সু চির পতনে খুশি হওয়ার কী আছে

অং সান সু চি

অং সান সু চির পতনে বাংলাদেশে অনেকেই খুশি হয়েছেন। এর একটা কারণ পরিষ্কার: গত কয়েক বছরে তাঁর বিরুদ্ধে বাংলাদেশের মানুষের মনে অনেক ক্ষোভ জমেছে। মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ওপর যে বর্বরতা চলেছে, তার দায় হয়তো দেশটির সেনাবাহিনীর, কিন্তু সেই দেশের প্রধান রাজনৈতিক নেতা হিসেবে সামনে হাজির ছিলেন সু চি। এবং বাংলাদেশের মানুষ এটাও দেখেছে যে তিনি নির্লজ্জভাবে এই অন্যায়-অবিচারকে সমর্থন করে গেছেন।

রোহিঙ্গাদের ওপর ঘটে যাওয়া মানবতাবিরোধী অপরাধ ও গণহত্যার বিচারকে নাকচ করতে তিনি নেদারল্যান্ডসের দ্য হেগে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে হাজির হয়েছিলেন। অভিযুক্ত সেনাবাহিনীর পক্ষে তিনি সাফাই গেয়েছেন। রোহিঙ্গাদের সম্পর্কে বিভিন্ন সময়ে তাঁর মুখে অনেক আপত্তিকর কথাও শোনা গেছে। এই জনগোষ্ঠীর প্রতি তাঁর বিদ্বেষ ও বর্ণবাদমূলক আচরণ এবং অবস্থান কোনো লুকানো বিষয় ছিল না। শান্তিতে নোবেল বিজয়ী একজন নেতা কীভাবে একটি জাতিগোষ্ঠীকে নিশ্চিহ্ন করার প্রক্রিয়ায় শামিল থাকেন, সেটা শুধু আমাদের নয়, বিশ্ববাসীকেও বিস্মিত করেছে।

মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর হাতে সু চির পতন আমাদের দেশের অনেকের কাছে তাই তাঁর ‘কৃতকর্মের’ ফল। অনেকেই মনে করেন, রোহিঙ্গাদের প্রতি যে অন্যায়, অবিচার ও অমানবিকতা হয়েছে, তার সমর্থক ও সহায়তাকারী হিসেবে সু চি তাঁর ‘পাপের ফল’ পেয়েছেন। এবং সে কারণেই তাঁরা খুশি। সু চি পাপ করেছেন, তাতে সন্দেহ নেই, এর জন্য শাস্তিও তাঁর নিশ্চয়ই পাওয়া উচিত। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, কাদের হাতে ‘শাস্তি’ পেলেন সু চি? আর এই শাস্তিটা তিনি কিসের জন্য পেলেন? এটা কি রোহিঙ্গা নিধনযজ্ঞে জড়িত বা সহায়তা করার জন্য পেলেন?

আমরা জানি, সু চি যাদের হাতে ‘শাস্তি’ পেয়েছেন, মিয়ানমারের সেই সেনাবাহিনী রোহিঙ্গা নিধনের মূল পরিকল্পনাকারী, তারাই রোহিঙ্গা হত্যাযজ্ঞ ঘটিয়েছে। সু চির এই ‘শাস্তির’ সঙ্গে রোহিঙ্গাদের জাতিগত নিধনযজ্ঞে তাঁর ভূমিকার কোনো সম্পর্ক নেই। তাহলে তাঁর পতনে বাংলাদেশে কেন কিছু মানুষ খুশি হয়েছেন?

বোঝা যায়, এটা আসলে একটা ‘প্রতিক্রিয়া’। যেকোনো ক্ষোভ থেকে আসা প্রতিক্রিয়ায় আবেগ কাজ করে বেশি। বাস্তবতা ও যুক্তি সেখানে অনেক সময় হারিয়ে যায়। তাই দেখা গেল, রোহিঙ্গা নিধনকারী মিয়ানমারের সেনাবাহিনী যখন অভ্যুত্থান করে দেশটির নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করল, তখন আমাদের দেশে কেউ কেউ খুশি হলেন। এখানে সংকটটি যে গণতন্ত্রের সঙ্গে সামরিকতন্ত্রের, তা সম্ভবত তখন অনেকের বিবেচনায় রইল না। রোহিঙ্গা ইস্যুতে সু চির ভূমিকায় আমরা নিশ্চয়ই ক্ষুব্ধ। কিন্তু সেই ক্ষোভের কারণে সেখানকার জনগণের ওপর চেপে বসা সামরিক শাসন কি কোনো বিবেচনায় সমর্থনযোগ্য হতে পারে?

ফেব্রুয়ারি মাসে সেনাবাহিনীর ক্ষমতা দখলের আগে সু চির দল এনএলডির সরকার কতটুকু ‘গণতান্ত্রিক’ ছিল, সেই প্রশ্ন কেউ তুলতে পারেন। দীর্ঘ ৪৯ বছরের সেনাশাসনের পর মিয়ানমারে ‘গণতন্ত্র’ ফিরেছে ২০১১ সালে। এর আগে ২০০৮ সালে সেনাবাহিনী এমন এক সংবিধান তৈরি করে, যেখানে সরকারে সামরিক বাহিনীর পুরো কর্তৃত্ব বজায় রাখা হয়। রাজ্য ও কেন্দ্রীয় পার্লামেন্টে সেনাবাহিনীর জন্য ২৫ ভাগ আসন সংরক্ষিত রাখা আছে এবং তাদের নিয়োগ দেন সেনাবাহিনীর প্রধান। জরুরি অবস্থা জারিসহ বেসামরিক সরকারকে নিয়ন্ত্রণের সব ক্ষমতাই রয়েছে সেনাবাহিনীর হাতে। এই সংবিধানকে সেই বিবেচনায় গণতান্ত্রিক সংবিধান বলা কঠিন।

এই বাস্তবতার কারণে জনগণের ভোটে নির্বাচিত সু চির দল এনএলডিকে (ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি) চলতে হয়েছে সেনাবাহিনীর কথামতোই। কিন্তু এমন একটি পরিস্থিতির মধ্যেও সু চি যে শক্তি অর্জন করেছেন, তার প্রমাণ গত নভেম্বরের নির্বাচনে এনএলডির ব্যাপক বিজয়। সেই নির্বাচনে সেনাবাহিনীর সমর্থিত দল ইউএসডিপির (ইউনিয়ন সলিডারিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি) ফলাফল ছিল শোচনীয় ও সেনাবাহিনীর কাছে অপ্রত্যাশিত। গণতন্ত্রের খুব সীমিত চর্চার মধ্যে মিয়ানমারে এনএলডির ব্যাপক বিজয় প্রমাণ করেছে, সেখানকার জনগণ গণতন্ত্রের স্বাদ উপভোগ করতে শুরু করেছে।

একটি কার্যত সেনাতান্ত্রিক শাসনের ভেতরে আরও গণতন্ত্র এবং গণতান্ত্রিক শাসনের যে আকাঙ্ক্ষা মিয়ানমারের ভোটাররা গত নির্বাচনে প্রকাশ করেছেন, তা সেনাবাহিনী মেনে নিতে পারেনি। তারা বুঝতে পেরেছে, এভাবে চলতে থাকলে ভবিষ্যতে মিয়ানমারের রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণ আরও আলগা হতে থাকবে। জেনারেলদের সামরিক বাণিজ্যের মচ্ছবে লাগাম পড়তে পারে। জনগণের এই ‘গণতান্ত্রিক’ আকাঙ্ক্ষার ওপর তাই তারা ‘প্রি-অ্যামটিভ অ্যাটাক’ বা আগাম আক্রমণ করেছে।

মিয়ানমারের রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর যে অবস্থান ও ভাবমূর্তি, তাতে সু চিকে সরিয়ে দেওয়ার কাজটি সহজভাবে সামাল দেওয়া যাবে বলেই সম্ভবত ধরে নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সেনাবাহিনীর হিসাব-নিকাশে ভুল হয়েছে। সু চির ১০ বছরের শাসনে পরিস্থিতি যে অনেকটাই পাল্টে গেছে, তা এখন টের পাওয়া যাচ্ছে। সেনা-অভ্যুত্থান ও সু চির আটকের পর মিয়ানমারে যে গণ-আন্দোলন শুরু হয়েছে, তা থামাতে সেনাবাহিনীকে এখন হিমশিম খেতে হচ্ছে। মিয়ানমারের সাধারণ মানুষ তাদের গণতন্ত্রের আকাঙ্ক্ষার বিরুদ্ধে সেনাবাহিনীর সেই ‘আগাম আক্রমণ’ ঠেকাতে রাজপথ নেমেছেন। ভোট দিয়ে তাঁরা যাঁদের নির্বাচিত করেছেন, তাঁদের সরিয়ে দেওয়াকে তাঁরা মেনে নেননি। সেনা সরকারের দমন-পীড়নের মুখেও তাঁরা লড়াই করছেন, প্রাণ দিচ্ছেন। অভ্যুত্থানের পর মাস দেড়েক চলে গেছে, কিন্তু বিক্ষোভের আগুন থামছে না, বরং দিনে দিনে বাড়ছে। ইতিমধ্যে ১৮০ জন বিক্ষোভকারী নিহত হয়েছেন।

শুধু রাজপথে আমজনতা নয়, সমাজের বিভিন্ন পেশাজীবী শ্রেণির মানুষও সেনাশাসনের বিরুদ্ধে নানা ধরনের অসহযোগ আন্দোলন শুরু করেছেন। সু চি আটক থাকায় সেই অর্থে আন্দোলনের কোনো কেন্দ্রীয় নির্দেশনা নেই। কিন্তু সেটা ছাড়াই বিভিন্ন বিক্ষোভ সংঘটিত হচ্ছে, আন্দোলন চলছে। এই আন্দোলনের পরিণতির ওপর মিয়ানমারের গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ অনেকটাই নির্ভর করছে। সেনাবাহিনী নানা কৌশলে এই বিক্ষোভ দমন করতে চাইবে আবার নতুন কায়দার কোনো সেনা নিয়ন্ত্রিত ‘গণতান্ত্রিক’ শাসনের মুলা ঝোলাবে। এমনিতেই বিশ্বজুড়ে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাগুলোর মধ্যে কর্তৃত্ববাদের মিশেলে নতুন নতুন নানা মডেল চালু হয়েছে, যার ফলে সামগ্রিকভাবে গণতান্ত্রিক শাসনের মান নিচে নেমে যাচ্ছে। মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী যদি এই কর্তৃত্ববাদী ধরনের সঙ্গে সেনাতন্ত্র মিশিয়ে নতুন কোনো মডেল কায়েম করে ফেলতে পারে, তাহলে সেটা শুধু মিয়ানমারের জন্য নয়, বিশ্ব গণতন্ত্রের জন্যই খারাপ ফল বয়ে আনবে। বাংলাদেশসহ এই অঞ্চলের দেশগুলোর জন্যও তা খারাপ নজির হিসেবে হাজির হবে।

রোহিঙ্গাদের প্রতি মিয়ানমার সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি, তাদের বিরুদ্ধে পরিচালিত জাতিগত নিধনযজ্ঞ এক বিষয়, আর মিয়ানমারের জনগণের গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষা ও সংগ্রাম অন্য বিষয়। ভিন্ন ভিন্ন এ দুটি বিষয়কে এক করে দেখা যাবে না, আলাদা করে দেখতে হবে। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের সংগ্রামে মিয়ানমারের জনগণের বিজয় বাংলাদেশসহ বিশ্বের গণতন্ত্রকামী সব মানুষের স্বার্থেই জরুরি।

এ কে এম জাকারিয়া: প্রথম আলোর উপসম্পাদক

[email protected]