সিইসি যা শেখাতে পারতেন ট্রাম্পকে

আমাদের নির্বাচন কমিশন ভালো ভোট গনৎকার
প্রথম আলো

ভারতবর্ষের গণিতবিদ ঋষি আর্যভট্ট ‘শূন্য’ বা ‘জিরো’ আবিষ্কার না করলে আমাদের গ্রামের নব্বই বছর বয়সী নবীরন বেগমের মতো হয়তো পশ্চিমের সাহেবসুবোকে আজও বলতে হতো ‘ওরে বাজান! আমি গুনতি পারিনে কিন্তুক কম পড়লে টের পাই’।

শূন্য আবিষ্কারের পর মানুষ আধুনিক পদ্ধতিতে গণনা করতে শিখেছে। ভারতীয়দের কাছ থেকে শেখা একটি শূন্যের এলেম মাথায় নিয়ে পশ্চিমা বিজ্ঞানীরা গণিতের জটিল জটিল সূত্র আবিষ্কার করেছেন। সাহেবরা যে এলেমহারাম নন, তা প্রমাণ করে আইনস্টাইন বলে রেখেছেন, ‘ভারতবর্ষের কাছে আমরা ঋণী, কারণ তারা আমাদের গুনতে শিখিয়েছে।’। আমরা যে ‘গুটিবাজির’ দিক থেকেও পশ্চিমাদের চেয়ে অনেক আগে থেকে এগোনো, তার প্রমাণ হলো এই ভারতবর্ষেই প্রথমে পাশা এবং পাশার ধারাবাহিকতায় দাবা খেলার জন্ম হয়েছে। এসব মূলত রাজরাজড়ার খেলা। ঘুঁটি চালাচালির দাবা খেলায় পাক্কা গণনা ছাড়া চাল দিলে রাজা আটকা পড়ে। তাতে রাজ্যেরও সাড়ে সর্ব্বনাশ হয়।

গোনাগুনতির বিষয়ে পশ্চিমের চেয়ে প্রাচ্যের মাথা যে পরিষ্কার, তা আরও একবার পরিষ্কার করেছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নূরুল হুদা। জাতীয় সংসদের ঢাকা-১৮ আসনের উপনির্বাচনে নিজের ভোট দেওয়ার পর সাংবাদিকদের তিনি বলেছেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র ৪ থেকে ৫ দিনে ভোট গুনতে পারে না। আমরা ৪ থেকে ৫ মিনিটে গুনে ফেলি। যুক্তরাষ্ট্রের আমাদের কাছে শেখার আছে। আবার যুক্তরাষ্ট্রের ভালো দিকগুলো থেকে আমাদেরও শেখার আছে।’

সিইসির কথায় বোঝা গেছে, তিনি দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত শিক্ষার বিশ্বজনীন তাগিদের একজন আপসহীন সমর্থক। তিনি মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্রের আমাদের কাছ থেকে শেখার আছে। প্রশ্ন উঠতে পারে—কী শেখার আছে? উত্তর নামতে পারে—গোনাগুনতি। ফচ করে ফের প্রশ্ন উঠতে পারে—কী গুনতে শেখার আছে? এবার উত্তর নামতে পারে—ভোট।

যুক্তরাষ্ট্রে হাজার হাজার প্রশিক্ষিত ভোটকর্মী থাকার পরও চূড়ান্ত ফল বের হতে চার–পাঁচ দিন সময় লাগল। তবুও মীমাংসা হয়নি। কারণ, সেখানকার ভোটকর্মীরা ভোট গোনায় একেবারেই নাবালেগ। সে তুলনায় আমাদের নির্বাচনকর্মীরা সুপারম্যান। কোন প্রার্থী কোন নির্বাচন বিধি লঙ্ঘন করলেন, তা তাঁরা সাধারণত গোনায় ধরেন না, কিন্তু তাঁরা ভোট গোনেন সুপারসনিক গতিতে। সিইসির ভাষ্যমতে, চার থেকে পাঁচ মিনিটের মধ্যে দেখা যায় ‘রাশি রাশি ভারা ভারা ভোট গোনা সারা’। এরপর সিইসি অনেকগুলো টেলিভিশন ক্যামেরার সামনে বসে সুললিত কণ্ঠে বলেন, ‘নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে।’

যুক্তরাষ্ট্র সারা বিশ্বের ‘প্রভাবশালী’ দেশ হওয়ার পরও তাদের ভালো গণৎকার ভোটকর্মী নেই—এটি হতাশার কথা। আমাদের সে অবস্থা নেই। আমাদের নির্বাচন কমিশন ভালো ভোট গনৎকার। এই গণৎকার চার–পাঁচ মিনিটে ভোট গুনেটুনে ‘টাকা ঝন ঝন ঝনৎকার বাজায়ে সে যায় চলি।’

‘যুক্তরাষ্ট্রের বাংলাদেশের কাছ থেকে শেখার আছে’ বলে সিইসি ভোট গণনায় যুক্তরাষ্ট্রের ধীরগতি এবং আমাদের সুপারসনিক গতির তুলনা করেছেন। অর্থাৎ উচ্চ গতির গণনাপদ্ধতি বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের ইমপোর্ট করা উচিত বলে তিনি অভিমত দিয়েছেন। তিনি অবশ্য এই পদে যোগ দেওয়ার পর থেকেই এই ধরনের দামি দামি অভিমত দিয়ে জাতির মনোভূমিকে ঋদ্ধ করে আসছেন।

এর আগে গত ৯ মার্চ আগারগাঁওয়ে নির্বাচন প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটে নির্বাচন কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ কর্মশালায় সিইসি বলেছিলেন, ‘ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) ভোট হলে ভোটের আগের রাতে ব্যালট বাক্স ভরে রাখার কোনো সুযোগ থাকবে না।’ তিনি ওই দিন বলেছিলেন, ‘সমাজের মধ্যে অনিয়ম ঢোকে। তা প্রতিহত করতে পদক্ষেপ নিতে হয়। এ কারণে কমিশন ভাবছে ইভিএমে ভোট নেওয়া শুরু করবে।’

আগের রাতে ব্যালট বাক্স ভরে রাখার মতো ‘অনিয়ম’ ‘প্রতিহত’ করার মহতী ইচ্ছাপ্রসূত সেই ইভিএম মেশিনে গতকাল সিইসি ঢাকা-১৮ আসনের উপনির্বাচনে তিনি দিনের বেলায় নিজের ভোট দিয়েছেন। ভোটার উপস্থিতি কেন কম, তার জবাব সিইসি দিতে চাননি। এসব গোনার ভার তিনি বিশেষজ্ঞদের হাতে ছেড়ে দিয়েছেন। এই ভোটব্যবস্থায় তাঁর মতো আমাদেরও অতলস্পর্শী আস্থা। কারণ, আমরা ভালো করেই জানি, ‘এর পরেও বিশ্বাস, প্রণতি/ এর পরেও ঘুম আসবে চোখে/ এর পরেও বাকি আছে ক্ষতি/ এর পরেও ভোট দেবে লোকে।’

সারফুদ্দিন আহমেদ সাংবাদিক ও লেখক।

sarfuddin2003 @gmail. com