সৃজনশীল বিষয়বস্তু কখন আইন লঙ্ঘন করে?

একটি স্বল্পদৈর্ঘ্যের চলচ্চিত্র গত সপ্তাহে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে রীতিমতো আলোচনার ঝড় তোলে। ঘটনার মূল চরিত্র এক যুবক, যে কিনা বন্ধুদের সঙ্গে পার্কে গল্প করার সময় এক মেয়েকে প্রকাশ্যে ধূমপান করতে দেখে এবং তৎক্ষণাৎ সিদ্ধান্ত নেয় যে মেয়েটিকে এ ব্যাপারে কিছু বলা উচিত। তবে তা এ কারণে নয় যে প্রকাশ্যে ধূমপান করা অবৈধ; বরং তার আপত্তির জায়গা এই যে ধূমপানকারী একজন নারী। নারীরা প্রকাশ্যে ধূমপান করলে সমাজের নৈতিক কাঠামো কলুষিত হয়, কিন্তু কোনো পুরুষের বেলায় তা হয় না। তিরস্কার করেও যখন মেয়েটিকে এই ‘অনৈতিক’ পথ থেকে সরানো গেল না, যুবকটি তখন একটি ভিডিও আপলোড করে এবং সবার উদ্দেশে আহ্বান জানায় যে যেসব মেয়ে প্রকাশ্যে ধূমপান করার সাহস দেখায়, তাদের খুঁজে বের করে তাদের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আপলোড করে দেওয়া হোক।

একজন নারী যাতে ‘ঠিকঠাকভাবে’ আচরণ করে, সে জন্য শুধু তিরস্কার করার স্পর্ধাই যুবকটি দেখায়নি; বরং এটিকে সে নিজের নৈতিক দায়িত্ব হিসেবে বিবেচনা করেছে। দর্শকদের উদ্দেশে চলচ্চিত্রটির এমন বার্তা ভারি ভয়জাগানিয়া। এরপর কী নিয়ে আপত্তি উঠবে? নারীদের পোশাকের দৈর্ঘ্য, তার খোলা চুল, বাইরে ঘোরাফেরা করা?

পুরুষের নারীদের আচার-আচরণ নিয়ন্ত্রণ করা পৃথিবীতে নতুন কোনো ঘটনা নয়। পারিবারিক সহিংসতা থেকে শুরু করে পার্কে জগিং করা নারীদের প্রতি পুরুষদের ভ্রু কোঁচকানো, প্রকাশ্যে দৌড়াদৌড়ি না করার অযাচিত উপদেশদান-এই সবকিছুর মূলে আছে পুরুষের নিয়ন্ত্রণের ইচ্ছা, তার পুরুষতান্ত্রিকতা। কিন্তু আজ আমাদের জন্য যা নতুন ঘটনা, তা হলো এই যে এখন সামাজিক গণমাধ্যমে নির্লজ্জভাবে এমন বিকৃত আকাঙ্ক্ষা তুলে ধরা হচ্ছে, প্রকাশ করা হচ্ছে এবং এটিকে একটি সামাজিক দায়িত্বের লেবাস পরানো হচ্ছে। ইন্টারনেটে নারীবিদ্বেষী বিষয়বস্তুর অভাব নেই। কিন্তু একটা পর্যায়ে এসে সীমা লঙ্ঘন হয়ে যায়। আমরা কিন্তু সেসব ভিডিওর কথা বলছি না, যেগুলো ‘কমিউনিটি স্ট্যান্ডার্ড লঙ্ঘন’ করে বলে ফেসবুক অপসারণ করে ফেলে। আমরা সেসব ভিডিওর প্রতি আঙুল তুলছি, যেগুলো নানাভাবে বাংলাদেশের আইন লঙ্ঘন করে। আজকের এ লেখায় আমরা তুলে ধরার চেষ্টা করছি যে আলোচ্য ভিডিও নির্মাণ ও তার প্রচার কীভাবে আমাদের দেশের একাধিক আইন লঙ্ঘনের শামিল।

সংবিধানের ৩৯ ধারায় মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে সুরক্ষা দেওয়া হয়েছে। তবে এই অধিকারের কিছু সীমাবদ্ধতা ও ব্যতিক্রম আছে, বিশেষ করে যখন কোনো ধরনের মতপ্রকাশ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির বিঘ্ন ঘটায়। এ ধরনের ভিডিও সম্প্রচার করা দণ্ডবিধি ১৮৬০-এর আওতায় একটি শাস্তিযোগ্য ফৌজদারি অপরাধ। দণ্ডবিধির ৫০৫ ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি এমন কোনো বিবৃতি, গুজব অথবা প্রতিবেদন...এমন উদ্দেশ্য নিয়ে তৈরি, প্রকাশ ও প্রচার করে, যা কোনো জনগোষ্ঠী বা সম্প্রদায়কে অন্য কোনো জনগোষ্ঠী বা সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে অপরাধ সংঘটন করতে উসকানি দেয় বা উসকানির সম্ভাবনা তৈরি করে কিংবা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বিভিন্ন জনগোষ্ঠী, সম্প্রদায় ও শ্রেণির মধ্যে শত্রুতা, বিদ্বেষ বা বৈরীভাব সৃষ্টি করে বা করতে উসকে দেয় অথবা তার সম্ভাবনা তৈরি করে, তবে সেই ব্যক্তিকে সর্বোচ্চ সাত বছরের কারাদণ্ড অথবা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করা হবে। (সংক্ষিপ্ততার জন্য এই ধারার শুধু প্রাসঙ্গিক অংশ উদ্ধৃত করা হয়েছে।)

ওই ভিডিওটি দণ্ডবিধির ৫০৫ ধারা বিভিন্নভাবে লঙ্ঘন করেছে। প্রথমত, যেসব নারী গতানুগতিক সামাজিক বিধিনিষেধ মেনে চলবে না, তাদের ভয়ভীতি প্রদর্শন করতে এ ভিডিও স্পষ্টতই পুরুষদের উসকানি দিচ্ছে। ভিডিওর মূল চরিত্র অত্যন্ত স্পষ্টভাবে বলেছে যে প্রকাশ্যে ধূমপানকারী নারীদের শিক্ষা দেওয়া অবশ্য কর্তব্য। সেই লক্ষ্য অর্জনে এখানে ‘সাইবার বুলিং’কে (ইন্টারনেটে হয়রানি করা) অনুসরণীয় কৌশল হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। নারীদের নিরাপত্তা এমনিতেই এ দেশে শোচনীয়। এ পরিস্থিতিতে নারীর বিরুদ্ধে নির্যাতন উসকে দেয়, এমন বিষয়বস্তু বিশেষভাবে বিপজ্জনক।

দ্বিতীয়ত, এই ভিডিওতে আইনের ভুল ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে এবং এমনভাবে তা উপস্থাপন করা হয়েছে, যাতে নারীদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ সৃষ্টি হয়। ভিডিওর মূল চরিত্র বিভিন্ন ক্ষেত্রে (যেমন বাসের সংরক্ষিত আসন, উপবৃত্তি) নারীদের বিশেষ সুবিধার ব্যাপারে ক্ষোভ প্রকাশ করে। তাকে বলতে শোনা যায়, এসব কারণে পুরুষ হিসেবে সে বৈষম্য বোধ করে। আমরা দেখি, তার বিন্দুমাত্র ধারণা নেই যে সংবিধানের ২৮ (৪) ধারা মোতাবেক আমাদের দেশে নারীদের জন্য ইতিবাচক বৈষম্যের (Positive Discrimination/Affirmative Action) পদক্ষেপ নেওয়া রাষ্ট্রের সাংবিধানিক দায়িত্ব। পুরুষের অধিকার ক্ষুণ্ন করে নারীদের বাড়তি অধিকার দেওয়া হচ্ছে, এ ধরনের ভুল যুক্তি প্রচার করা নারীদের ওপর আক্রমণের উসকানি দেওয়ার সমতুল্য।

তৃতীয়ত, এই ভিডিওতে মানুষকে আইন ভাঙতে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০-এর ১০ ধারায় স্পষ্ট বলা আছে যে নারীদের যৌন হয়রানি করা একটি ফৌজদারি অপরাধ। বিএনডব্লিউএলএ মামলায় (২০১০) সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশনা মোতাবেক কোনো নারীকে তার লিঙ্গের কারণে মৌখিক গালিগালাজ/আক্রমণও যৌন হয়রানির সমতুল্য। এ ছাড়া কোনো ব্যক্তির অনুমতি ছাড়া তার ছবি বা ভিডিও ধারণ করা ব্যক্তিগত গোপনীয়তার অধিকারের লঙ্ঘন। আবার কাউকে হেয় করার উদ্দেশ্যে এ ধরনের বিষয়বস্তু ইলেকট্রনিক মাধ্যমে প্রকাশ করা হলে তা হবে তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারার লঙ্ঘন।

তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারায় বলা আছে, ‘কোনো ব্যক্তি যদি ইচ্ছাকৃতভাবে ওয়েবসাইটে বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক বিন্যাসে এমন কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করেন, যা মিথ্যা…বা সংশ্লিষ্ট অবস্থা বিবেচনায় কেউ পড়লে, দেখলে বা শুনলে নীতিভ্রষ্ট বা অসৎ হতে উদ্বুদ্ধ হতে পারেন অথবা যার দ্বারা মানহানি ঘটে, আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটে বা ঘটার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়…ব্যক্তির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়…বা করতে পারে বা এ ধরনের তথ্যাদির মাধ্যমে কোনো ব্যক্তি বা সংগঠনের বিরুদ্ধে উসকানি প্রদান করা হয়, তাহলে তার এই কাজ অপরাধ বলে গণ্য হবে। কোনো ব্যক্তি এই অপরাধ করলে তিনি অনধিক চৌদ্দ বছর এবং অন্যূন সাত বছর কারাদণ্ডে এবং অনধিক এক কোটি টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন।’

মানুষকে ৫৭ ধারা লঙ্ঘন করতে উসকানি দেওয়ার পাশাপাশি ভিডিও নির্মাতারা নিজেরাও কিন্তু আইনটি লঙ্ঘন করেছেন। তাঁরা এমন এক ইলেকট্রনিক কনটেন্ট প্রচার করছেন, যা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটাতে পারে। কারণ, তাঁরা এই ভিডিওর মাধ্যমে নারীদের অনলাইনে ও অফলাইনে হয়রানি করতে উদ্বুদ্ধ করেছেন।

এ ক্ষেত্রে আরও অনেক আইনগত বিষয় রয়েছে। যেমন এখানে একধরনের গণশাস্তি হিসেবে প্রকাশ্যে অপদস্থ করতে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। সদর্পে বলা হয়েছে, নারী ও পুরুষের উন্মুক্ত স্থানে চলাফেরার স্বাধীনতা সমান নয়। এটি খোদ আমাদের সংবিধানেরই লঙ্ঘন।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই ভিডিওর বিরুদ্ধে যাঁরা অবস্থান নিয়েছেন, তাঁরা এগুলোসহ আরও অনেক বিষয় বিশদভাবে আলোচনা করেছেন। তীব্র সমালোচনার জেরে ওই ভিডিও দ্রুতই সরিয়ে ফেলা হয় এবং নির্মাতাদের ডিএমপি তলব করে। ইন্টারনেটে নারীবিদ্বেষী কনটেন্টের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের আন্দোলনই প্রথম অস্ত্র। কিন্তু এটি ভুলে যাওয়া চলবে না যে এ ধরনের অপকর্ম প্রতিরোধের জন্য অনলাইনের বাইরেও লড়াই করা যায় এবং তা করার জন্য ও নির্মাতাদের বিচারের আওতায় আনার মতো যথেষ্ট রসদ বাংলাদেশের আইনেই রয়েছে।

অর্পিতা শামস মিজান: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের প্রভাষক। তিনি হার্ভার্ড ল স্কুলের এলএলএম ডিগ্রিধারী।
শাম্মি কুদ্দুস: হার্ভার্ড কেনেডি স্কুল ও স্ট্যানফোর্ড গ্র্যাজুয়েট স্কুল অব বিজনেসে স্নাতক পর্যায়ের শিক্ষার্থী।