সুবর্ণজয়ন্তীর বছরে আরও বৈষম্যের বাজেট

নিজেকে বাহবা দেওয়ার দলিল হিসেবে বাজেট উপস্থাপনে অর্থমন্ত্রীরা কখনো পিছিয়ে থাকেন না। তবে এর ফলে কখনো কখনো এমন আত্মতুষ্টির মোহ তৈরি হয়, যাতে কার্যত প্রত্যাশার উল্টোটাই ঘটে। কার্যকর ও প্রাণবন্ত গণতন্ত্রে এ ধরনের ঝুঁকি কম। কিন্তু কার্যকর বিরোধী দলহীন শাসনব্যবস্থায় যেহেতু জবাবদিহির কোনো বাধ্যবাধকতা নেই, সেহেতু প্রয়োজন হয় কিছুটা চটক তৈরির উপাদান আর সম্ভাব্য আয়-ব্যয়ের মোটামুটি একটা হিসাব। সংবাদপত্রের পাতাগুলোয় তাই আট বছর আগের পরিচিত ছবিও অনুপস্থিত। ১৯৯১ থেকে ২০১৩, এমনকি তারও আগে, সামরিক শাসনের যুগেও বাজেটের বিষয়ে প্রধান বিরোধী দলের প্রতিক্রিয়া পত্রিকাগুলোর প্রথম পাতায় নেই—এমনটি কখনোই ঘটেনি। বাজেট প্রস্তাবের পড়া শেষ হওয়ার পরপরই পক্ষে বা বিপক্ষে আওয়ামী লীগের বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে কিংবা বিএনপির নয়াপল্টনে মিছিল করার রুটিন ছিল। গত কয়েক বছর শুধু পক্ষেই মিছিল হয় আর পত্রিকায় ব্যবসায়ী ও অর্থনীতিবিদদের বিশ্লেষণই প্রাধান্য পায়। তাহলে কি আর এখনকার বাজেটকে রাজনৈতিক কর্মসূচির অর্থনৈতিক রূপরেখা বলা চলে?

বাজেটের রাজনৈতিক গুরুত্ব কমে গিয়ে এখন এটি প্রায় পুরোপুরি ব্যবসামুখী হয়ে গেছে। ‘বাণিজ্যে বসতে লক্ষ্মী’ উপকথাই এখন আমাদের একমাত্র অগ্রাধিকার। বাজেট বিশ্লেষণে যে কথা ঘুরেফিরে উচ্চারিত হয়েছে, তা হচ্ছে এটি একটি ব্যবসাবান্ধব বাজেট। পেশার দিক থেকে সাংসদদের মধ্যে ব্যবসায়ীদের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা হয়েছে বেশ আগেই। মন্ত্রীদের মধ্যেও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। সুতরাং, ব্যবসাবান্ধব না বলে এখনকার বাজেটকে ব্যবসায়ীদের বাজেট বললেও কোনো অতিরঞ্জন বা তথ্যবিকৃতি ঘটে না। অবশ্য ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা যে ব্যবসায়ীদের এই সংজ্ঞায় পড়েন না, সে কথাও বলে নেওয়া জরুরি। আর ব্যবসায়ীদের পর এই বাজেটে যাঁদের স্বার্থ সুরক্ষিত হয়েছে, তাঁরা হলেন সরকারি আমলা-কর্মচারী।

বেসরকারি খাতের কর্মচারীদের ছাঁটাই, বেতন কমা কিংবা বকেয়া পড়ার কারণে তাঁরা শহর ছেড়ে গ্রামমুখী হতে বাধ্য হলেও তাঁদের জন্য স্বস্তিদায়ক বা আশ্বস্ত করার কোনো পদক্ষেপ নেই। অর্থনীতিবিদদের অধিকাংশই তাই নিঃসংকোচে বলেছেন যে মহামারির সময়ে নতুন করে যাঁরা গরিব হয়েছেন, সরকার তাঁদের কথা ভুলে গেছে। তাঁদের সংখ্যা বিভিন্ন হিসাবে আড়াই থেকে সাড়ে তিন কোটির বেশি। প্রশ্ন হচ্ছে সরকারের কাছে এই সাড়ে তিন কোটি মানুষের হয়ে কেউ কি দেনদরবার করেছেন? রাজনীতি ও জবাবদিহির ব্যবস্থা না থাকলে প্রবৃদ্ধির অঙ্ক কষায় ব্যস্ত আমলা অথবা ব্যবসা সামাল দিতে ব্যস্ত রাজনীতিকদের দেশের জনগোষ্ঠীর অবহেলিত ২০ শতাংশের কথা কীভাবে মনে পড়বে? উন্নয়ন প্রকল্পের অনেকগুলোই এখন আরোপিত, যেগুলোর সঙ্গে কথিত উপকারভোগীদের কোনো সম্পর্ক নেই, অংশগ্রহণ নেই। সেটা যেমন বনবিনাশী রামপাল প্রকল্পের ক্ষেত্রে সত্য, তেমনই সত্য বান্দরবানে পাঁচতারা হোটেল কিংবা সংরক্ষিত বনাঞ্চলে কথিত সাফারি পার্কের প্রকল্পে। দেশে শতাধিক বিশেষ অর্থনৈতিক এলাকা তৈরির যে পরিকল্পনা, তারও অনেকগুলো কৃষিজমি ও কৃষকের জীবিকা ধ্বংসের বিতর্কে প্রশ্নবিদ্ধ।

একজন সুপরিচিত ও শীর্ষস্থানীয় অর্থনীতিবিদ ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় বিস্ময়ের সুরে বললেন যে সংসদের স্ট্যান্ডিং কমিটিগুলোতেও বাজেটে অগ্রাধিকারের বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা হয় না। আমি অবশ্য তাঁর কাছে পাল্টা জানতে চাইলাম, সংসদে যখন একটি দলই সব এবং তার মধ্যেও ব্যবসায়ীদের প্রাধান্য বজায় আছে, সেখানে কমিটিগুলোর সভায় কি ভিন্ন কিছু আশা করা যায়? তিনি আর কথা বাড়াননি। বাজেটের আলোচনায় কথা উঠেছে যে বাজেট বাস্তবায়নের হার সন্তোষজনক নয়। গত এক দশকের পরিসংখ্যান দিয়ে তাঁরা উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের হারেও উদ্বেগজনক শ্লথগতির ছবি তুলে ধরেছেন। এ কারণে প্রকল্প দীর্ঘায়িত হচ্ছে, বছর বছর খরচ বাড়ছে, দুর্নীতি এবং অপচয়ের বোঝা বেড়েই চলেছে। স্থিতিশীলতা ও সরকারের ধারাবাহিকতার দোহাই দিয়ে যাঁরা এত দিন রাজনীতিতে ভিন্নমত ও বিকল্প শক্তিকে ধ্বংস করার প্রক্রিয়ায় নীরব থেকেছেন, তাঁরা কি এখন বুঝতে পারছেন যে কার্যকর বিরোধী দলহীন সংসদীয় ব্যবস্থা সেই গণতন্ত্র নয়, যেখানে সরকারের জবাবদিহির প্রয়োজন হয়? গত প্রায় আট বছরে সংসদে আমরা সরকার মনোনীত যে বিরোধী দল দেখেছি, তাতে এর থেকে আলাদা কিছু হওয়ার কথা নয়।

বাজেট বিশ্লেষণ অর্থনীতিবিদদের কাজ এবং তাঁরা মহামারিকালের বাজেটে কী কী বিষয় প্রাধান্য পাওয়া উচিত ছিল, তা বেশ ভালোভাবেই তুলে ধরেছেন। প্রশ্ন হচ্ছে গণতন্ত্রকে স্বমহিমায় ফিরিয়ে আনার বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দিতে না পারলে গোষ্ঠীস্বার্থের জায়গায় বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর স্বার্থরক্ষা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। সুতরাং, মূল রোগটা নিরাময়ে যত দ্রুত নজর দেওয়া যায়, ততই মঙ্গল। এই যে বাজেট বাস্তবায়নে ব্যর্থতা কিংবা উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়নের হার কখনো কখনো অর্ধেকের নিচে—এগুলোর দায় কার? বলা হয় প্রশাসনের অদক্ষতা, দুর্নীতি এবং সংস্কারবিরোধী অবস্থান এর জন্য দায়ী। তাহলে এই আমলাতন্ত্রের জন্য জনগণের অর্থের ২৬ শতাংশ কেন ব্যয় করা হবে? সরকারের আকার কেন এত বিশালকায়? এক নথি তৈরিতে ডজনখানেক কর্মচারী-কর্মকর্তার প্রয়োজন হয় কেন?

বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আছে একটানা প্রায় সাড়ে ১২ বছর। তাই অন্য কারও সঙ্গে তুলনা টানা যায় না। কিন্তু তারপরও পত্রিকাগুলোর পুরোনো সংখ্যা ঘেঁটে দেখা যাচ্ছে, ২০০৫-২০০৬ সালে বিএনপির বাজেটে জনপ্রশাসনের জন্য ব্যয় ছিল ৪ দশমিক ৬ শতাংশ, আর পেনশনে ৪ দশমিক ২ শতাংশ। আওয়ামী লীগ এই দফায় ক্ষমতায় আসার পর প্রথম বাজেটে ২০০৯ সালে জনপ্রশাসনে বরাদ্দ দাঁড়াল ১৩ দশমিক ৬ ও পেনশন খরচ ৩ দশমিক ২ শতাংশ। আগের রাজনৈতিক সরকারের তুলনায় প্রশাসনিক খরচ (পেনশনসহ) শুরুতেই প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেল। এরপর আমলাতন্ত্রের পেছনে ব্যয়ে বড় উল্লম্ফন দেখা যাচ্ছে ২০১৫ সালে, যা ছিল প্রায় ২৩ শতাংশ। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতার একতরফা নির্বাচনে দ্বিতীয় মেয়াদ শুরুর পর সরকারের আমলানির্ভরতা বৃদ্ধিই যে এর সম্ভাব্য কারণ, তা নিয়ে সম্ভবত কেউ দ্বিমত করবেন না।

আর তৃতীয় মেয়াদে সরকার গঠনে আমলাদের ভূমিকা কী ছিল, তা সরকারের শরিক জোটের নেতারাই সংসদে খোলামেলাভাবে তুলে ধরেছেন। রাতের বেলায় ব্যালট বাক্স ভরা থেকে শুরু করে ক্ষমতাসীন জোটের প্রার্থীদের সব অন্যায়-অনিয়মের সহযোগী হওয়ায় এই আমলাদের দাপট এখন অহরহই দেখা যায়। বয়স্ক নাগরিককে কান ধরে ওঠবস করানো, খাদ্যসাহায্য চাওয়ায় অসহায় পরিবারকে জরিমানা করা, কিংবা ছাগল নিয়ে তুলকালাম ঘটানোর মতো ক্ষমতার অপব্যবহারে এখন আর তাঁদের কেউ দোষ দিতে পারে না।

স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর বাজেটে এবার বিশেষভাবে লক্ষণীয় ছিল ডজনখানেক দেশের সরকারপ্রধান, একজন বিরোধী নেত্রী ও জাতিসংঘ মহাসচিবের শুভেচ্ছাবার্তা এবং আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে বাংলাদেশের প্রশংসাসূচক শিরোনামের উদ্ধৃতি। স্বাধীনতার পর যে দেশটির ভবিষ্যৎ টিকে থাকা নিয়ে বিশ্বের অনেক সুপরিচিত রাজনীতিক ও বুদ্ধিজীবী সংশয় প্রকাশ করেছিলেন, সেই দেশের ৫০ বছর পূর্তিতে দেশটির প্রশংসা খুবই স্বাভাবিক এবং প্রত্যাশিত। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতা বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীর এসব শুভেচ্ছাবার্তাকে সরকারের সার্টিফিকেট হিসেবে তুলে ধরার প্রয়োজন হলো কেন, তা অর্থমন্ত্রীই ভালো জানেন। তবে আমরা শুধু স্মরণ করতে পারি যে দেশের পরপর দুটো নির্বাচনের বিশ্বাসযোগ্যতা এবং মানবাধিকার নিয়ে এসব দেশ যখনই প্রশ্ন তুলেছে ও উদ্বেগ প্রকাশ করেছে, তখন সরকার কিন্তু ক্ষোভ প্রকাশে কোনো রাখঢাক করেনি। ‘বাংলাদেশের মানুষ বিগত পাঁচ দশকে সামাজিক অগ্রগতিতে বড় ভূমিকা রেখেছেন’ বলে জাতিসংঘ মহাসচিবের অভিনন্দনবার্তা আমাদের কাছে মূল্যবান হলেও নির্বাচন সম্পর্কে তাঁর মন্তব্য অনধিকার চর্চা।

এ রকম সার্টিফিকেট ব্যবহারেও যে ঝুঁকি আছে, তা সম্ভবত অর্থমন্ত্রীর নজর এড়িয়ে গেছে। না হলে নিউইয়র্ক টাইমস-এর ‘হোয়াট ক্যান বাইডেনস প্ল্যান ডু ফর পভার্টি? লুক টু বাংলাদেশ’ নিবন্ধের কথা তিনি বলতেন না। নিবন্ধটিতে বাংলাদেশের অগ্রগতির কৃতিত্ব আশির দশকের পর থেকে যাঁরাই সরকার পরিচালনা করেছেন, তাঁদের সবাইকে দেওয়া হয়েছে। মেয়েদের শিক্ষা ও নারীর ক্ষমতায়নের মতো বিষয়গুলোয় কৃতিত্ব দেওয়া হয়েছে গ্রামীণ ব্যাংক ও ব্র্যাকের মতো বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা বা এনজিওগুলোকে।

বাজেট সম্পর্কে একটি প্রচলিত ধারণা হচ্ছে সমাজে বৈষম্য কমানোর লক্ষ্যে সম্পদ পুনর্বণ্টনে এটি বেশ কার্যকর একটি হাতিয়ার। রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগের অঙ্গীকার ছিল দেশে ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য কমানোর। কিন্তু উল্টো বৈষম্য ধারাবাহিকভাবে বেড়েছে। এবারও দেশের হতদরিদ্র ও ‘নতুন গরিব’রা উপেক্ষিত থেকে গেলেন। তবে সে জন্য এখন কাউকে জবাবদিহি করতে হবে না।

কামাল আহমেদ সাংবাদিক