সুফি মিজানের পরিবারে একটি সন্ধ্যা

সুফি মিজানুর রহমান
ছবি: প্রথম আলো

আমি ইউনিভার্সিটি অব ইনফরমেশন টেকনোলজি অ্যান্ড সায়েন্সেসের সিন্ডিকেট সদস্য বলে পিএইচপি ফ্যামিলি এবং ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান অনুকরণীয়ভাবে বিনয়াবনত সুফি মিজানুর রহমানকে চিনি। চট্টগ্রামের সাদার্ন ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের ২৭ মার্চ অনুষ্ঠেয় দ্বিতীয় সমাবর্তনে আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে চট্টগ্রাম যাব। মিজান ভাই এ কথা জানতে পেরে আমার ভ্রমণকে অধিকতর নিরাপদ ও স্বস্তিদায়ক করতে তাঁর এক চৌকস পৌত্রকে সফরসঙ্গী হিসেবে পাঠানোর ব্যবস্থা করলেন। আগের দিন সন্ধ্যার ফ্লাইটে চট্টগ্রামে পৌঁছালাম।

হোটেল র‍্যাডিসন ব্লু চট্টগ্রাম বেভিউ হোটেলে থাকার কথা জেনে মিজান ভাই সেখানে উপস্থিত। যখন জানতে পারলেন আমরা চট্টগ্রাম ক্লাবে আছি, বাসায় অতিথি রেখে সেখানেই তিনি চলে এলেন। ক্লাবে উপস্থিত অতিথিরা সবাই তাঁকে দেখে দাঁড়িয়ে গেলেন। মিজান ভাই সবার সঙ্গে স্বভাবসুলভ মিজানীয় বিনয়ে কুশল বিনিময় করলেন এবং তার পরদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে যোগদান করবেন বলে জানালেন। তারও পরদিন প্রিমিয়ার ইউনিভার্সিটি চট্টগ্রামেও সেমিনারে এসে আমার বিলম্বের কারণে নিরাপত্তাপ্রহরীর পাশেই বসে রইলেন এবং পরে ছাত্রদের উৎসাহিত করার জন্য একটি ভাষণও দিলেন বেশ তাড়াহুড়ার মধ্যে। কারণ, তারপরই ১ হাজার ২০০ ছাত্রকে বৃত্তিদানের একটি কর্মসূচি ছিল।

আমাদের দেশে একসময়ে বৈঠকখানায় কিংবা বাড়ির উঠানে বসে সামাজিক কিংবা পারিবারিক আলাপ-আলোচনা, গ্রামের সমস্যা ও নানা বিষয়ে আলাপ হতো। কালের স্রোতে পারিবারিক ও সামাজিক এই সংস্কৃতি বিলীয়মান। আমরা প্রতিটি পরিবারেই সুফি সাহেবের মতো নিয়মিতভাবে পারিবারিক বৈঠক আয়োজন করে একাধারে যেমন নানা প্রজন্মের আত্মীয়ের মধ্যে বন্ধন স্থাপন করতে পারি, তেমনি আমাদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের ধারার বিকাশ ও সমৃদ্ধি অর্জনে অবদান রাখতে পারি

অত্যন্ত নামকরা শিল্পপতি। কিন্তু শিক্ষার বিষয়ে আগ্রহ নিরন্তর। সঙ্গে সব সময় ডায়েরি রাখেন এবং যে কথা মনে ধরে তা লিখে রাখেন। একবার গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসায়িক সফরে আহমেদাবাদে গিয়ে খবরের কাগজের মাধ্যমে জানতে পারলেন নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক অমর্ত্য সেন কলকাতা থিয়েটার হাউসে বক্তৃতা করবেন। সঙ্গে সঙ্গে কলকাতার এক বন্ধুবরকে টিকিট কিনতে বললেন দাম যা-ই হোক না কেন এবং আহমেদাবাদ থেকে উড়ে এসে সেই বক্তৃতা শুনেছিলেন। একবার লাহোরে অবস্থানের সময় জানলেন বিখ্যাত গায়ক মেহেদি হাসান নাকি লাহোরে মডেল টাউনে আছেন। শহরটি ৬ বর্গকিলোমিটারজুড়ে ১০টি ব্লকে বিভক্ত এবং মেহেদি হাসান সেখানে কোনো একটি বাসায় রয়েছেন। এটুকু ঠিকানা সম্বল করে সারা দিন ঘুরে রাত দুইটায় বাসা বের করে তাঁর সঙ্গে দেখা করে এসেছিলেন। মধ্যবয়সে তিনি বোর্ডের স্ট্যান্ড করা ছাত্রদের দেখতে যেতেন।

সাদার্ন ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত রইলেন এবং বিকেলের সেশনে বক্তৃতায় ছাত্রদের উদ্বুদ্ধ করলেন। সন্ধ্যায় তাঁর বাসায় দাওয়াত। গিয়ে দেখি আমাকে অভ্যর্থনা করার জন্য পৌত্রদের নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। গোটা পরিবারকে তাঁর যৌবনকাল থেকেই অসাধারণ শিক্ষা দিয়ে আসছেন। নিজের সন্তানদের মহামনীষীদের জীবনকথা আর বাণী শুনিয়ে বড় করেছেন, শিখিয়েছেন কীভাবে সাধারণ্যের মতো জীবনযাপন করতে হয়, পরবর্তী প্রজন্মকেও একই শিক্ষা দিচ্ছেন।

আমি একসময় দক্ষিণ কোরিয়ার কিয়ং হি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতাম। আমাকে একজন প্রবীণ অধ্যাপক শঙ্কা প্রকাশ করলেন যে প্রযুক্তির বৈপ্লবিক পরিবর্তনের গড্ডলিকা প্রবাহে ভেসে যাচ্ছে তাদের মূল্যবোধ, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও কৃষ্টি। সুফি সাহেব এর বিপরীত। প্রতি সপ্তাহেই বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় শুরু হয় পরিবারের সদস্যদের মিলনমেলা। মিজান ভাই সেখানে সূচনা বক্তব্যে জীবন সম্পর্কে, দর্শন সম্পর্কে, মূল্যবোধ সম্পর্কে বক্তৃতা করেন। সেখানে গান পরিবেশন করা হয়, সন্তানেরা বক্তব্য প্রদান করেন, পরবর্তী প্রজন্মের সদস্যরা কবিতা আবৃত্তি, বক্তৃতা, হামদ, গজল, কাওয়ালি, নাতসহ নানা রকম বিষয় পরিবেশন করে। কখনো কখনো তা রাত দুই-তিনটা পর্যন্ত চলে। এর ফলে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে মূল্যবোধ, পারিবারিক ঐতিহ্যসংস্কৃতির বিকাশ ঘটে।

বিনয়, সুফি পরিবারের হৃদয়ে গ্রোথিত গুণ। নানা বিষয়ে আলাপ-আলোচনা হয়, পরিবারের ছোট-বড় সবাই একই সূত্রে গ্রোথিত হয়। সন্তানদের কেউ কেউ জীবনের অর্ধশতক পার করেছেন। সবার মধ্যে সদ্ভাব, সহযোগিতা, সহমর্মিতা, আন্তরিকতায় সিক্ত, শ্রদ্ধার সম্পর্ক, যা একেবারেই ঈর্ষণীয়। সন্তানদের সংখ্যাও কম নয়—এক মেয়ে ও সাতজন ছেলে, যাদের প্রত্যেকেই আমেরিকা-অস্ট্রেলিয়া থেকে উচ্চশিক্ষা শেষে পিতার ভাবাদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে পিএইচপি পরিবারকে আরও শক্তিশালী করছেন।

সুফি সাহেব তিন পুত্র এবং এক কন্যা নিয়ে একই ভবনে থাকেন আর তারই অনতিদূরে আরেকটি ভবনে চার পুত্র থাকেন। অনুষ্ঠান হয় সুফি সাহেবের ভবনে ঈছাপুরী দরবারে। আলাপ-আলোচনা শেষে পাশের কক্ষে খাবারের আয়োজন ছিল। সাধারণত সুফি সাহেবের পুত্রদের স্ত্রীরা প্রত্যেকে কমপক্ষে একটি আইটেম নিজেরা রান্না করে নিয়ে আসেন এবং সামনে এসে অতিথিদের অভ্যর্থনা জানান। এটাও অতিথিদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর অসাধারণ উপায়। খাবার সময় নানা রকম সমস্যা নিয়েও আলাপ হয়। সন্তানেরা যেসব প্রতিষ্ঠানের নেতৃত্ব দিচ্ছেন, সেখানে কোনো সমস্যা থাকলে সবাই মিলে তার সমাধানের পথ খোঁজেন, সুফি সাহেব তাঁর জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা দিয়ে সেই সমস্যার সমাধান বাতলে দেন।

স্মর্তব্য, সন্তানেরা বড় বড় শিল্পকারখানার মালিক বা ব্যবস্থাপনা পরিচালক, লাখ লাখ কোটি কোটি টাকার সমস্যা তাঁদের বিচক্ষণতার সঙ্গে মোকাবিলা করতে হয়। তবে এরই মধ্যে একেবারেই অপার্থিব খেলো ধাঁধা নিয়ে চিন্তা করা যেতে পারে! জ্ঞানার্জনের থেকে জ্ঞানপিপাসা গুরুত্বপূর্ণ। তাঁদের প্রত্যেকের মধ্যে সেই আকাঙ্ক্ষা দেখেও ভালো লাগল। পরিশেষে বিদায়ের সময় প্রত্যেক অতিথি এবং গায়ক বা বাদককে নানা উপঢৌকন দিলেন। পরিবারের ছোট সদস্যদের নিয়ে নিচে নামলেন এবং হাসিমুখে অতিথিদের বিদায় দিলেন।

এভাবে সুফি সাহেবের পরিবারের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের কালান্তর ঘটছে। আমাদের দেশে একসময়ে বৈঠকখানায় কিংবা বাড়ির উঠানে বসে সামাজিক কিংবা পারিবারিক আলাপ-আলোচনা, গ্রামের সমস্যা ও নানা বিষয়ে আলাপ হতো। কালের স্রোতে পারিবারিক ও সামাজিক এই সংস্কৃতি বিলীয়মান। আমরা প্রতিটি পরিবারেই সুফি সাহেবের মতো নিয়মিতভাবে পারিবারিক বৈঠক আয়োজন করে একাধারে যেমন নানা প্রজন্মের আত্মীয়ের মধ্যে বন্ধন স্থাপন করতে পারি, তেমনি আমাদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের ধারার বিকাশ ও সমৃদ্ধি অর্জনে অবদান রাখতে পারি।

মোহাম্মদ কায়কোবাদ ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিস্টিংগুইশড অধ্যাপক ও বাংলাদেশ একাডেমি অব সায়েন্সেসের ফেলো