সুফিয়া কামাল হলে 'মিডনাইট অ্যাকশন'

সুফিয়া কামাল হল থেকে তিন ছাত্রীকে বের করে দেওয়ার প্রতিবাদে ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ
সুফিয়া কামাল হল থেকে তিন ছাত্রীকে বের করে দেওয়ার প্রতিবাদে ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ

বৃহস্পতিবার সকালে জিল্লুর জাহিদ নামের এক তরুণের ই-মেইল পেয়ে মনটা খারাপ হয়েছিল। তিনি লিখেছেন, ‘স্যার, কোটা সংস্কার আন্দোলনের যুগ্ম আহ্বায়ক মো. রাশেদ খানকে বাঁচান। ছেলেটি একেবারেই গরিব। ওর বাবা দিনমজুর। প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে আসা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই ছেলেটি খুবই মেধাবী। রাশেদ ভাইকে শিবির বলে চালিয়ে দিয়ে যৌক্তিক কোটা সংস্কার আন্দোলনকে অন্যদিকে নিয়ে যাচ্ছে (নিয়ে যাওয়া হচ্ছে এবং পুলিশ হয়রানি করছে)। স্যার, ছেলেটিকে রক্ষা করুন।’

কয়েক দিন আগের পত্রিকার খবর ছিল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে পুলিশ পরিচয়ে কোটা সংস্কার আন্দোলনের তিন যুগ্ম আহ্বায়ককে চোখ বেঁধে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। পরে পুলিশ বলেছে, তাঁদের চোখ বেঁধে নিয়ে যাওয়া হয়নি। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডিবি অফিসে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। তাঁদের ছেড়ে দেওয়া হয়েছে ঠিক, কিন্তু মানুষ পুলিশের কথা বিশ্বাস করেনি।

ওই তিন আন্দোলনকারীর মধ্যে রাশেদ খানও ছিলেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমবিএর (ব্যাংকিং অ্যান্ড ফিন্যান্স বিভাগ) শিক্ষার্থী। অপর দুজনের মধ্যে নুরুল হক ইংরেজি বিভাগের এবং ফারুক হোসেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী। আর সাধারণ ছাত্র অধিকার পরিষদের আহ্বায়ক হাসান আল মামুন ফিন্যান্সের শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী।

রাশেদ কোনো ছাত্রসংগঠনের সঙ্গে জড়িত নন। জিল্লুর জাহিদের ভাষ্য অনুযায়ী, তাঁর বাবাও একজন দিনমজুর। কিন্তু সেই বাবাকেও ঝিনাইদহের সদর থানায় ডেকে নেওয়া হয়েছিল জিজ্ঞাসাবাদের জন্য। এ অবস্থায় যেকোনো নাগরিকের ভয় পাওয়ার কথা। আল মামুন বুধবার সেই ভয়ের কথাটিই বলেছিলেন। তাঁকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, আন্দোলনের ভবিষ্যৎ কী? তিনি বললেন, ‘আমরা জীবনের নিরাপত্তা নিয়েই চিন্তিত।’

সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের নেতারা সরকার উৎখাতের জন্য আন্দোলন করছেন না। তাঁরা সরকারি চাকরিতে যে ৫৬ শতাংশ কোটা আছে, তার সংস্কার চাইছেন।

ই-মেইলে জিল্লুর জাহিদের ভাষ্য অনুযায়ী রাশেদের বাবা যদি দিনমজুরি করে জীবিকা নির্বাহ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সন্তানকে পড়িয়ে থাকেন, তাঁর পক্ষে কোনো দলীয় রাজনীতি করা সম্ভব নয়। আর দিনমজুরের কথা যখন এল, তখন টাঙ্গাইলের আবু বকরের বাবার কথা মনে পড়ল। তিনিও সন্তানকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠিয়েছিলেন লেখাপড়া শিখে পরিবারের দুঃখ ঘোচাবেন, এই আশায়। কিন্তু ছাত্রজীবন শেষ হওয়ার আগেই এফ রহমান হলে ছাত্রলীগের দুই পক্ষের গোলাগুলির মধ্যে পড়ে মারা যান আবু বকর। তাঁর ঘাতকদের কারও শাস্তি হয়নি। সব আসামি বেকসুর খালাস পেয়ে গেছেন।

মন খারাপের পর্ব এখানেই শেষ নয়। সুফিয়া কামাল হল কর্তৃপক্ষ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিভ্রান্তিকর পোস্ট দেওয়ার অভিযোগে ছাত্রীদের মুঠোফোন তল্লাশি করেছে এবং বৃহস্পতিবার গভীর রাতে কয়েকজন ছাত্রীকে বের করে দিয়েছে। হলের সাধারণ ছাত্রীরা কর্তৃপক্ষের এই পদক্ষেপের প্রতিবাদ করছেন। তাঁরা আতঙ্কের মধ্যে আছেন। এর প্রতিবাদে রাত দেড়টার দিকে ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী এস এম ইয়াসিন আরাফাত একাই হলের ফটকে অবস্থান নেন। শাবাশ ইয়াসিন। যখন ডাক শুনে কেউ না আসে, তখন একলাই চলতে হয়।  হলের প্রাধ্যক্ষ সাবিতা রেজওয়ানা, যিনি আওয়ামী যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটিরও নেতা, বলেছেন, ‘কয়েকজন ছাত্রী তাদের ফেসবুকে ফেক অ্যাকাউন্ট খুলে গুজব ছড়াচ্ছে। মুচলেকা দিয়ে তাদের স্থানীয় অভিভাবকদের সঙ্গে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে।’

কোথায় পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে? অনেকের ঢাকায় থাকারও জায়গা নেই। প্রথম আলোর খবর অনুযায়ী, রাত ১১টা ৪৮ মিনিটে এক ছাত্রীকে হল থেকে বের করে দেওয়া হয়। ওই ছাত্রীর বাবা তাঁর মেয়েকে মোটরসাইকেলে বসিয়ে দ্রুত চলে যান। রাত ১২টা ৪০ মিনিটে এক ছাত্রীর বাবা সাংবাদিকদের বলেন, তাঁর মেয়ে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনে যুক্ত ছিল। ভবিষ্যতে যেন এমন আর না হয়, এ জন্য হল কর্তৃপক্ষ তাঁকে ডেকে সতর্ক করেছে।

অভিযোগ যত গুরুতর হোক না কেন, এভাবে মধ্যরাতে মেয়েদের হল থেকে কাউকে বের করে দেওয়া অমানবিক, নির্মম। এটা ছিল হল কর্তৃপক্ষের ‘মিডনাইট অ্যাকশন’ বা মধ্যরাতের অভিযান এবং ১০ এপ্রিলের ঘটনার রেশ। সেদিন হাজার হাজার মেয়ে যে প্রতিবাদ করেছে, সেটি তো মিথ্যে নয়। আর সেই প্রতিবাদ ছিল দীর্ঘদিনের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ। সেদিন ছাত্রলীগ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যদি ‘গুজবের’ ওপর ভর করে ইফফাত জাহান ওরফে এশা নামের ছাত্রলীগ নেত্রীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে, তাহলে সাধারণ শিক্ষার্থীদের দোষ কী। ছাত্রলীগের আন্তবিরোধে কেন হল প্রশাসন পক্ষ নিচ্ছে?

ইফফাত জাহানের ঘটনায় ছাত্রলীগ ২৪ জনকে সংগঠন থেকে বহিষ্কারের পরপরই হল কর্তৃপক্ষ ২৬ জনের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয় শৃঙ্খলা কমিটির কাছে প্রতিবেদন দিয়েছে। এ অবস্থায় হলের ছাত্রীদের মনে ভয় জাগা স্বাভাবিক। বৃহস্পতিবার রাতে হল প্রাধ্যক্ষ ছাত্রীদের উদ্দেশে যেসব বাণী দিয়েছেন সেটাও উপদেশ ছিল না, ছিল হুমকি। তিনি বলেন, ‘হলে যদি আর কেউ বিশৃঙ্খলা করার চেষ্টা করে বা তোমরা কোনো পোস্ট দেওয়ার চেষ্টা করো হলকে বিভ্রান্ত করার জন্য, তাহলে কিন্তু আমরা সরকারকে বলব...আমার নলেজের বাইরে আমার ভিডিও যে আপলোড করে সেটা কিন্তু ক্রাইম। আজকে আমি বলে দিলাম সেটা কিন্তু সাইবার ক্রাইম...আই ওয়ান্ট টু বি লাউড অ্যান্ড ক্লিয়ার।’

তবে ‘এখন থেকে হল প্রশাসন সিট বরাদ্দ দেবে’ বলে প্রাধ্যক্ষ যে কথাটি ঊহ্য রেখেছেন, সেটাই আসল কথা। তাঁর কথার সারমর্ম হলো এত দিন ছাত্রলীগও সিট বরাদ্দ দিত। হল প্রশাসন ছাত্রলীগের সিট বরাদ্দের অবৈধ কাজটি বন্ধ করতে পারলে শুধু হল নয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের নব্বই ভাগ সমস্যার সমাধান হবে।

গতকাল সকালে উপাচার্য ভবনে ঢুকতেই মনে হলো সবকিছু গোছানো। কয়েক দিন আগের সেই বিধ্বস্ত ভবন আর নেই। দেয়ালে নতুন রং লাগানো হয়েছে। অতিথিদের বসার জন্য নতুন চেয়ার-টেবিল সাজানো। ভেতরে তখন উপাচার্য মো. আখতারুজ্জামান আগের রাতে সুফিয়া কামাল হলের ঘটনা নিয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলছিলেন। সাংবাদিকদের জিজ্ঞাসা ছিল, রাতে হল থেকে অনেক মেয়েকে বের করে দেওয়া হলো কেন?

উপাচার্য মহোদয় হাসতে হাসতে বললেন, হল প্রশাসন একটি অসাধারণ কাজ করেছে। তারা সত্যিকার অভিভাবকের দায়িত্ব পালন করেছে।
কীভাবে? এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, অপতথ্য ও অপপ্রচার খুবই ভয়ংকর। সুফিয়া কামাল হলের কয়েকটি মেয়ে হল প্রশাসন, বিশ্ববিদ্যালয় ও সরকারের বিরুদ্ধে ফেক আইডি থেকে নানা রকম অপপ্রচার চালিয়েছিল। হলের প্রাধ্যক্ষ তাদের ডেকে নিয়ে কয়েকজনকে শনাক্ত করেছেন। এর মধ্যে চারজনকে তাদের অভিভাবকদের কাছে হস্তান্তরের সিদ্ধান্ত হয়। হলে যাতে কোনো অঘটন না ঘটে, সে জন্য তাদের সাময়িক অভিভাবকদের জিম্মায় রাখা হয়েছে।

তবে তাঁর কথার সঙ্গে বাস্তবের মিল নেই। হল প্রশাসন শুধু তিন ছাত্রীকে বের করে দেয়নি, অন্যদেরও রীতিমতো শাসিয়েছে, ভয় দেখিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন স্বীকার না করলেও এর প্রতিক্রিয়া হয়েছে মারাত্মক। হল কর্তৃপক্ষের এই নির্দয় সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সব হলের শিক্ষার্থীরা ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। বিকেলে রাজু ভাস্কর্যের সামনে কয়েক শ ছাত্রছাত্রী মিছিল সমাবেশ করেছে। অন্যদিকে ছাত্রলীগও মহড়া দিয়েছে।

কোটা সংস্কার আন্দোলনের নেতাদের অভিযোগ, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এক ভয়ংকর পরিস্থিতি তৈরি করতে চাইছে। কিন্তু এটি হতে দেওয়া যাবে না। তাঁরা বলেছেন, সাধারণ শিক্ষার্থীদের ভয়ভীতির মধ্যে রাখলে পরিস্থিতি আরও নাজুক হবে। যেকোনো সময় ফের বিশ্ববিদ্যালয়ে বিস্ফোরণ ঘটতে পারে।
সুফিয়া কামাল হল কর্তৃপক্ষের এই ‘মিডনাইট অ্যাকশন’ শিক্ষার্থীরা সহজে ভুলে যাবে, এ কথা মনে করার কারণ নেই।

সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
sohrabhassan 55 @gmail. com