সিইসি সঠিক বলেননি

সিইসি কে এম নূরুল হুদা। প্রথম আলাে ফাইল ছবি
সিইসি কে এম নূরুল হুদা। প্রথম আলাে ফাইল ছবি

বিস্ময়কর কিছু কথা বললেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নূরুল হুদা। তাঁর এবারের বক্তব্য—ভোট দিতে গিয়ে কেউ করোনায় মারা গেলে দায় কমিশনের নয়। মনে হচ্ছে তিনি ‘নয়’ শব্দটি বেশি বলে ফেলেছেন। তিনি সাহস করে বলতে পারেন, ভোট দিতে গিয়ে কেউ করোনায় মারা গেলে এর দায় নির্বাচন কমিশনেরই! এই কথাটি বলেছেন তিনি সেই এলাকার উপনির্বাচন নিয়ে, যাকে এককথায় বলা যায় করোনা ও বন্যা উপদ্রুত এলাকা।

দায় এড়াতে এড়াতে সিইসি এমন জায়গায় গেছেন যেখানে তাঁকে ‘নাচের পুতুল’ ছাড়া আর কিছু ভাবা যায় না। ভোটারকে ঘর থেকে ডেকে এনে মৃত্যুর দায়ও তিনি ভোটারের ওপর চাপাতে চান। এ প্রসঙ্গে প্রথম আলোর অনলাইনে একজন পাঠকের মন্তব্য হচ্ছে, ‘আপনি নিশ্চিন্তে থাকেন। জনগণ আপনাকে কোনো কিছুতেই দোষারোপ করবে না।’

কে এম নূরুল হুদা গত শনিবার বিকেলে বগুড়া-১ (সারিয়াকান্দি-সোনাতলা) আসনের উপনির্বাচন উপলক্ষে আইনশৃঙ্খলা-সংক্রান্ত সভা এবং নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের সঙ্গে আলাদা সভা করেন। এরপর সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাব দেন।

করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঝুঁকির মধ‍্যে এমন একটি উপনির্বাচন কেন করতে হবে? সিইসির যুক্তি, সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কারণেই এটা করতে হচ্ছে। আসন শূন্য হওয়ার পর থেকে তিন মাসের মধ্যে নির্বাচন করতে হয়, পরে আরও ৯০ দিন সময় পাওয়া যায়। মোট ১৮০ দিন পূর্ণ হওয়ার এক দিন আগে বন্যা ও করোনাভাইরাসের সংক্রমণের মধ্যে ১৪ জুলাই বগুড়া ও যশোরে উপনির্বাচনের ভোট গ্রহণ করা হচ্ছে। এ প‍্রসঙ্গে সিইসির যুক্তি হচ্ছে, ভোট পেছানোর সুযোগ নেই। সংসদ নির্বাচন নিয়ে সংবিধানের বাইরে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই।

কত্ত বড় বাধ‍্যবাধকতা ওনার! একদিকে সংসদীয় আসনের নির্বাচন, আরেক দিকে সংবিধান। অতএব, মানুষ মারা যায় যাক, ওনাকে নির্বাচনটি করতেই হবে। কারণ তাঁর কাছে জীবনের চেয়ে ভোট এখন বড়।

তবে সিইসি যে বাধ্যবাধকতার কথা বলেছেন, তা সঠিক নয়। কারণ সংবিধানে নির্বাচন কমিশনকে যথেষ্ট ক্ষমতা দেওয়া আছে। সংবিধান বলেছে, সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করার জন্য যা যা করা দরকার, তা ইসি করবে। এখনকার এই পরিস্থিতিতে সেই নির্বাচন করার পরিবেশ নেই। এই পরিস্থিতিতে ইসি নির্বাচন পেছানোর সিদ্ধান্ত নিতে পারে, অথবা রাষ্ট্রপতির মাধ্যমে সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শ নিতে পারে। এমনকি ইসি সরাসরি সুপ্রিম কোর্টের কাছেও যেতে পারে।

এ প্রসঙ্গে সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার (অব.) সাখাওয়াত হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, নির্বাচন করতেই হবে—এমন বাধ্যবাধকতা নেই। অনেকগুলো বিকল্প সুযোগ বা ব্যাখ্যা আছে। সংবিধানে যে বাধ্যবাধকতার কথা বলা আছে তা বন্যা, ঝড় বা ভূমিকম্পের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের বিষয়টি মাথায় রেখে। তখন তো আর করোনার মতো অতিমারি ছিল না। তিনি আরও বলেন, ইসি যদি বিকল্প পথে না যায়, তাহলে কার কী করার আছে? নির্বাচন পদ্ধতির তো বারোটা এমনি বেজে গেছে। এখন অবস্থাটা হচ্ছে—কার কী করার আছে?

এর আগে করোনাভাইরাস সংক্রমণ পরিস্থিতির মধ্যে নির্বাচন কমিশন ২০ জুলাইয়ের মধ্যে কোনো ধরনের ভোট না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। গত ১ জুন অনুষ্ঠিত কমিশনের জরুরি সভায় বলা হয়, করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হলে এ সময়সীমা আরও বাড়তে পারে। এর ফলে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন, জাতীয় সংসদের চারটি উপনির্বাচনসহ স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের শতাধিক নির্বাচন হবে না বলে ধরে নেওয়া হয়।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশনার রফিকুল ইসলাম গণমাধ্যমকে বলেন, করোনা পরিস্থিতির মধ্যে কোনো নির্বাচন করা সম্ভব হবে না। ভোট অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে আইনি কোনো জটিলতার প্রশ্ন এলে মহামান্য রাষ্ট্রপতির পরামর্শ নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। মহামান্য রাষ্ট্রপতি সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের মাধ্যমে যে পরামর্শ দেবেন, সেই অনুসারে পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

আমাদের দেশে সরকার চাইলে কত কিছুই তো হয়। এই তো গত বৃহস্পতিবার খুব তড়িঘড়ি করেই বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের চাকরির মেয়াদ বাড়াতে আইন সংশোধন করা হলো। এই পরিস্থিতির মধ্যে এটা যদি করা যায়, তাহলে প্রশ্ন: সুযোগ থাকলেও ভোটের দিন পেছানো যাবে না কেন? যদিও সাখাওয়াত হোসেনের মতে, সরকার ইসিকে কিছু বলবে না। কারণ বিরোধী প্রার্থী নেই, সরকারি দলের প্রার্থীই জিতবে। তাই এ নিয়ে সরকারের মাথাব্যথা থাকবে না, এটা ধরে নেওয়া যায়। তবে এখানে দায়দায়িত্বটা মূলত ইসির।

সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে সিইসি আরও বলেছেন, ‘করোনা পরিস্থিতির মধ্যেও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নির্বাচন হয়েছে, ফলে আমাদের দেশেও নির্বাচন হওয়াতে কোনো অসুবিধা নেই। স্বাস্থ্যবিধি মেনে ভোট গ্রহণের আয়োজন করা হয়েছে।’

করোনার মধ্যে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নির্বাচন হওয়া সম্পর্কে সিইসি যা বলেছেন তা সত্য হলেও বিস্ময়কর বটে। এটা এমন একটি উপনির্বাচন, যেখানে বিরোধী দলের অংশগ্রহণ পর্যন্ত নেই। করোনার মধ্যে গত ২১ মার্চ অনুষ্ঠিত ঢাকা-১০ আসনের উপনির্বাচনের কথা আমরা ভুলে যাইনি। ওই নির্বাচনে ভোট পড়েছিল মাত্র ৫ দশমিক ২৮ শতাংশ। ওই আসনে মোট ভোটার ছিলেন ৩ লাখ ২১ হাজার ২৭৫। এর মধ্যে আওয়ামী লীগের প্রার্থী শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন নৌকা প্রতীকে পেয়েছিলেন ১৫ হাজার ৯৯৫ ভোট। বিএনপির প্রার্থী শেখ রবিউল আলম ধানের শীষ প্রতীকে পেয়েছিলেন ৮১৭ ভোট। আর জাতীয় পার্টির প্রার্থী মো. শাহ্জাহান লাঙ্গল প্রতীকে ৯৭ ভোট পেয়েছিলেন। ওই নির্বাচনের পর করোনাকালে ইসি আর কোনো নির্বাচনের আয়োজন করতে পারে, এটা ছিল ধারণারও বাইরে।

বগুড়ার উপনির্বাচন উপলক্ষে সিইসি আরও যা বলেছেন তা হচ্ছে—করোনাভাইরাসের সংক্রমণের ঝুঁকির মধ্যেই ভোট গ্রহণ করতে হবে। এ জন্য ভোট গ্রহণের দায়িত্বে নিয়োজিতদের মাস্ক, হ্যান্ড গ্লাভসসহ সুরক্ষা সামগ্রী সরবরাহ করা হবে। ভোটকেন্দ্রে সাবান ও হ্যান্ড স্যানিটাইজার রাখতে হবে, যাতে ভোটাররা হাত ধুয়ে ভোট দিতে পারেন। ভোটারদের মাস্ক পরে ভোট দিতে যেতে বলেছেন। তবে ভোটকেন্দ্রের ভেতরে মাস্ক খুলে চেহারা দেখানোর বিষয়টি মনে করিয়ে দিয়েছেন সিইসি।

সিইসির এই বক্তব্য প্রসঙ্গে প্রথম আলোর অনলাইনে একজন পাঠকের মন্তব্য হচ্ছে, ‘বুঝলাম, আপনার ভোটের প্রয়োজন নেই, জাস্ট আনুষ্ঠানিকতা! কিন্তু আমার মাকে যে ভোটের ডিউটি দিয়েছেন, আমার সেই উদ্বেগ কমাবে কে?’ আরেকজন পাঠকের মন্তব্য, ‘আপনার সময় কোনো ভোটার ভোট দিতে যাবে না। চিন্তা করবেন না।’

শুধু করোনা নয়, বর্তমান বন্যা পরিস্থিতির কারণে বগুড়ার সোনাতলা উপজেলায় তিনটি ও সারিয়াকান্দি উপজেলায় সাতটি কেন্দ্রে ভোট গ্রহণ করা সম্ভব নয়। এসব কেন্দ্র অন্যত্র স্থানান্তর করা হয়েছে। বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হলে প্রয়োজনে যে কেন্দ্র জলমগ্ন হবে সেগুলো সরিয়ে নেওয়া হবে। তবু নির্বাচন করতেই হবে। তার মানে করোনাভাইরাস, বন্যা, মানুষের জীবন—সবকিছুর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে এই উপনির্বাচন। ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী সাহাদারা মান্নানসহ পাঁচজন প্রার্থী অংশ নিচ্ছেন। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ও বন্যার মধ্যে ১৪ জুলাই নির্বাচনের ঘোষণা দেওয়ায় বিএনপি এই নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেয়। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক আবদুল মান্নানের মৃত্যুতে গত ১৮ জানুয়ারি আসনটি শূন্য হয়। সোনাতলা ও সারিয়াকান্দি উপজেলা মিলে গঠিত এই আসনে মোট ভোটার ৩ লাখ ৩০ হাজার ৯৯৩ জন।

এবার কিন্তু পূর্ণাঙ্গভাবে পবিত্র হজ হচ্ছে না। ঢাকা সিটি করপোরেশন কোরবানির পশুর হাট কমিয়ে ফেলেছে, শহরের বাইরে নিয়ে যাচ্ছে, অনলাইনে গরু কেনার বিষয়টি জোর দেওয়া হচ্ছে। ঈদুল আজহার জামাত ঈদগাহে অনুষ্ঠিত হবে না। জরুরি বিষয় ছাড়া সবকিছুই এখন থেমে আছে। বলা হচ্ছে, বেঁচে থাকাটাই সবার আগে, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। বগুড়া বা যশোরের দুটি উপনির্বাচন কি হজ, ঈদের জামাত, পশুর হাট বা জীবনের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ?

শরিফুজ্জামান: সাংবাদিক