সেতু বানাক, সেতু ভাঙুক—আমাদের কী আসে যায়!

তুরাগ নদীতে যে সেতুটির কাজ চলছে তা সামনে ভেঙে ফেলতে হবে
ছবি: দীপু মালাকার


জীবন মানেই নাকি ভাঙাগড়ার খেলা। নদীর চরিত্রও সে রকম বলেই আমরা জানি। নদী বা মানুষের এই ভাঙাগড়ার জীবনের সঙ্গে আমাদের দেশের ‘উন্নয়ন’-এর বড় বেশি মিল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে। সাধারণভাবে আমরা জানি উন্নয়ন মানে গড়া, কিন্তু আমাদের দেশে এর সঙ্গে ভাঙারও সম্পর্ক আছে। কিছু না ভেঙে আমরা উন্নয়ন করতে পারি না। সমস্যা হয় তখনই, যখন ‘উন্নয়ন’ করতে হবে কিন্তু ভাঙার কিছু নেই। ফলে ভাঙার জন্যই কিছু গড়তে হয়! তা না হলে উন্নয়ন ঠেকে যাবে যে!

ঢাকার চারপাশের নদীতে ১৬টি সেতু এমনভাবে বানানো হয়েছে যেগুলোর নিচ দিয়ে নৌযান চলাচল করতে পারে না। বিশেষ করে বর্ষার সময়। ঢাকার আয়তনের তুলনায় যে রাস্তা থাকার কথা, তা নেই। রাস্তার ওপর চাপ কমাতে ঢাকার চারপাশে বৃত্তাকার নৌপথ চালুর পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল। সেটা সফল হচ্ছে না, কারণ এই সেতুগুলোর কারণে নৌযান চলতে পারে না। শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত হয়েছে, এই সেতুগুলো ভেঙে আবার নতুন সেতু হবে। এতে ক্ষতির পরিমাণ কত? ১৬০০ কোটি টাকা মাত্র! স্বল্পোন্নত দেশ থেকে আমরা উন্নয়নশীল দেশ হলাম বলে, এই অর্থের ক্ষতি কি এখন আমাদের গায়ে লাগা উচিত?

এই সেতুগুলো কেন তৈরি হয়েছিল, কারা এর পরিকল্পনা করেছিলেন—এর জবাবদিহি হবে, এমন আশা কেউ করে না। কারণ, যেকোনো প্রকল্প মানেই আমাদের মতো দেশে ভাগ-বাঁটোয়ারার একটা ব্যাপার থাকে। যে প্রতিষ্ঠান বা ঠিকাদার কাজ পান, তাঁর কিছু রুটি-রুজির ব্যবস্থা হয়, কিছু শ্রমিকের কর্মসংস্থান হয়। কিছু পার্সেন্টেজ এদিক-সেদিক যায়, ফলে কিছু লোকের পকেট ভারী হয়। অর্থনীতিতেও নাকি এর একটি ভূমিকা আছে। মিলেমিশে এমন ভাগ-বাঁটোয়ারাকে আমাদের অর্থনীতিবিদদের অনেকে ‘ক্রোনি ক্যাপিটালিজম’ বলেন। এর একটি বাংলাও আছে; ‘স্বজনতোষী অর্থনীতি’। এখানে যেহেতু অনেকর স্বার্থ জড়িত, তাই এসব অনিয়মের অভিযোগের কোনো বিহিত মেলে না। এই ১৬০০ কোটি টাকার বিষয়টি গায়ে না লাগানোই তাই মনে হয় বুদ্ধিমানের কাজ।

কিন্তু এতেই বিষয়টি শেষ হয়ে যাচ্ছে, এমন নয়। ১৬ সেতুর সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে আরও দুটি সেতু। এই দুটি সেতুও হচ্ছে আগের মতোই পরিকল্পনা ছাড়া। তুরাগ নদে রেলওয়ে এই দুটি সেতু এমন উচ্চতায় বানাচ্ছে, যেগুলোর নিচ দিয়ে বর্ষায় নৌযান চলতে পারবে না। যে সেতু দুটি ১১০ কোটি টাকা খরচ করে বানানোর কাজ চলছে, তা-ও সামনে ভেঙে ফেলতে হবে। মানে ১৬০০ কোটি টাকার সঙ্গে যুক্ত হতে যাচ্ছে আরও ১১০ কোটি টাকা। সঙ্গে সেতু দুটি ভাঙার কিছু খরচ এবং ভবিষ্যতে যথাযথভাবে পরিকল্পিত সেতু নির্মাণের খরচ। আগে যে ১৬টি সেতু ভুলভাল পরিকল্পনায় তৈরি হয়েছে, তার অর্থনাশের বিষয়টি না হয় মানা গেল। কিন্তু ভাঙতে হবে জেনেও দুটি সেতু তৈরি হচ্ছে এবং এর কাজ এগিয়ে চলেছে—এটা মানতে কেমন লাগছে?

অনিয়ম-দুর্নীতির ‘বাছুর’ কোলে নিতে নিতে আমরাও তো দুর্নীতির আস্ত গরুকে কোলে নিতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি। হাজার-হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি, লুটপাট বা বিদেশে পাচারের খবর শুনতে শুনতে এসব শতকোটি টাকার দুর্নীতি কি আর এখন আমাদের গায়ে লাগে!

পটুয়াখালীর আন্ধারমানিক নদীতে সেতু তৈরির আরেকটি কাহিনিও আমরা জানি। ১২০ কোটি টাকা খরচ করে এটি বানানো হয়েছে। কিন্তু এই সেতু দিয়ে উদ্দেশ্য সাধন হবে না। ভারী যানবাহন চলাচল করতে পারবে, এমন করে সেতুটি বানানো হয়নি। যে পায়রা সমুদ্রবন্দর তৈরি হচ্ছে, তার কোনো কাজেই লাগবে না এই সেতু। এখন এই সেতুর তিন কিলোমিটার দূরে আরেকটি সেতু বানাতে হচ্ছে। বাজেট ৭৩৫ কোটি টাকা। সবকিছুকেই নেতিবাচকভাবে দেখেন বলে যাঁদের বদনাম রয়েছে, তাঁরা দয়া করে এখানে ইতিবাচক দিকের সন্ধান করুন। মানসিক শান্তির জন্য এটা জরুরি। আন্ধারমানিক নদের ওপর নতুন একটি সেতু বানাতে হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু এখনকার সেতুটি অন্তত ভাঙতে হচ্ছে না!

একটা গল্প বলি। এক লোকের গাভি একটি বাচ্চার জন্ম দিয়েছে। বাছুরটি লাফালাফি করে, আদর করার মতো একটা বাচ্চা। লোকটি সকালে ঘুম থেকে উঠে বাছুরটিকে আদার করেন আর কোলে নেন। তিনি প্রতিদিনই এই কাজটি করতে থাকেন। এক বছর পর তিনি হঠাৎ খেয়াল করেন বাছুরটি আর বাছুর নেই। বড়সড় গরুতে রূপ নিয়েছে এবং তিনি তখনো একে কোলে নিতে পারছেন। প্রতিদিন কোলে নিতে নিতে লোকটির ওজন নেওয়ার ক্ষমতা দিনে দিনে এতটাই বেড়েছে যে তিনি এখন আস্ত একটি গরু কোলে নিতে পারছেন।

পাঠক হয়তো ভাবছেন, এই গরুর গল্পের সঙ্গে পরিকল্পনা ছাড়া সেতু বানানো, সেই সেতু ভাঙা, অর্থর অপচয় বা অনিয়ম-দুর্নীতির সম্পর্ক কী? সম্পর্কটা এসবের সঙ্গে আমাদের অভ্যস্ততার। অনিয়ম-দুর্নীতির ‘বাছুর’ কোলে নিতে নিতে আমরাও তো দুর্নীতির আস্ত গরুকে কোলে নিতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি। হাজার-হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি, লুটপাট বা বিদেশে পাচারের খবর শুনতে শুনতে এসব শতকোটি টাকার দুর্নীতি কি আর এখন আমাদের গায়ে লাগে! সেতু বানাক, সেতু ভাঙুক—আমাদের কী আসে যায়!

এ কে এম জাকারিয়া প্রথম আলোর উপসম্পাদক
[email protected]