সুদের হার বাড়াল যুক্তরাষ্ট্র, তাতে বাংলাদেশের কী?

ফেডারেল রিজার্ভ বা ফেড সম্প্রতি তাদের বেঞ্চমার্ক সুদের হার দশমিক ২৫ থেকে দশমিক ৫০ শতাংশে উন্নীত করার ঘোষণা দিয়েছেছবি : রয়টার্স

১৭ মার্চ ফেডারেল রিজার্ভ বা ফেড তাদের বেঞ্চমার্ক সুদের হার দশমিক ২৫ থেকে দশমিক ৫০ শতাংশে উন্নীত করার ঘোষণা দিয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, ভবিষ্যতে এটি আরও বাড়তে পারে। প্রশ্ন হচ্ছে, এটি দক্ষিণ এশিয়ার মতো উন্নয়নশীল দেশগুলো বা উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলোতে সুদের হার বাড়ানোর প্রভাব কী পড়বে? আমি দুই ভাগে এ বিষয়ে আলোচনা করতে চাই। প্রথমে আসা যাক ফেডারেল রিজার্ভ কেন এটি করল?

ফেডারেল রিজার্ভের আসলে এটি করার পেছনে কয়েকটি প্রধান লক্ষ্য রয়েছে এবং সম্ভবত তারা সর্বাধিক কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে চায়, দাম স্থিতিশীল রাখতে চায় অথবা সম্ভবত তারা মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে চায় এবং মধ্যম কিংবা দীর্ঘমেয়াদি সুদের হার যাতে নিজেদের আয়ত্তের বাইরে চলে না যায় তা নিশ্চিত করতে চায় । তাই কেন্দ্রীয় ব্যাংক বা ফেডারেল রিজার্ভ বার্ষিক মুদ্রাস্ফীতির হার প্রায় ২ শতাংশ রাখার চেষ্টা করে। এটি যুক্তরাষ্ট্রের জন্য একটি ভালো পদক্ষেপ হতে পারে। তবে কিছু জাতীয় এবং বৈশ্বিক কারণে সমস্যাটি এত সহজে সমাধান করা যাবে না। যেমন রাশিয়া ও ইউক্রেনের যুদ্ধ বা কোভিড-১৯ পরিস্থিতির কারণে; আসলে, মুদ্রাস্ফীতির হার এখন সত্যিই বেশি। ২০১১ সালে যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের মুদ্রাস্ফীতি ছিল ৩ দশমিক ২ শতাংশ, ২০২১ সালে সেটা হয়েছে ৪ দশমিক ৭ শতাংশ।

খুব সম্ভবত এসব কারণেই মার্কিন সরকার এ ধরনের কৌশল কিংবা এ-জাতীয় কিছু প্রণয়ন করতে চাইবে। কিন্তু সাপ্লাই চেইনের (সরবরাহ-প্রণালি) সমস্যা থাকলে এই ব্যবস্থা খুব কার্যকর না-ও হতে পারে। যদি নির্বিঘ্নে পণ্য সরবরাহই না করা যায়, পণ্যের দাম বাড়তে বাধ্য, বিশেষ করে পচনশীল দ্রব্যের। যদি এখনো কোভিড-১৯ থেকে মুক্তি না মেলে কিংবা নতুন ধরনের (নিউ ভেরিয়েন্ট) করোনা দেখা দেয়, এতে করে সাপ্লাই চেইন ব্যাহত হবে। এটি মূল্যস্ফীতি আরও বাড়াবে।

এবার আসি দ্বিতীয় প্রসঙ্গে। যুক্তরাষ্ট্রের এই পদক্ষেপ বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো বা অন্য উদীয়মান দেশগুলোকে কীভাবে প্রভাবিত করতে পারে? কয়েক মাস আগেই আইএমএফ সতর্ক করে বলেছিল যে উদীয়মান অর্থনীতিগুলোকে অবশ্যই আমেরিকার উচ্চ সুদের হারের নীতির জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। কারণ, আমরা জানি যে যখন সুদের হার বেশি হবে, এটি সম্ভবত ডলারের বিনিময় হার বৃদ্ধি করবে।

দক্ষিণ এশীয় দেশগুলো চীন বা অন্যান্য দেশ থেকে প্রচুর পরিমাণে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস আমদানি করে। এমনিতে এখন দেশগুলোতে আমদানি ব্যয় খুব বেশি হচ্ছে, আমেরিকার সুদের হার বাড়ার ফলে ডলারের দাম যদি আরও বাড়ে, নিঃসন্দেহে আমদানি আরও ব্যয়বহুল হতে চলেছে। ফলে এসব দেশে মুদ্রাস্ফীতিও দেখা দিতে পারে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর জন্য এটি একটি সমস্যা।

এটা ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত যে অন্যান্য প্রধান মুদ্রার তুলনায় ডলারের মূল্য বৃদ্ধি পেলে কিংবা ডলারের বিনিময় হার বেশি হলে, উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলোতে বিদেশি মূলধনের প্রবাহ দুর্বল হয়ে যায়। সহজ বাংলায়, বিদেশি বিনিয়োগ কমে যায়। আর কমে যাওয়াই যুক্তিযুক্ত কারণ, বিনিয়োগকারীরা তখন যুক্তরাষ্ট্রে বেশি বিনিয়োগ করবে। প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ বা এফডিআই কিংবা পুনর্বিনিয়োগ যেটাই হোক, বাংলাদেশের মতো উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলোতে যার খুবই প্রয়োজন। বাংলাদেশ ও ভারতের মতো এ ধরনের উন্নয়নশীল দেশ আরও বেশি বেশি এফডিআই চায়। তাই যুক্তরাষ্ট্রের এই নীতির কারণে এটি সম্ভবত বাধাগ্রস্ত হবে। তাই দেশগুলোরও উচিত এসব বিষয়ে এখনই প্রস্তুতি নেওয়া।

দ্বিতীয়ত, এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে যদি ডলারের বিনিময় হার বেশি হয়, তখন আমদানি খরচ অনেক বেড়ে যায়। বাংলাদেশের মতো দেশ যেখানে প্রধান রপ্তানি পণ্য তৈরি পোশাকশিল্পের বেশির ভাগ কাঁচামালই আমদানি করতে হয়, তাহলে কম দামে কীভাবে রপ্তানি করে বিশ্বের বাজারে প্রতিযোগিতা করতে পারবে? এখন ১ ডলার সমান ৭৫ থেকে ৮০ ভারতীয় রুপি, আর ১ ডলার সমান ১৮০-২০০ পাকিস্তানি রুপি। খুব সম্ভবত দেশগুলোর ইতিহাসেরই সর্বনিম্ন অবস্থায় এখন।

আরও পড়ুন

দক্ষিণ এশীয় দেশগুলো চীন বা অন্যান্য দেশ থেকে প্রচুর পরিমাণে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস আমদানি করে। এমনিতে এখন দেশগুলোতে আমদানি ব্যয় খুব বেশি হচ্ছে, আমেরিকার সুদের হার বাড়ার ফলে ডলারের দাম যদি আরও বাড়ে, নিঃসন্দেহে আমদানি আরও ব্যয়বহুল হতে চলেছে। ফলে এসব দেশে মুদ্রাস্ফীতিও দেখা দিতে পারে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর জন্য এটি একটি সমস্যা।

তৃতীয়ত, আরও একটি ব্যাপার এখানে উল্লেখ্য, বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তানসহ এশিয়ার ৯টি দেশ, তাদের এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) সদস্য। তারা ডলার ব্যবহার করে তাদের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য এবং নিজেদের মধ্যে লেনদেন নিষ্পত্তি করে। যদি ডলারের মূল্য বৃদ্ধি পায় এবং তাদের নিজস্ব মুদ্রার অবমূল্যায়ন হয়, তাহলে এই দেশগুলোর জন্য একটি বড় সমস্যা হবে।

আরও পড়ুন

বর্তমানে উন্নয়নশীল দেশগুলোর প্রচুর ঋণ আছে, জাতীয় ঋণ এমনকি বড় বড় প্রাতিষ্ঠানিক ঋণ। উন্নয়ন কার্যক্রম গতিশীল রাখার জন্য এসব দেশ সাধারণত অন্য দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংক, বিশ্বব্যাংক, আইডিবি কিংবা অনন্যা আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নিয়ে থাকে এবং বেশির ভাগ ঋণ তাদের ডলারেই পরিশোধ করতে হয়। তাই যদি ডলারের মূল্য বৃদ্ধি পায় এবং তাদের দেশের মুদ্রার মূল্য অবমূল্যায়ন হয়। সম্ভবত ঋণের বোঝা আরও বেশি হবে। এ ছাড়া কিছু মার্কিন ব্যাংক, মার্কিন কোম্পানি এসব দেশে আর্থিক বিনিয়োগ করেছে। এখন তাদের নিজের দেশে সুদের হার বৃদ্ধি পাওয়ায় হয়তো তাদের বিনিয়োগ উত্তোলন করে নিয়ে যেতে পারে কিংবা অপেক্ষাকৃত কম সময়ের মধ্যে তাদের ঋণ ফেরত দেওয়ার চাপ দিতে পারে।

উল্লিখিত সমস্যাগুলো হয়তো স্বল্প মেয়াদে চোখে না পড়তে পারে, কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে এই দেশগুলোর জন্য সমস্যা তৈরি করতে পারে। অপরপক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের সুদের হার বাড়লে অন্যান্য দেশের জন্য কি শুধুই ক্ষতির হিসাব? লাভের কি কিছুই নেই? আছে, তবে সেটার জন্য অন্য আলোচনার প্রয়োজন। বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্র যখন হাঁচি দেয়, পুরো বিশ্বে ঠান্ডা লেগে যায়। সুদের হারের মধ্যে কি যুক্তরাষ্ট্র ছোট করে একটু হাঁচি দিল? উত্তর সময় আর বিভিন্ন দেশের অর্থনৈতিক নীতির ওপর নির্ভর করবে।

ড. মিরাজ আহমেদ চীনের গুয়াংডং ইউনিভার্সিটি অব ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইকোনমিকস এর সহযোগী অধ্যাপক।
(ahmed.miraz@gmail.com)