সাম্প্রদায়িক সহিংসতাকারীরা কেন আওয়ামী লীগে

রংপুরের পীরগঞ্জে হিন্দুপল্লিতে সহিংসতার ঘটনায় ছাত্রলীগের বহিষ্কৃত নেতা সৈকত মন্ডলকে আদালতের মাধ্যমে জেলহাজতে পাঠানো হয়
ছবি: প্রথম আলো

আতঙ্ক, ভয়, দুঃস্বপ্নের দিনরাত্রিগুলো অনেকটা থিতু হয়ে এসেছে। টানা কয়েক দিন দেশের ১৬টি জেলায় এবারে হিন্দু সম্প্রদায়ের ঘরবাড়ি, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও পূজামণ্ডপ-মন্দিরে যে হামলা-ভাঙচুর, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ ও সহিংসতা হলো, তা দুই দশকের মধ্যে ছিল নজিরবিহীন। সাম্প্রদায়িক এ উন্মত্ততায় যে সম্পদহানি হয়েছে, সরকারি ও ব্যক্তিগত নানা উদ্যোগে তার অনেকটাই হয়তো পূরণ হবে। কিন্তু যে পরিবারগুলো প্রিয়জন হারিয়েছে, তাদের সেই অমূল্য ক্ষতি পূরণ হবে কী করে? কিংবা পীরগঞ্জের যে নারী দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠা আগুন থেকে বাঁচতে ধানখেতে আশ্রয় নিয়েছিলেন, যে শিশুটি সারা রাত প্রাণপণে বাঁশের আগা আঁকড়ে জীবন বাঁচিয়েছিল—তাদের মানসিক ট্রমা এবং বাকি জীবনভরের অনাস্থা, অবিশ্বাস ফিরিয়ে দেবে কে?

ভিন্ন ধর্ম, ভিন্ন জাতি কিংবা ভিন্ন পরিচয় বলেই একদল নাগরিকের ওপর সহিংসতা চালানো যে হয়, এ ব্যর্থতা সমাজের। কিন্তু সরকার ও রাষ্ট্রের দায় অনেক বেশি। এর আগে রামু থেকে নাসিরনগর, প্রতিটি ঘটনার ক্ষেত্রেই সহিংসতাকারীদের আইনের আওতায় আনা হয়নি। এসব ঘটনায় সরকারের তরফ থেকে ষড়যন্ত্র তত্ত্বকে সামনে আনা হয়েছে। কিন্তু কখনোই সামনে আনা হয়নি সাম্প্রদায়িক বিভাজন সৃষ্টির পরিকল্পনাকারী আসলে কারা।

সরকার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী হামলা ঠেকাতে এবারেও ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। তবে অন্যবারের তুলনায় আইনি পদক্ষেপের ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতা বেশি দেখা যাচ্ছে। এরই মধ্যে কুমিল্লার পূজামণ্ডপে কোরআন যিনি রেখে এসে সহিংসতার সূত্রপাত করেছিলেন, সেই অভিযুক্ত ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। পীরগঞ্জের সহিংসতায় ফেসবুকে যিনি প্রথম উসকানি দিয়েছিলেন, তাঁকেও গ্রেপ্তার করা হয়েছে। কিন্তু নজিরবিহীন এ সহিংসতা সৃষ্টির মূল পরিকল্পনাকারী কারা, তা নিয়ে ধোঁয়াশা কাটার কোনো আলামত নেই।

জাতিগত ও সাম্প্রদায়িক সহিংসতার পেছনে যাঁরা থাকেন, তাঁরা যে দল বা মতাদর্শেরই হোক, খুঁজে বের করে আইনের আওতায় আনা জরুরি। জনগণের সামনে তাঁদের অপরাধের সবিস্তার উপস্থাপন করাও জরুরি। কিন্তু এসব মানবতাবিরোধী অপরাধের ঘটনা শুধু রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দমন করার হাতিয়ার করা হলে, তা কারও কারও জন্য স্বল্পমেয়াদে রাজনৈতিক জয়ের ক্ষেত্র হয়তো তৈরি করতে পারে; কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে এটা সমাজের জন্য পরাজয়ের নীতি। সে ক্ষেত্রে অগোচরের ধর্মান্ধ শক্তি সবার অদৃশ্যে বাড়তে বাড়তে বিকটাকার দৈত্য হয়ে ওঠার সুযোগ পাচ্ছে। একসময় তারা তাদের হিংসা-ঘৃণার মতাদর্শ দিয়ে বহুত্ববাদী সমাজের স্বাভাবিক সৌহার্দ্য ও বিকাশকে রুদ্ধ করে দেবে। রাজনৈতিক ব্যর্থতায় এ শক্তি স্পষ্টত শক্তি বাড়িয়েছে, তার নমুনা পাওয়া যাচ্ছে। রামু থেকে শুরু করে এর আগের সব কটি সহিংসতার ঘটনা স্থানীয় পর্যায়ে থাকলেও এবারে এর বিস্তার হয়েছে কমবেশি ১৬টি জেলায়।

ধর্ম পরিচয়ের রাজনীতির সঙ্গে বিচ্ছেদ ঘটিয়ে ১৯৫৫ সালে জাতীয়তাবাদী রাজনীতির যাত্রা শুরু করেছিল আওয়ামী লীগ। এ রাজনীতিই বাঙালির জাতিরাষ্ট্রের ভিত গড়ে দিয়েছিল। বাংলাদেশের মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আওয়ামী লীগ ঐতিহ্যগতভাবে অসাম্প্রদায়িক চেতনা লালন করে। কিন্তু সেই সংগঠনেই এমন ব্যক্তিরা কীভাবে সদস্য হচ্ছেন, যাঁরা সাম্প্রদায়িক সহিংসতা দেখেও নিষ্ক্রিয় থাকছেন, কিংবা ধর্মান্ধদের সঙ্গে নিয়ে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার নেতৃত্ব দিচ্ছেন?

এবারের সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনায় সরকার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কি রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে শায়েস্তা ও অজ্ঞাতনামাদের বিরুদ্ধে মামলার সেই পুরোনো ছকেই ঘুরপাক খাচ্ছে? স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এরই মধ্যে বলেছেন, এমন নামও শুনবেন, যাঁরা আপনাদের খুবই পরিচিত ব্যক্তি। ১৩ অক্টোবর কুমিল্লা শহরের নানুয়া দিঘির উত্তর পাড়ের অস্থায়ী পূজামণ্ডপে উদ্ভূত পরিস্থিতিকে কেন্দ্র করে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার সূত্রপাত হয়। ২৫ অক্টোবর প্রথম আলোয় প্রকাশিত প্রতিবেদন বলা হচ্ছে, কুমিল্লার ঘটনার চাঁদপুর, নোয়াখালী, ফেনী, রংপুরসহ দেশের ১৬ জেলায় এ সহিংসতা ছড়ায়। হামলার ঘটনায় দায়ের করা ৮৫টি মামলায় ২৩ হাজার ৯১১ জনকে আসামি করা হয়েছে। এর মধ্যে ৬৮৩ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আসামি ও গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের মধ্যে বিএনপি-জামায়াত ও ছাত্রলীগের নেতা-কর্মী রয়েছেন। আবার রাজনৈতিক পরিচয় নেই, এমন অনেককে এসব মামলায় আসামি ও গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তবে প্রায় ২৪ হাজার আসামির বেশির ভাগই অজ্ঞাতনামা বলে মামলার এজাহার পর্যালোচনায় দেখা গেছে।

সাম্প্রদায়িক সহিংসতাকে একমাত্রিকভাবে দেখার সুযোগ নেই। এর সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, মনস্তাত্ত্বিক নানা পরিপ্রেক্ষিত রয়েছে। যদিও রাজনীতিতেই এটি প্রধানভাবে পুষ্ট হয়। কিন্তু পুরো প্রপঞ্চটাকে শুধু রাজনীতির ছকে ফেলে দেওয়া হলে মূল সমস্যার গভীরে কখনোই পৌঁছানো যাবে না। বরং ঘৃণা, ধর্মান্ধতা নিজেদের ঘাড়ের ওপর সিন্দাবাদের ভূতের মতো চেপে বসার সুযোগ তৈরি হবে।

সাম্প্রদায়িক সহিংসতার শিকার অঞ্চলগুলো থেকে প্রথম আলোয় প্রকাশিত কিছু সরেজমিন প্রতিবেদন থেকে এটা স্পষ্ট হয়েছে যে, নেতা কর্মীদের নিষ্ক্রিয়তা, দলীয় প্রস্তুতি না থাকা ও বিরোধের ফলে শাসক দল সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ঠেকাতে ভূমিকা পালন করতে পারেনি। এর থেকেও গুরুতর অভিযোগ পাওয়া গেছে রংপুরের পীরগঞ্জে। সেখানে মাঝিপাড়ায় গরিব জেলেদের বাড়িঘর পুড়িয়ে ছাই করে দেওয়া এবং লুটপাটের ঘটনায় মূল অভিযুক্ত ছাত্রলীগ নেতা। র‍্যাবের হাতে তিনি গ্রেপ্তার হন। সংবাদ সম্মেলনে র‍্যাব জানায়, পীরগঞ্জের বড় করিমপুরে হিন্দুপাড়ায় হামলা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় সৈকত মণ্ডল (২৪) নামের একজন নেতৃত্ব দেন। ফেসবুকে বিভিন্ন ধরনের উসকানিমূলক মন্তব্য এবং মিথ্যা পোস্টের মাধ্যমে গুজব ছড়িয়ে স্থানীয় লোকজনকে উত্তেজিত করেন তিনি। ঘটনার দিন একটি মসজিদ থেকে মাইকিং করে উসকানিমূলক বক্তব্য দিয়ে স্থানীয় লোকজনকে জড়ো করেন তাঁর সহযোগী রবিউল ইসলাম (৩৬)। এরপরই হামলা চালানো হয়।

সৈকতের রাজনৈতিক পরিচয় সম্পর্কে গণমাধ্যমের সংবাদ থেকে জানা যায়, তিনি কারমাইকেল কলেজের দর্শন বিভাগের স্নাতকোত্তর শ্রেণির ছাত্র। তিনি ওই বিভাগে ছাত্রলীগের কমিটির ১ নম্বর সহসভাপতি। ২০১৭ সালের ৮ আগস্ট ওই কমিটির অনুমোদন দেন কলেজ ছাত্রলীগ কমিটির সভাপতি সাইদুজ্জামান সিজার ও সাধারণ সম্পাদক জাবেদ আহমেদ।

‘অজ্ঞাত সংখ্যা’কে প্রতিপক্ষ বানানো সহজ। কিন্তু এর বিপদ হচ্ছে, সমাজের যে কাউকেই এতে প্রতিপক্ষ বানিয়ে দেওয়া যায়। সমাজের শুভবোধসম্পন্ন মানুষ ও প্রতিবাদীরাও এতে বিভ্রান্ত হয়ে পড়েন। বিভ্রান্তির এই বৃত্তের বাইরে ধর্মান্ধ মতাদর্শ পুষ্ট হতেই থাকে। আর সেই মতাদর্শ বাড়তে বাড়তে সব রাজনৈতিক পক্ষকেই গ্রাস করে।

এ ঘটনার রেশ কাটত না কাটতেই গত রোববার টেকনাফে হোয়াইক্যং ইউনিয়ন পরিষদের ১ নম্বর কাটাখালী ওয়ার্ডে চাকমাপল্লিতে হামলা ও পিটিয়ে আহত করার পাশাপাশি এবং তাঁদের বৌদ্ধমন্দির ভাঙচুর এবং রান্নাঘর ও ধ্যানকক্ষে আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদের সূত্রে জানা যায়, এতে নেতৃত্ব দেন তোফায়েল হোসেনসহ ১৩ জন। এ ঘটনায় মূল অভিযুক্ত সম্রাট কাটাখালী ওয়ার্ড ছাত্রলীগের সভাপতি বলে স্থানীয় লোকজনের বরাত দিয়ে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ হয়েছে। যদিও হামলাকারী তাদের সংগঠনের নন বলে যথারীতি দাবি করেছে ছাত্রলীগ।

ধর্ম পরিচয়ের রাজনীতির সঙ্গে বিচ্ছেদ ঘটিয়ে ১৯৫৫ সালে জাতীয়তাবাদী রাজনীতির যাত্রা শুরু করেছিল আওয়ামী লীগ। এ রাজনীতিই বাঙালির জাতিরাষ্ট্রের ভিত গড়ে দিয়েছিল। বাংলাদেশের মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আওয়ামী লীগ ঐতিহ্যগতভাবে অসাম্প্রদায়িক চেতনা লালন করে। কিন্তু সেই সংগঠনেই এমন ব্যক্তিরা কীভাবে সদস্য হচ্ছেন, যাঁরা সাম্প্রদায়িক সহিংসতা দেখেও নিষ্ক্রিয় থাকছেন, কিংবা ধর্মান্ধদের সঙ্গে নিয়ে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার নেতৃত্ব দিচ্ছেন? অস্বীকার কিংবা বহিষ্কার কিংবা অন্য দল থেকে এসে ষড়যন্ত্র করেছে—বহু ব্যবহৃত এই কৌশল কী আদৌ সমস্যার গভীরে পৌঁছতে সহযোগিতা করে? নীতি-আদর্শকে সমাহিত করে শুধু ‘সহমত ভাইদের’ সংখ্যা বাড়ানো কিংবা ঠেসে পুড়ে সমাজের সব মতাদর্শের সুবিধাবাদীদের দলে ভেড়ার সুযোগ করে দেওয়ার সামাজিক ফলাফলটা কী হচ্ছে?

পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ থেকেই দেখা যাচ্ছে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ধর্মীয় ও সাম্প্রদায়িক উসকানি দেওয়ার সঙ্গে জড়িত অনেককে ছাত্রলীগ, যুবলীগ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। এমনকি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে হিন্দুদের ঘরবাড়ি ও মন্দিরে হামলা-ভাঙচুর মামলার চার্জশিটভুক্ত তিন আসামিকে ইউপি নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে মনোনয়ন দিয়েছিল আওয়ামী লীগ। পরে সমালোচনার মুখে সেই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে দলটি।

‘অজ্ঞাত সংখ্যা’কে প্রতিপক্ষ বানানো সহজ। কিন্তু এর বিপদ হচ্ছে, সমাজের যে কাউকেই এতে প্রতিপক্ষ বানিয়ে দেওয়া যায়। সমাজের শুভবোধসম্পন্ন মানুষ ও প্রতিবাদীরাও এতে বিভ্রান্ত হয়ে পড়েন। বিভ্রান্তির এই বৃত্তের বাইরে ধর্মান্ধ মতাদর্শ পুষ্ট হতেই থাকে। আর সেই মতাদর্শ বাড়তে বাড়তে সব রাজনৈতিক পক্ষকেই গ্রাস করে। সাম্প্রদায়িক সহিংসতাকারীরা কেন আওয়ামী লীগে, সে প্রশ্ন কী দলটির নীতিনির্ধারকেরা নিজেদের করবেন?

মনোজ দে প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক