সিকি শতাব্দী পর একীভূত জার্মানির হালচাল

গত বছরের গ্রীষ্মে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে যখন লাখ লাখ শরণার্থী জার্মানিমুখী হয়েছিলেন, তখন দেশটির চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মেরকেলের সেই বিখ্যাত উক্তি ‘ভিয়ার শাফেন দাস’ অর্থাৎ ‘আমরা পারব’ বারবার ঘুরেফিরে জার্মানি বা ইউরোপের রাজনৈতিক আলোচনায় আসছে। দুই জার্মানির বিভক্তির ৪০ বছর পর গত বছর একীভূত জার্মানির ২৫ বছর পূর্তির প্রাক্কালে তাঁর এই বক্তব্য শুধু কথার কথা ছিল না—এ ছিল বিশ্বযুদ্ধোত্তর জার্মান রাজনীতির ধারাবাহিকতা।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দায়ভার গ্রহণ করা এই জাতি সেই ১৯৪৯ সালেই মানবিক কারণে যেকোনো মানুষ বিপদাপন্ন হলে তাকে আশ্রয় দেওয়ার ব্যাপারটি শাসনতন্ত্রে অন্তর্ভুক্ত করে। আরও পরে ১৯৬৭ সালে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক ঘোষণাপত্র বা জেনেভা সনদপত্রে ১৪৭টি দেশ শরণার্থীবিষয়ক প্রস্তাবে স্বাক্ষর করে। তাই সিরিয়া ও মধ্যপ্রাচ্য থেকে আগত শরণার্থীদের আশ্রয় দিতে জার্মানি সবচেয়ে অগ্রগামী। চ্যান্সেলর মেরকেল গত মাসে জার্মান পার্লামেন্টে বলেন, শরণার্থীরা আসায় জার্মান ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির পরিবর্তন ঘটবে না।
একীভূত জার্মানি কেমন চলছে, এগোচ্ছে না পিছিয়ে যাচ্ছে! সে আলোচনা করতে গেলে একটি দেশ ও জাতির সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ইতিহাস—সব বিষয়ই বিবেচনায় রাখতে হয়। প্রায় ৭১ বছর আগে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানরা প্রায় সমগ্র ইউরোপ দখল করে ফেলেছিল। প্রায় ছয় কোটি মানুষের মৃত্যু আর ইউরোপজুড়ে ধ্বংসলীলার চিহ্ন রেখে ১৯৪৫ সালের ২ সেপ্টেম্বর বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়। কিন্তু যুদ্ধের ক্ষতচিহ্ন রয়ে যায় ইউরোপীয় জাতিসত্তাগুলোর মধ্যে।

>দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী ৪০ বছর পৃথক রাজনীতি আর অর্থনীতি নিয়ে যে জাতি বিভক্ত হয়ে গিয়েছিল, ঐক্যবদ্ধ হওয়ার পর সেই জাতি সিকি শতাব্দী পার করে কতটুকু এগোল?

জাতিগত অবিশ্বাসবোধ এবং পুঁজিবাদ ও সমাজবাদে বিভক্ত হয়ে যায় ইউরোপের অনেক দেশ। তবে জার্মানি বিভক্ত হয় পূর্ব ও পশ্চিম জার্মানি নাম নিয়ে। নব্বইয়ের দশকে পূর্ব ইউরোপের সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোতে অধিকতর গণতন্ত্র ও নাগরিক অধিকারের আন্দোলন শুরু হলে তার ঢেউ এসে লাগে পূর্ব জার্মানিতেও। ১৯৮৯ সালের ৮ নভেম্বর পূর্ব জার্মানির কমিউনিস্ট পার্টির সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্যরা পদত্যাগ করেন। আর এর মধ্য দিয়ে ভেঙে পড়ে পূর্ব জার্মানির সরকার, আর ৯ নভেম্বর ভেঙে যায় বার্লিনকে বিভক্ত করে রাখা ২৮ বছর আগের তৈরি প্রাচীর। ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা থাকায় পশ্চিম না দেখা যুদ্ধ-পরবর্তী প্রজন্ম বাঁধভাঙা আনন্দে ছুটতে থাকে পশ্চিমের পানে; আর পশ্চিমের মানুষেরা ছোটে পূর্বের দিকে—দীর্ঘদিনের না দেখা বন্ধু-স্বজন আর কেউবা ফেলে আসা অতি পরিচিত অতীতকে ফিরে পেতে। পুঁজিবাদ আর সমাজতন্ত্রের সব রক্তচক্ষু, আইনের বেড়াজাল শিথিল ও ম্লান হয়ে যায় জার্মানিবাসীর মহামিলনে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মিত্রশক্তি রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সের সেনাবাহিনীর যুদ্ধোত্তর জার্মানিতে অবস্থানের কারণে চার মিত্রশক্তি ও দুই জার্মানির সম্মতিতে দুই জার্মানি একীভূত হয়। ১৯৯০ সালের ৩ অক্টোবর বার্লিন প্রাচীরের কোলঘেঁষে বা বার্লিন তোরণের পাশেই ঐতিহাসিক জার্মান সংসদ ভবনের সামনের খোলা মাঠে ঐক্য-প্রক্রিয়ার বর্ণাঢ্য আয়োজন সম্পন্ন হয়।
৪৫ বছর ধরে এই দুই ধরনের সমাজতান্ত্রিক ও ধনবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে এক করে এগিয়ে যাওয়ার ব্যাপারটি দুরূহ ছিল। পূর্ব জার্মানিতে সমাজতান্ত্রিক ধাঁচের অর্থনীতির প্রচলন থাকলেও তা ছিল পূর্ব ইউরোপীয় দেশগুলোর মধ্যে সেরা। যদিও পুঁজিবাদের সমর্থকেরা তা মানেন না। আর পশ্চিমের অর্থনীতি পুঁজিবাদী হলেও সেখানে মানবিকতা ছিল। পশ্চিম জার্মানিতে একধরনের সামাজিক অর্থনৈতিক বাজারকাঠামো ছিল। সমাজতান্ত্রিক দেশ না হলেও তারা মানুষের মৌলিক চাহিদা যেমন খাদ্য, আবাস, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, বিদ্যুৎ ও জ্বালানির চাহিদা নিশ্চিত করেছিল। ফলে সেই ধাঁচেই এগোতে থাকে ঐক্যবদ্ধ জার্মানির অর্থনীতি।
তবে শুধু অর্থনীতি নয়; আইন, প্রশাসন, রাস্তাঘাট, শিল্পপ্রতিষ্ঠান, শিক্ষাব্যবস্থা—সবকিছুর আমূল পরিবর্তন ঘটানো হয়। আর এসব করতে পশ্চিমের নাগরিকদের দীর্ঘ ২৬ বছর ধরে সংহতি ভ্যাট প্রদান করতে হচ্ছে।
ঐক্যবদ্ধ জার্মানির অন্যতম কারিগর সাবেক চ্যান্সেলর হেলমুট কোল ১৯৯০ সালে বলেছিলেন, ‘আমরা পূর্বাঞ্চলে অর্থনীতির স্ফুরণ ঘটাব’। কিন্তু আদতে ব্যাপারটি এত সহজ ছিল না, তারপরও জার্মান রাজনীতিকদের দূরদর্শিতার কারণে ঐক্যবদ্ধ জার্মানির সংস্কার এগিয়ে নেওয়া হয়। জার্মানি এখন ইউরোপের বড় অর্থনৈতিক শক্তি। সদ্য প্রকাশিত এক পরিসংখানে দেখা যাচ্ছে, ২০১৬ সালে প্রথম ছয় মাসেই জার্মানির বার্ষিক বাজেট ব্যয়ের তুলনায় ১৮ দশমিক ৫ বিলিয়ন ইউরো অতিরিক্ত আয় হয়েছে। বিগত তিন বছরে অতিরিক্ত আয়ের ক্ষেত্রে এটাই সর্বোচ্চ রেকর্ড।
জার্মানির রাজনীতিকেরা বিগত বছরগুলোতে ইউরোপের অর্থনীতিকে সমন্বিতভাবে এগিয়ে নিতে সচেষ্ট হয়েছেন। এ জন্য তাঁরা নিজ দেশে সমালোচনার মুখে পড়লেও প্রায় দেউলিয়া হয়ে যাওয়া বা অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত দেশ গ্রিস, পর্তুগাল ও স্পেনে অর্থলগ্নি করেছেন। এতে জার্মানির কিছুটা লাভ থাকলেও ঝুঁকিটাও কম নয়। পরিবেশসচেতনতার কারণে ক্রমেই জার্মানির পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। মোট চাহিদার ২৯ শতাংশ বিদ্যুৎ তৈরি হচ্ছে সৌরশক্তি অথবা বায়ুর মাধ্যমে।
জার্মানিতে বসবাসরত অভিবাসীরা ক্রমেই মূলধারার রাজনীতিতে কিছু কিছু জায়গা করে নিচ্ছেন। সর্বশেষ ২০১৩ সালের পার্লামেন্ট নির্বাচনে ১১ জন তুর্কি এবং একজন সেনেগাল বংশোদ্ভূত সাংসদ নির্বাচিত হয়েছেন। সদ্য প্রকাশিত এক তথ্যে জার্মান কেন্দ্রীয় পরিসংখ্যান ব্যুরো জানায়, জার্মানির মোট জনসংখ্যার ২১ শতাংশ লোক জন্মগতভাবে জার্মানির নাগরিক নন, অর্থাৎ প্রতি পাঁচজনের মধ্যে একজন অভিবাসী। জার্মানির বর্তমান প্রেসিডেন্ট ও চ্যান্সেলর—দুজনেই সাবেক পূর্ব জার্মানির অধিবাসী ছিলেন। বিগত ২৬ বছরে ঐক্যবদ্ধ জার্মানিতে পূর্ব আর পশ্চিমের মধ্যে শতভাগ অর্থনৈতিক ও সামাজিক ভারসাম্য না এলেও বিভিন্ন খাতে প্রভূত উন্নতি হয়েছে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী ৪০ বছর পৃথক রাজনীতি আর অর্থনীতি নিয়ে যে জাতি বিভক্ত হয়ে গিয়েছিল, ঐক্যবদ্ধ হওয়ার পর সেই জাতি সিকি শতাব্দী পার করে কতটুকু এগোল? এ প্রশ্নের জবাবে বলা যায়, জার্মান জাতির নতুন প্রজন্মের রাজনীতিকেরা সব ভেদাভেদ ভুলে জার্মানির রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও সামাজিক ব্যবস্থাকে ধারাবাহিকভাবেই নতুন চৌহদ্দিতে নিয়ে এসেছেন। দুটি বিশ্বযুদ্ধ, বিভক্তি এবং আবার নতুন প্রত্যয়ে, নতুন প্রত্যাশায় সবাইকে এক করে অগ্রসরমাণ জার্মান জাতি বিশ্বের অন্যান্য জাতির জন্য দৃষ্টান্ত হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।
সরাফ আহমেদ: প্রথম আলোর হ্যানোভার (জার্মানি) প্রতিনিধি৷
[email protected]