সুমাইয়া নামের পরিটি নেই, দেলোয়াররা দারুণ আছেন

২০১২ সালের এই দিনে আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুরের তাজরীন ফ্যাশনসে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ১১৭ জন পোশাকশ্রমিক পুড়ে মারা যান
ছবি: প্রথম আলো

সুমাইয়া মারা যাবে। এটা জানতে পারি ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বরে। তখন ওর বয়স মাত্র ১৬ বছর। ও যে মারা যাচ্ছে, তা ও জেনে গিয়েছিল। পরির মতো দেখতে এক কিশোরী। এই বয়সে কত কী প্রিয় থাকে কিশোরীদের। সুমাইয়ার কোনো প্রিয় রং নেই। ও জানত মানুষ ৪০ বছরের বেশি বাঁচে না। ওর কোনো স্বপ্ন ছিল না। বেঁচে থাকলে ও এখন হতো ২৫ বছরের তরুণী। ২০১২ সালের নভেম্বরে সাভারের তাজরীন ফ্যাশনসের আগুনে পুড়ে আহত হয় সুমাইয়া। সোয়া একটা বছর অসহ্য যন্ত্রণায় ভুগে মারা যায় ২০১৪ সালের মার্চে। আগুনে পোড়া আহতের সঙ্গে নিহতের তফাতটা শুধু এখানেই; মৃতের যন্ত্রণার অবসান হয়, আহত ব্যক্তিরা ভুগতে থাকে অনেক দিন, কেউ কেউ সারাটা জীবনই কষ্টের দহনে পুড়তে থাকে; কেউ কেউ সুমাইয়ার মতো দীর্ঘ মৃত্যু যন্ত্রণার সুড়ঙ্গে কাতরাতে থাকে।

অসহ্য ব্যথায় মায়ের হাত কামড়ে রক্তাক্ত করে দিত সুমাইয়া। কিন্তু তাজরীনের মালিক দেলোয়ার হোসেনকে কিছুই করতে হয় না। সরকারিভাবে অন্তত ১১৭ জন পোশাকশ্রমিকের মৃত্যুর দায় নিয়েও তিনি ফুরফুরে ঘুরে বেড়ান। তিনি দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ আগুন-বিপর্যয়ের নায়ক। তাঁর কৃতকর্মের ফলে হাজারের বেশি শ্রমিক আহত-পঙ্গু-সর্বস্বান্ত হন। তাজরীনের অগ্নিকাণ্ডের পর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের গঠিত তদন্ত কমিটি সরকারের ‘সদয় বিবেচনার জন্য যে সুপারিশগুলো করেছিল’, তার প্রথমেই লেখা ছিল, ‘...এত বিপুল মৃত্যুর জন্য মালিকের অমার্জনীয় অবহেলাই দায়ী। এটা সুস্পষ্টভাবে অবহেলাজনিত মৃত্যু ঘটানোর অপরাধ। তাই তাজরীন ফ্যাশনস লিমিটেডের মালিককে দণ্ডবিধির ৩০৪ (ক) ধারায় আইনের আওতায় এনে বিচারে সোপর্দ করার সুপারিশ করছি।’ প্রতিবেদনে দেলোয়ার হোসেনের পাশাপাশি কারখানার আরও নয় কর্মকর্তাকেও বিচারে সোপর্দ করার সুপারিশ করা হয়।

সেই সদয় বিবেচনা সরকারের মনে জাগেনি। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তাদের নিজেদের তদন্ত প্রতিবেদনও ‘গোপন’ করে রাখে; এবং দেলোয়ার হোসেন ‘স্বাভাবিক’ জীবন যাপন করতে থাকেন। সুমাইয়াকে তিনি দেখতে যাননি, বিজিএমইএ সুমাইয়াকে কিছু দেয়নি। ভুল চিকিৎসার পথে ঠেলে দিয়ে মৃত্যুটা বরং নিশ্চিত করেছে।

আমরা তাজরীনে গিয়েছি। আগুনে লোহার মেশিনও গলে যায়, সেই আগুনে শ্রমিকের কয়লা হওয়া দেহ দেখেছি। তারপর দেলোয়ার হোসেনের বিচারের শুনানিতে হাজির থেকেছি। রানা প্লাজাতেও গিয়েছি, এ বছরে গিয়েছি নারায়ণগঞ্জের হাশেম ফুডসের নরক দর্শনে। প্রতিবছর ২৪ নভেম্বর এলে গণমাধ্যমে বিচার না হওয়ার সালতামামি করেছি। ১০ বছরেও ‘বিচার হয়নি’ শুনে স্বজনের কান্নায় ভেঙে পড়া দৃশ্যগুলো দেখেছি। দেখেছি, আদালতে শুনানির পর শুনানি হয়, দেলোয়ার হোসেনকে আগের চেয়েও আত্মবিশ্বাসী মনে হয়। আদালতকক্ষ থেকে তিনি যখন দেহরক্ষী পরিবেষ্টিত হয়ে গটগট করে চলে যান দামি উকিলের শৌখিন চেম্বারে, তখন আদালতের বারান্দায় তিন মেয়ে হারানো বাবা বাবলু মিয়ার চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরতে থাকে। রাষ্ট্র নামক পাষাণ তাতেও গলে না। তাজরীনে নিহত ব্যক্তিদের এক আত্মীয় ঘৃণা চেপে রাখতে পারেননি। এক দিন আদালতের বারান্দায় দেলোয়ার হোসেনের কানের কাছে মুখ নিয়ে তিনি বলেন, ‘আপনার ঘুম হয়? আপনার সন্তানেরা আপনাকে ঘৃণা করে না?’ যে দেলোয়ার শ্রমিকের ঘাম আর শিশুদের প্রাণের দামে কোটিপতি হয়েছেন, যাঁকে হত্যা, নাশকতা, পরিকল্পিত অবহেলা ইত্যাদির জন্য বিচারের হাতে সোপর্দ করার সুপারিশও সরকার চেপে গিয়েছে; সেই দেলোয়ারের মানুষের অভিশাপ পরোয়া না করারই কথা।

শ্রম ও জীবনের চূড়ান্ত ব্যবস্থাপক আসলে রাষ্ট্র ও সরকার। তারা চাইলে মালিকেরা নিয়ম মানবেন, শ্রমিকেরও জীবন বাঁচবে—শিল্পটিও টিকবে। সুমাইয়াদের মৃত্যুর দায় তাই রাষ্ট্রেরও। ঔপনিবেশিক শাসকেরা যে কায়দায় কৃষক-শ্রমিকের শ্রম নিংড়ে তাদের আখের ছোবড়ার মতো ছুঁড়ে ফেলত, স্বাধীনতার ৫০ বছর পরেও সেই কায়দা চলতে পারে না।

এ দেশে দেলোয়ারদের কিছু হয় না, কিন্তু সুমাইয়ারা বারে বারে মরে যায়। শুধু মরে না, পৃথিবীতে যত কষ্ট মানুষকে দেওয়া সম্ভব, তার সবই তাকে ভোগ করতে হয়। শৈশবের না-খাওয়া, কিশোরীকালে হাড়ভাঙা খাটুনির পরও তাদের জন্য অপেক্ষা করে কারখানার আগুন বা ধস, রাস্তায় মাস্তানের আগ্রাসী হাত, দুরারোগ্য ব্যাধি। এ ধরনের দাসশ্রমের ভিতের ওপর তৈরি আমাদের উন্নয়নের অহমিকা।

মালিক বা সরকার যে মানুষের জীবনের পরোয়া করবে, সমাজ থেকে তেমন অদম্য চাপ তো আসে না। চাপ আসে বিদেশি ক্রেতাদের কাছ থেকে। সেই চাপে সরকারও কিছুটা নড়েচড়ে বসে। অগ্নিনিরাপত্তা ও ভবনের নিরাপত্তায় সরকারি-বেসরকারি নজরদারি বাড়ে। তারপরও নারায়ণগঞ্জের হাশেম ফুডসে তাজরীনের পুনরাবৃত্তি ঘটে; সরকারি হিসাবে মৃত ৫৫ জন। গত ১০ বছরে কারখানার আগুনে পুড়ে মারা গেছে ৭০০ জন।

মৃত্যুর আগে পরির মতো মেয়ে সুমাইয়ার চেহারা হয়ে উঠেছিল প্রেতের মতো। কৃষককে নিঃস্বকরণের বাজার অর্থনীতির সুবাদে গ্রাম থেকে শহরের কারখানায়, ভাটায়, নির্মাণশিল্পে তাজা ছেলে-মেয়েরা আসে। অপুষ্টির শিকার এসব তরুণ-তরুণীরা উচ্চতায় খাটো হয়ে থাকে। তার ওপর অল্প মজুরি আর অধিক খাটুনির চাপে কয়েক বছরের মধ্যেই তাদের চেহারা থেকে সজীবতা হারিয়ে যায়। আর উজ্জ্বল হয় ধনিক শ্রেণির শান-শওকত। আমাদের প্রবৃদ্ধি আর কোটিপতির জোয়ারের জ্বালানি এসব গ্রামীণ সন্তানেরা, এই কথা মনে রাখা দরকার।

পোশাকশিল্পকে আমরা অপয়া ভাবি না। স্বাবলম্বী দেশের স্বার্থে এই খাতকে আরও সবল, আরও বিকশিত করা দরকার। মালিকদেরও উন্নতি দরকার। আমরা চাই তাঁরা দাসশ্রম ব্যবসা থেকে প্রকৃত শিল্পপতি হয়ে উঠুন, যেখানে শ্রমিকেরা দাসের চাইতে উন্নত আচরণ পাবেন। তা করতে হবে কোরিয়ার মতো করে। শিল্পায়নের শুরুতে দেশটি পুঁজিপতিদের জন্য জমি, ঋণসহ সবকিছু করেছিল একটি শর্তে। সুযোগের অপব্যবহার করলেই কঠিন শাস্তি। তাতে করেই সেখানে যোগ্য ও দক্ষরা আরও এগিয়েছে, দুই নম্বরিরা হারিয়ে গেছে। আইনের শাসন ছাড়া গণতন্ত্র হয় না আমরা জানি, কিন্তু উন্নয়নও হয় না। কোরিয়া-জাপান-চীন তারই উদাহরণ। একদল ধুরন্ধর তবুও প্রচার করে, উন্নয়নের শুরুতে দস্যুবৃত্তিকে নাকি ছাড় দিতে হয়। বিস্তর ছাড় চলছে, কিন্তু তার অপব্যবহার ঠেকানোর মতো রাষ্ট্র ও সরকার নেই। টেকসই শিল্পায়ন যদি জাতীয় স্বার্থ হয়, তাহলে সুমাইয়াদের মজুরি ও নিরাপত্তা দিতে হবে; অবহেলাজনিত কাঠামোগত হত্যাকাণ্ডের কঠিন শাস্তি হতে হবে।

শ্রম ও জীবনের চূড়ান্ত ব্যবস্থাপক আসলে রাষ্ট্র ও সরকার। তারা চাইলে মালিকেরা নিয়ম মানবেন, শ্রমিকেরও জীবন বাঁচবে—শিল্পটিও টিকবে। সুমাইয়াদের মৃত্যুর দায় তাই রাষ্ট্রেরও। ঔপনিবেশিক শাসকেরা যে কায়দায় কৃষক-শ্রমিকের শ্রম নিংড়ে তাদের আখের ছোবড়ার মতো ছুঁড়ে ফেলত, স্বাধীনতার ৫০ বছর পরেও সেই কায়দা চলতে পারে না। কায়দা একই, কিন্তু সংজ্ঞা বদলেছে। জীবন খেয়ে ফেলার এই পদ্ধতিকে ব্রিটিশ শাসকেরা সভ্যতা বলত, আমরা বলছি উন্নয়ন।

মৃত্যুর আগে সুমাইয়া বলত, ওর মাথার মধ্যে আগুনের পোকা কামড়াচ্ছে। সুমাইয়াদের মতো মাসুম মেয়েরা পুড়ে যায়, তাজরীনের মালিক দেলোয়ারের মতো আগুনের পোকাদের কামড় কবে থামানো যাবে?

ফারুক ওয়াসিফ লেখক ও সাংবাদিক।

faruk. wasif@prothomalo. com