সিটি নির্বাচন স্থগিত হচ্ছে না কেন?

অলংকরণ : তুলি
অলংকরণ : তুলি

চট্টগ্রাম নগরের পাড়া-মহল্লা, এমনকি ঘরে ঘরেও যাচ্ছেন প্রার্থীরা। সঙ্গে বিরাট কর্মী-সমর্থক বাহিনী। একজন মেয়র প্রার্থী এলেন তো কিছুক্ষণ পরই হয়তো কাউন্সিলর প্রার্থী। এক–একটি এলাকায় চার-পাঁচজন পর্যন্ত কাউন্সিলর পদপ্রার্থী আছেন। সুতরাং নগরের প্রতিটি ঘরে দিনে অন্তত একজন প্রার্থী যে সদলবলে জনসংযোগ করতে আসবেন, এটা প্রায় নিশ্চিত। এ ছাড়া প্রার্থীদের সবারই ন্যূনপক্ষে একটি কার্যালয় আছে (মেয়র প্রার্থীর ক্ষেত্রে আরও বেশি), সেখানে আড্ডা বা জটলা হচ্ছে, মিছিল-সমাবেশে লোকজন জড়ো হচ্ছে। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনের এই জোর প্রস্তুতি দেখে কে বলবে বিশ্বের আরও দেড় শতাধিক দেশের মতো এ দেশেও করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঘটেছে! কে বলবে সরকারের নানা মহল থেকে জনসমাগম, সভা-সমাবেশ বন্ধের নির্দেশনা দেওয়া হচ্ছে!

সরকার প্রথম থেকেই প্রয়োজনীয় সব প্রস্তুতি রয়েছে বলে আশ্বস্ত করে আসছে জনগণকে। আমাদের দেশ ইউরোপের চেয়েও কার্যকর উদ্যোগ নিয়েছে বলে প্রচার করতে দ্বিধা করছেন না কোনো কোনো জনপ্রতিনিধি। কিন্তু যাঁরা কিছুমাত্র খোঁজখবর রাখেন, তাঁরা জানেন এসব বক্তৃতা কতটা অসার ও বাস্তবতাবর্জিত। সত্যটা হচ্ছে, রোগের নমুনা পরীক্ষার জন্য আছে নগণ্যসংখ্যক কিট। বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসকেরা কতটুকু সুরক্ষিত, তা নিয়েও প্রশ্ন আছে। আক্রান্ত বিভিন্ন দেশের ভয়াবহ অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিলে বোঝা যায়, শুরুতে এর গুরুত্ব অনুধাবনে ব্যর্থ হলে চরম বিপর্যয়ের মুখোমুখি হতে হয়।

সরকারের পক্ষ থেকে জনসমাগম এড়িয়ে চলার কথা বলা হচ্ছে। ইতিমধ্যে স্কুল-কলেজ বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু জনসাধারণের মধ্যে এ নিয়ে খুব একটা সচেতনতা তৈরি হয়েছে বলে মনে হয় না। নইলে প্রার্থনার নামে বড় জনসমাবেশ করা বা সন্তানদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের সুযোগে ভ্রমণের পরিকল্পনা করত না এত মানুষ। আবার ‘অতিসতর্ক’ অন্য একদল ভবিষ্যতে বাজারে জরুরি পণ্যের ঘাটতি হতে পারে ভেবে বেশি বেশি পণ্যসামগ্রী কিনে বাজারকে অস্থিতিশীল করে তুলছেন। এর সবকিছুই যে প্রকৃত সচেতনতা ও নাগরিক বোধের অভাব, এতে কোনো সন্দেহ নেই। সুতরাং এ দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বড় আকার ধারণ করলে কী হতে পারে, তা সহজেই অনুমেয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) কঠোর পদক্ষেপ না নিলে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ায় পরিস্থিতি মারাত্মক হবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ৬৫০ কোটি ডলার (বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৫৫ হাজার ৯০০ কোটি টাকা) সহজ শর্তে ঋণ ঘোষণা করেছে। সব মিলিয়ে করোনাভাইরাসের সংক্রমণকে যে হালকাভাবে নেওয়ার সুযোগ নেই, সেই বার্তা আমরা পেয়েছি। এমনকি আমাদের হাইকোর্টও গত বুধবার (১৮ মার্চ) করোনাকে মহামারি ঘোষণা করে গেজেট প্রকাশ করার নির্দেশ দিয়েছেন। করোনাভাইরাস প্রতিরোধে সরকারের পদক্ষেপসমূহও জানাতে বলেছেন এক দিনের মধ্যে।

এ রকম একটি অবস্থার মধ্যেও চট্টগ্রাম নগরের মানুষ সিটি করপোরেশন (চসিক) নির্বাচনের প্রচারণায় অতিষ্ঠ। করমর্দন বা কোলাকুলি থেকে বিরত থাকার জন্য যতই নির্দেশনা প্রচার হোক, খোদ মেয়র বা কাউন্সিলর প্রার্থীরা যদি নিজের ঝুঁকি অগ্রাহ্য করে হাটে-মাঠে-বাজারে সাধারণ নাগরিকদের উদ্দেশে হাসিমুখে হাত বাড়িয়ে দেন, তাহলে নাগরিকের পক্ষে নিজের দুটি হাত লুকিয়ে রাখার উপায় কী? অর্থাৎ উভয় পক্ষ এ ক্ষেত্রে অসহায়। প্রার্থীরা সবাই যে খুব আনন্দ ও উৎসাহের সঙ্গে এ প্রক্রিয়ায় জড়িত আছেন তা নয়। চসিক নির্বাচনে বিএনপির মেয়র পদপ্রার্থী শাহাদাত হোসেন এক নির্বাচনী সভায় করোনাভাইরাসের কারণে মানুষের মধ্যে দ্বিধাদ্বন্দ্ব ও ভীতির কথা উল্লেখ করেছেন। নির্বাচন পেছানোর পক্ষে মত দিয়েছেন। রাজনীতিক পরিচয়ের বাইরে শাহাদাত একজন চিকিৎসক। সুতরাং ঝুঁকির কথাটা তাঁর মাথায় থাকা স্বাভাবিক। অবশ্য নির্বাচনী প্রচারণার শুরু থেকেই আওয়ামী লীগ প্রার্থী রেজাউল করিম চৌধুরীও এই ভাইরাস নিয়ে সতর্ক থাকার কথা বলে আসছেন জনসাধারণকে।

কিন্তু নির্বাচন কমিশনার অনড়। তারা সিটি করপোরেশন নির্বাচন প্রস্তুতি নিয়ে এগোচ্ছে। উপরন্তু করোনা পরিস্থিতিতে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে একটি নির্দেশনা দিয়েছে। এই নির্দেশনার শিরোনাম ‘জনস্বাস্থ্য নিরাপদ রেখে নির্বাচনী প্রচারণা পরিচালন।’ এতে বলা হয়েছে, প্রার্থীরা যেন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পরামর্শ অনুযায়ী নির্বাচনী প্রচারণার ক্ষেত্রে সভা-সমাবেশ, গণজমায়েত ইত্যাদি যতদূর সম্ভব পরিহার করে চলেন। এখানে প্রশ্ন ওঠে, ‘যতদূর সম্ভব’ মানে কতদূর? জমায়েত এড়িয়ে নির্বাচনী প্রচারের পরামর্শ অনেকটা শরীর না ভিজিয়ে জলে নামার প্ররোচনার মতো। আমার প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী যদি ভোটারের ঘরে ঢুকে মুরব্বির পায়ে ধরে সালাম করে তাঁর সঙ্গে কোলাকুলি করে ভোট প্রার্থনা করেন, সে ক্ষেত্রে আমি দূর থেকে সালাম জানালে চলবে? এখানে আচরণবিধির সমমাত্রা পর্যবেক্ষণ করবে কে?

চসিক নির্বাচন স্থগিত করা না–করা নিয়ে মতভিন্নতা আছে কাউন্সিলর পদপ্রার্থীদের মধ্যে। তাঁদের অধিকাংশই নির্বাচন না পেছানোর পক্ষে। তাঁদের এ অবস্থানের কারণ বোধগম্য। ইতিমধ্যে শ্রম-সময় ও অর্থ ব্যয় হয়েছে তাঁদের। কিন্তু শুধু সেই কারণটিকে প্রাধান্য দিয়ে যেনতেন প্রকারে নির্বাচন অনুষ্ঠান করলে স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি তো আছেই, উৎসাহ-উদ্দীপনার বদলে একটি দায়সারা কর্মকাণ্ডে পরিণত হবে এই নির্বাচন।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেকে নির্বাচন পেছানোর জন্য জোর প্রচারণা চালাচ্ছেন। সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) চট্টগ্রামের সাধারণ সম্পাদক আখতার কবির চৌধুরী প্রশ্ন তুলেছেন, ‘নির্বাচন গুরুত্বপূর্ণ, নাকি মানুষের জীবন?’ যেকোনোভাবেই হোক নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে ইসির আগ্রহ নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন এই আইনজীবী, ‘এটা হতে পারে দায়সারা গোছের একটা নির্বাচনের আয়োজন। অথবা নির্বাচনী ব্যয় বাজেট নিঃশেষ করার উদ্দেশ্য থাকতে পারে। স্থগিতাদেশের ঘোষণা আসতে যত দেরি, তত বেশি খরচ করতে পারে নির্বাচন কমিশন। কিন্তু এই টাকা তো জনগণের।’ (প্রথম আলো, ১৯ মার্চ)।
সিটি নির্বাচন স্থগিত হবে কি না, তা নিয়ে নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার বৃহস্পতিবার সকাল ১০টায় প্রার্থীদের সঙ্গে বৈঠক করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। কিন্তু বৈঠক বাতিল করে দিয়ে আগের দিন রাতেই ঢাকা ফিরে গেছেন।
নির্বাচন কমিশনের ভেতরও একধরনের অস্থিরতা, দ্বিধা-দ্বিমত ইত্যাদি আছে বলেই মনে হয়। কিন্তু জীবনের ঝুঁকির প্রশ্ন যেখানে, সেখানে তো দোদুল্যমানতার কোনো সুযোগ নেই।