সিআইএর ড্রোন-যুদ্ধের শঙ্কা কাটছে না

ওবামার আমলে ড্রোন হামলায় হত্যার ঘটনা বেড়েছিলছবি: রয়টার্স

আমেরিকান সাংবাদিক স্পেনসার একেরম্যান এবং তাঁর সহযোগী চলচ্চিত্র নির্মাতা লারা পিত্রাস সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের ড্রোন অভিযান বিষয়ে একটি নথি প্রকাশ করেছেন। আমেরিকার জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থার সাবেক সদস্য এডওয়ার্ড স্নোডেন প্রথম এ নথি ফাঁস করেছিলেন।

নথিটা ছিল ইনটেলিপিডিয়া নিয়ে লিখিত একটি নিবন্ধ। ইনটেলিপিডিয়া যুক্তরাষ্ট্রের এমন একটি তথ্যসংক্রান্ত ওয়েবসাইট, যেখানে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের তথ্য যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দারা সংরক্ষণ করেন। এটার শিরোনাম হচ্ছে, ‘লক্ষ্য নির্ধারণ করে হত্যা: নীতি, আইন ও নৈতিক বিতর্ক’। যেসব মানবাধিকারকর্মী ও সংস্থা বিশ্বজুড়ে যুক্তরাষ্ট্রের ড্রোন-যুদ্ধ বন্ধে কাজ করছেন, তাঁদের কীভাবে নজরদারি করা হয়, সেটার তথ্য সেখানে আছে।

মানবাধিকার নিয়ে কাজ করার কারণে আমার সব সময়ই মনে হতো গোয়েন্দারা আমাকে অনুসরণ করছে। এ কারণে আমার স্ত্রীকে যখন মেইল করতাম, সেই মেইলের নিচে গোয়েন্দাদের উদ্দেশে মাঝেমধ্যেই মজা করে লিখে দিতাম, বিরক্ত করার জন্য ক্ষমা চাইছি। তবে নথিটি প্রকাশিত হওয়ার পর আমার সেই সন্দেহটা বাস্তবে রূপ পেল।

জন রিজও নামে সিআইএর একজন কর্মকর্তা পাকিস্তানের সীমান্ত অঞ্চলে অবৈধ যুদ্ধ করার জন্য বিচারের মুখোমুখি হয়েছিলেন। এ-সংক্রান্ত আইনি লড়াই করতে গিয়ে আমি তাঁর সম্পর্কে জানতে পারি। ২০১১ সালে নিউজউইককে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে খুব বোকার মতো তিনি ওই ঘটনার স্বীকারোক্তি দিয়েছিলেন। আমি কখনোই আশা করিনি, পলাতক আসামি রিজওকে যুক্তরাষ্ট্র বিচারের জন্য পাকিস্তানের কাছে ছেড়ে দেবে। কিন্তু তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বেশ কয়েক বছর ধরে সেখানে সিআইএর অভিযান পরিচালনার নির্দেশ দিয়েছিলেন। ড্রোন হামলার মাধ্যমে ওই অঞ্চলে স্পষ্টত মানবাধিকার লঙ্ঘন করা হয়েছে। সেখানে নির্বিচার মানুষ হত্যা করা হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের খুব গুরুত্বপূর্ণ জোটসঙ্গী হওয়ার পরও পাকিস্তান ড্রোন হামলার প্রকাশ্য বিরোধিতা করেছে। তবে বিপরীত চিত্রটাও ছিল। স্নোডেনের ফাঁস করে দেওয়া আরেকটি নথিতে দেখা যাচ্ছে, ২০০৮ সালের আগস্ট মাসে পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বলছেন, ‘ঠিক ব্যক্তিকে খুঁজে পেতে তারা যতক্ষণ এটা (ড্রোন হামলা) করছে, তাতে আমি কিছু মনে করি না। আমরা আইনসভায় এর প্রতিবাদ করব, এরপর চুপ করে যাব।’ এই ভণ্ডামিটাও প্রকাশিত হওয়া দরকার।

অনুসন্ধানের অংশ হিসেবে আমি ড্রোন-যুদ্ধের শিকার পরিবারগুলোর সঙ্গে কথা বলেছি। সব ক্ষেত্রেই গল্পগুলো একই রকম। যুক্তরাষ্ট্রকে ‘সন্ত্রাসবাদীদের’ খোঁজ দিত ‘চরেরা’। এ জন্য তাদের মোটা অঙ্কের টাকা দেওয়া হতো। তথ্যদাতা যখন নগদ টাকা নিত, তখন তাদের সামনে দুটা পথই খোলা ছিল—হয় ঝুঁকি নিয়ে সত্যটা বলে দেওয়া, সত্যিকারের বিপজ্জনক লোকের সন্ধান দেওয়া; না হয় মিথ্যা বলা কিংবা নির্দোষ কাউকে দেখিয়ে দেওয়া। খুব স্বাভাবিকভাবেই নিরাপদ পথটাই তারা বেছে নিত।

সিআইএ ভয়াবহ ভুল করেছে, এমন দৃষ্টান্ত ভূরি ভূরি। ২০০৬ সালের ৩০ অক্টোবর, একটি বিদ্যালয়ে ড্রোন হামলায় ৬৯ জনকে হত্যা করা হয়। ওই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষককে ‘জঙ্গি’ মনে করে অনুসরণ করা হচ্ছিল। ২০০৯ সালের ২৩ জুন একটি শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে ড্রোন হামলা করে কমপক্ষে ৮০ জনকে হত্যা করা হয়। কিন্তু বায়তুল্লাহ মেহসুদ নামে যাঁকে ‘লক্ষ্য’ করে হামলাটি করা হয়, তিনি সেখানে ছিলেন না। আমি বারাক ওবামাকে ভোট দিয়েছি। ২০০৮ সালে নির্বাচিত হওয়ার পর বুশ আমলের ‘বিনা বিচারে আটক ও নির্যাতনের নীতি’র অবসান হয়। কিন্তু ড্রোন থেকে মিসাইল হামলায় বিনা বিচারে হত্যার ঘটনা বাড়তে থাকে। ২০০৮ সালে বুশের সময় ওয়াজিরিস্তানে ড্রোন হামলা হয় ৩৬টি। কিন্তু ২০১০ সালে ওবামা যখন প্রথম বছর পূর্ণ করেন, তখন সেখানে হামলার ঘটনা বেড়ে দাঁড়ায় ১২২টি।

আমার জন্য সবচেয়ে আবেগঘন মুহূর্তটি আসে ২০১১ সালের নভেম্বরে। ইসলামাবাদে একটি হোটেলে একটি সম্মেলনে অতিথি হিসেবে গিয়েছিলাম। আমার সঙ্গে পাকিস্তানের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান ছিলেন। ড্রোন হামলায় গণহত্যার শিকার পরিবারগুলোর বেঁচে যাওয়া সদস্য ও বন্ধুদের সেখানে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। তারিক খান নামের ১৬ বছরের এক কিশোর আমাকে শুনিয়েছিল, কীভাবে তার স্কুলপড়ুয়া বন্ধুকে হত্যা করা হয়েছিল। ড্রোন হামলা যে অনৈতিক, সে বিষয়ে ওই সম্মেলনে বলিষ্ঠ বক্তব্য দেয় তারিক। আমি আমার বক্তব্যে বলেছিলাম, এখানে দর্শকদের মধ্যেই সিআইএর অর্থপুষ্ট চরেরা আছেন। তাঁরা দোষী-নির্দোষ নির্বিচার সব মানুষকে ‘চরমপন্থী’ হিসেবে চিহ্নিত করেন। তাঁদের গাড়ির পেছনে নজরদারি যন্ত্র লাগিয়ে দেন।

আমার এই সতর্কবার্তা ৭২ ঘণ্টার মধ্যে সত্যে পরিণত হয়েছিল। তারিক তার ১২ বছর বয়সী চাচাতো ভাইকে নিয়ে চাচার বাসায় যাওয়ার পথে ড্রোন হামলায় নিহত হয়। যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা ওই দুই কিশোরকে ‘জঙ্গি’ তকমা দিয়েছিলেন। এটা সত্য যে আমি এমন অনেক মানুষের প্রতিনিধিত্ব করছি, যারা আমার দেশ যুক্তরাষ্ট্রের নিশানায় রয়েছে। তাদের অনেকেই নির্দোষ নাগরিক। অনেকে শিশু। আমার খুব বেশি বিশ্বাস নেই যে আমাদের আইনি লড়াই এ ধরনের অপরাধ পুরোপুরি বন্ধ করতে পারবে। কিন্তু আমাদের লড়াইয়ের ফলে একটি অঞ্চলে ড্রোন-যুদ্ধ বন্ধ হয়েছে। কিন্তু বাকি বিশ্বে সে ভয়টা রয়েই গেছে।

আল-জাজিরা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ

ক্লাইভ স্টাফোর্ড স্মিথ মানবাধিকার আইনজীবী