস্থানের পরিবেশ নষ্ট করে, এ বিষয়ে আলেম-ওলামাদেরও করণীয় রয়েছে। জেনে ভালো লেগেছে যে হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা মামুনুল হক, শাল্লার নোয়াগাঁও গ্রামে হিন্দু সমাজের ওপর হামলাকারীদের অতি উৎসাহী ও হঠকারী বলে নিন্দা করেছেন। ভিডিও বার্তায় তিনি বলেছেন, ‘সে ক্ষেত্রে সোচ্চার ও সচেতন থাকা চাই। দেশের মধ্যে যেন কোনো সাম্প্রদায়িক বিশৃঙ্খলা তৈরি না হয়। হিন্দু-মুসলিমের যে শান্তিপূর্ণ ও সৌহার্দ্যমূলক সম্পর্ক, সেটি বহাল রাখার জন্য সকল মহলের দায়িত্বশীল আচরণ প্রয়োজন।’

মামুনুল হক আরও বলেন, ‘যদি কোনো ব্যক্তিবিশেষের নামে এ ধরনের আপত্তিকর অভিযোগ তারা দায়ের করে অথবা তার চরিত্র হরণ করে কটাক্ষ করে, সে ক্ষেত্রেও দেশের প্রচলিত আইনের সহায়তা নেওয়ার জন্য কঠোর নির্দেশনা থাকবে। কোনোভাবে আইন হাতে তুলে নেবেন না।’ মামুনুল হকের তরফে এটা বলা দরকার ছিল। কেননা, তাঁর বিরুদ্ধে অপমানসূচক পোস্ট দেওয়া নিয়েই এই বিবাদের সূত্রপাত। আশা করি, এই বার্তা তাঁরা তাঁদের অনুসারীদের জন্য সর্বদাই রেখে যাবেন।

এসব ঘটনা ঘটার পরিপ্রেক্ষিতও থাকে। শাল্লার ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতের মধ্যে রয়েছে; ১. বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ উদ্‌যাপনের তারিখ, ২. স্থানীয় জলমহাল ইজারা নিয়ে কৃষকদের সঙ্গে প্রভাবশালীদের বিরোধ এবং তার জের ধরে নোয়াগাঁওয়ের বাসিন্দাদের ‘দেখে নেওয়ার’ হুমকি প্রদান; ৩. আসন্ন পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপির প্রচারে ‘বাংলাদেশে হিন্দু নিপীড়ন ইস্যু’; ৪. ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর আসন্ন বাংলাদেশ সফর এবং ৫. আরও অনেক কিছুই থাকতে পারে যা আমাদের অজানা।

এ ধরনের প্রতিটি ঘটনায় হিন্দু সমাজের প্রান্তিক মানুষেরাই আক্রান্ত হন। আপন জন্মভূমির ওপর বিশ্বাস ভঙ্গ হয় তাঁদের। সেই বিশ্বাস ও আস্থা ধরে রাখা ছাড়া নিজেদের মানবিক ও গণতান্ত্রিক বলে দাবি করার সুযোগ কম। উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপান যাঁরা, তাঁরা সাম্প্রদায়িকতার রিং মাস্টার। এঁদের দায় জনগণ কেন নেবে? এদের পরিষ্কার ভাষায় বলে দিতে হবে, সংখ্যাগরিষ্ঠের বা সংখ্যালঘুর যে-ই তুমি হও, এই হিংসার কারবার আমাদের নামে আর করা যাবে না।

ফারুক ওয়াসিফ: লেখক ও সাংবাদিক।
faruk. wasif@prothomalo. com