সুন্দরবন দেখা হলো না প্রণব মুখার্জির

ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি।
ছবি: সংগৃহীত

কত হবে? বড়জোর পাঁচ চার? সে তো শারীরিক গঠন! কিন্তু রাজনৈতিক উচ্চতায়? এ যুগের ‘চাণক্য’ তিনি এমনি এমনি হননি। হয়েছেন তাঁর মেধা, বোধ, বিচারবুদ্ধি, তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা, শালীনতা, গ্রহণযোগ্যতা ও অজাতশত্রু হয়ে ওঠার কারণে। উচ্চতায় তিনি প্রতিনিয়ত সবাইকে ছাপিয়ে গেছেন। সর্বার্থে।

বলতে গেলে প্রায় সর্বসম্মতিক্রমে প্রণববাবু রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর তাঁর সম্পর্কে এটাই ছিল লালকৃষ্ণ আদভানির মূল্যায়ন। সিন্ধি আদভানি বীরভূমের কীর্ণাহারের নিপাট ভদ্রলোক ছাপোষা বাঙালি ব্রাহ্মণের চেয়ে বয়সে বড় হলেও রাজনৈতিক প্রজ্ঞার কারণে তাঁকে ওই উচ্চাসন দিতে দ্বিধা করেননি। প্রণববাবু ‘ভারতরত্ন’ হওয়ার পর তাঁর সংক্ষিপ্ত স্বগতোক্তি ছিল, যোগ্য মানুষকে যোগ্য সম্মান।

যোগ্যতার ঝলকানি প্রথম ধরা পড়েছিল জহুরি ইন্দিরা গান্ধীর চোখে। ভবিষ্যৎ দেখেছিলেন তিনি খর্বকায় বঙ্গসন্তানের মধ্যে। প্রণববাবুর বাসভবনে সব সময় শোভা পেয়েছে একটা ছবি। কোনো দিন সেই ছবি তিনি দৃষ্টিহারা করতে চাননি। সাদাকালো সেই ছবিতে সামনে থাকা মাইক এক হাতে চেপে ধরে প্রণববাবু বসে রয়েছেন। চোখে মোটা কালো ফ্রেমের চশমা। ডান দিকে এক হাত তফাতে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। ছবিটার মূল আকর্ষণ ইন্দিরার দৃষ্টি। অপূর্ব একরাশ স্নেহ ও অপার ভরসামাখা চোখে কোনো এক জিজ্ঞাসা নিয়ে প্রণববাবুর দিকে তিনি তাকিয়ে আছেন। ছবিটা দেখিয়ে প্রণববাবুকে বলেছিলাম, ওই দৃষ্টি বুঝিয়ে দেয় তিনি আপনাকে কোন চোখে দেখতেন। কতটা স্নেহ করতেন। কতখানি আস্থা ছিল আপনার ওপর।

মনমোহন মন্ত্রিসভার দুই নম্বর হলেও প্রণববাবু তখন কার্যত এক নম্বরই। নয় নয় করে ৫২টি মন্ত্রিগোষ্ঠীর চেয়ারম্যান! সরকারের মুশকিল আসান। সেই রাতে ১৩ নম্বর তালকাটোরা রোডের সরকারি বাসভবনে ওই ছবির দিকে তাকিয়ে প্রণববাবু বলেছিলেন, ‘ওটা আমারও খুব প্রিয় ছবি। ১৯৮৩ সালের এআইসিসি অধিবেশনে তোলা। তুমি ঠিকই বলেছ, ওঁর ভালোবাসা, স্নেহ ও ভরসা নিজের প্রতি আমার আস্থা ও বিশ্বাস বাড়িয়ে দিয়েছে। কোনো দিন সেই বিশ্বাস ও ভরসায় টোল খেতে দিইনি। আমাকে গড়ে তুলেছেন উনিই।’

ভরসার সেই কাহিনি শুনিয়েছিলেন প্রণববাবু নিজেই। ১৩ নম্বর তালকাটোরা রোড থেকে দেশের ত্রয়োদশ রাষ্ট্রপতির মেয়াদ শেষে তত দিনে তিনি রাজাজি মার্গের বাসিন্দা। স্মৃতিধর মানুষটি ডুব দিয়েছিলেন একাত্তরের রক্তঝরা দিনগুলোয়।

তখন তাঁর বাংলাদেশ সফরের প্রস্তুতি চলছে। যাওয়ার আগে প্রথম আলোকে সাক্ষাৎকার দিতে রাজি হয়েছেন। দুই দিন ধরে চলেছিল সেই সাক্ষাৎকার পর্ব। কত কথা! কত স্মৃতি! বললেন, ভরসা করতেন বলেই ইন্দিরা তাঁকে গুরুদায়িত্ব দিয়ে ইউরোপে পাঠিয়েছিলেন। ব্রিফ ছিল বিভিন্ন দেশ ঘুরে ভারতের পক্ষে ও পাকিস্তানের বিপক্ষে জনমত গড়ে তোলার। আদেশ পালন করেই দেশে ফিরেছিলেন তিনি। বছর ঘোরার আগেই তাই ইন্দিরা হলেন ‘এশিয়ার মুক্তিসূর্য’, বাংলাদেশ পেল তার স্বাধীনতা। সেই থেকে স্বাধীনতাকামী বাংলাদেশি হৃদয়ে আসন পেলেন প্রণব মুখার্জি, আমৃত্যু যা টলেনি!

সেই সফরে ইউরোপ যাওয়ার আগেই ইন্দিরা পূর্ব প্রান্তের সব সীমান্ত দুহাট করে খুলে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। বন্যার মতো একমুখী উদ্বাস্তু স্রোত তখন। ইন্দিরা তাঁকে বলেছিলেন, ‘এই বিপুল জনতাকে ভারত আশ্রয় দেবে। পালন করবে। স্বাধীন দেশে মাথা উঁচু করে ফেরত যাওয়ার ভরসা জোগাবে। আমরা রেসপনসিবল ও মানবিক বলে বিশ্বে পরিচিতি পাব। জনমত আমাদের পক্ষে থাকবে। সবাই দেখবে পাকিস্তানি অত্যাচারের স্বরূপ।’

প্রণববাবুর সফল ইউরোপ সফর শেষ হওয়ার আগেই ইন্দিরা আদায় করে নেন সোভিয়েত ইউনিয়নের সমর্থন। ব্রেজনেভ কথা দেন ইন্দিরাকে। তাঁর ভাবনায় তখন শুধুই চীন। আমেরিকা বিরুদ্ধে। তা তাঁর জানা। কিন্তু চীন? তারা কি পাকিস্তানের পাশে দাঁড়িয়ে ভারতকে পশ্চিম প্রান্তে বেগ দেবে? এই ভাবনা ও দোলাচল কাটিয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই ইন্দিরা ডেকে পাঠান জেনারেল মানেকশকে। জানতে চেয়েছিলেন, পাকিস্তানকে হারাতে কদিন সময় তিনি নিতে চান। মানেকশর উত্তর ছিল, এক সপ্তাহ।

একাত্তরের স্মৃতি হাতড়ানো প্রণববাবুর চোখ সেদিন চকচক করে উঠেছিল!

বাংলাদেশ সফরের কিছুদিন আগে একদিন ডেকে পাঠালেন। সেই রাজাজি মার্গ। একতলার সেই বসার ঘর। বাংলাদেশের সম্ভাব্য ভ্রমণ ছাড়া তাঁর চেতনায় তখন কিছুই প্রায় নেই। যেন শিশু হয়ে গেছেন, এমনভাবে বললেন, ‘দুটো জায়গায় যাওয়ার খুব ইচ্ছা। একটা তো তীর্থক্ষেত্র। চট্টগ্রামে প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের বাড়ি। পাহাড়তলী ইউরোপিয়ান ক্লাব, যা তাঁরা আক্রমণ করেছিলেন, অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের কিছু স্মৃতি যদি থাকে, দেখতে খুব সাধ হয়।’

আর দ্বিতীয় সাধ? জানতে চেয়েছিলাম। প্রণববাবু অল্প হেসে মাথা ঝুঁকিয়ে চোখ তুলে বলেছিলেন, ‘ওটা আহ্লাদ বলতে পারো। খুলনা-বাগেরহাট হয়ে সুন্দরবন ভ্রমণ। সুন্দরবনের বেশিটাই তো ওদের। কতবার ভেবেছি যাব। যেতে পারিনি।’

আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম ব্যবস্থা করব কি না। তিনি বলেছিলেন, ‘একটু অপেক্ষা করো। শ্রিংলা (ঢাকায় তৎকালীন ভারতীয় হাইকমিশনার হর্ষ বর্ধন শ্রিংলা) দুয়েক দিনের মধ্যেই আসছে প্রোগ্রাম ঠিক করতে। দেখি ওরা কী বলে? কী ব্যবস্থা করে?’

শ্রিংলা এলেন। আলোচনা শেষে ফিরে গেলেন। প্রণববাবু ডাকলেন। গেলাম। বললেন, ‘বুঝলে, আমার নিজস্বতা বলতে কিছুই নেই। আমিও বন্দী। চট্টগ্রামটা ফাইনাল। কিন্তু সুন্দরবন এ যাত্রায় হচ্ছে না। মাত্র চার দিনের ট্রিপ। হাজারটা অনুষ্ঠান।’

বাংলাদেশ সফরের ঠিক আগে একদিন বললাম, আপনার সফরের সময় আমিও ও দেশে থাকব। শুনে তিনি খুশি হলেন। একসময় বললেন, ‘বয়স হলে আমরা সবাই স্মৃতিভারাক্রান্ত হই। এখন কী মনে পড়ছে, জানো? তাজউদ্দীন সাহেবকে। মুক্তিযুদ্ধ তখন তুঙ্গে। বাংলাদেশের স্বাধীন সরকার গঠিত হয়ে গেছে। ওই সময় প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন সাহেবের মনে ভারতীয় ফৌজ নিয়ে সংশয় জাগে। হয়তো একই রকম সংশয়ী ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও। যুদ্ধ শেষে ভারতীয় সেনারা ফিরে যাবে তো? দখলদার সেনা হিসেবে থেকে যাবে না তো? সংশয়ের সেই বার্তা আমি পাড়লাম ইন্দিরা গান্ধীর কাছে। প্রাইম মিনিস্টার বলেছিলেন, তাজউদ্দীন সাহেবকে বলে দিন, প্রয়োজনের চেয়ে একটাও বাড়তি দিন আমাদের বাহিনী ও দেশে থাকবে না। ভারত কথা রেখেছিল।’

মুক্তিযুদ্ধের চেতনাসম্পন্ন বাংলাদেশি মানুষজনকে কোনো দিন ভুল পরামর্শ দিয়ে বিপথচালিত করেননি প্রণববাবু। চিরকাল বন্ধুর মতো পাশে থেকেছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তো বটেই, বাংলাদেশও তাই হারাল অকৃত্রিম এক সুহৃদকে।

প্রণববাবু বাংলাদেশ সফরে গিয়েছিলেন ২০১৮ সালের জানুয়ারি মাসে। উফ্। চার দিন ধরে তাঁকে ঘিরে সে কী বিপুল উদ্দীপনা! না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন!

ফিরে আসার কিছুদিন পর একদিন বলি, এবার অপূর্ণ আহ্লাদ পূরণ করুন। সুন্দরবনটা ঘুরে আসুন।

সেদিন কেমন যেন করুণ লেগেছিল প্রণববাবুর মুখ। ম্লান মুখে বলেছিলেন, ‘আমি কি আর শুধুই আমার? সাবেক রাষ্ট্রপতির ইচ্ছাতেও অনেক বেড়ি। তা ছাড়া এত ঘন ঘন যাওয়া যায় নাকি?’

খুলনা-বাগেরহাট হয়ে সুন্দরবন যাওয়ার আহ্লাদ অপূর্ণ রেখেই চলে গেলেন প্রণব মুখার্জি।

সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায় প্রথম আলোর নয়াদিল্লি প্রতিনিধি