সৈয়দ আবুল মকসুদ ও বাংলাদেশের অন্তর-বাহির

প্রতি মঙ্গলবার প্রথম আলোয় মকসুদ ভাইয়ের লেখা ছাপা হয়। সোমবার সকালে তিনি টেলিফোন করে বলতেন, লেখা তৈরি, কাউকে পাঠিয়ে দেন। এর ব্যত্যয় ঘটেছে এমন নজির নেই বললেই চলে। গত সোমবার সকালে তাঁর টেলিফোন না পেয়ে সহকর্মী এ কে এম জাকারিয়া নিজেই টেলিফোন করলেন। মকসুদ ভাই টেলিফোন ধরে বললেন, গায়ে জ্বর জ্বর। মনে হয় ভাইরাল। দু-এক দিনেই সেরে যাবে। জাকারিয়া লেখার কথা না বলে তাঁকে বিশ্রাম নিতে বললেন। পরদিন সন্ধ্যায় খবর এল মকসুদ ভাই নেই। খবরটি শুনে আমরা স্তব্ধ হয়ে গেলাম।

এ কেমন চলে যাওয়া মকসুদ ভাই!

প্রথম আলোর জন্মলগ্ন থেকেই এর সঙ্গে অবিচ্ছিন্ন ছিলেন সৈয়দ আবুল মকসুদ। ব্যক্তিগতভাবে আমার সঙ্গে পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতা আরও আগে থেকে, লেখালেখির সূত্রেই। তখন মকসুদ ভাই সরকারি বার্তা সংস্থা বাসস-এর উপবার্তা সম্পাদক। আমি কাজ করি সংবাদ-এ। কাছাকাছি অফিস হওয়ায় মাঝেমধ্যে দেখা হতো। দেশ-রাজনীতি নিয়ে আলাপ হতো। যুক্তরাষ্ট্র ইরাকে হামলা চালিয়ে নিরীহ মানুষ হত্যা করলে মকসুদ ভাই এর প্রতিবাদ করলেন অভিনব উপায়ে। তিনি শপথ নিলেন, যত দিন ইরাকে আগ্রাসী বাহিনী থাকবে, তত দিন পশ্চিমাদের উদ্ভাবিত সেলাই করা কাপড় পরবেন না। সেই থেকে সেলাইবিহীন ধবধবে সাদা কাপড় পরতেন তিনি। ঘরে-বাইরে, শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষায় তাঁর পরনে সেই পোশাকই শোভা পেত।

সেই থেকে মকসুদ ভাই বাংলাদেশের মানুষের কাছে পরিচিত হলেন ‘গান্ধী’ হিসেবে। অনেকে আড়ালে হাসি–ঠাট্টাও করতেন। তিনি তাঁর অবস্থান থেকে সরে যাননি, নিজের পোশাককে প্রতিবাদের প্রতীকে পরিণত করেছিলেন। এমনকি মাওলানা ভাসানীর ওপর যুক্তরাষ্ট্রে আয়োজিত আন্তর্জাতিক সেমিনারেও তিনি যোগ দিয়েছিলেন এই পোশাক পরে। আমাদের সংঘ ও রাষ্ট্রশক্তি যখন বধির ও বোবার ভূমিকায়, তখন ব্যক্তিগত প্রতিবাদও অনেক গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।

ইরাকে যখন যুক্তরাষ্ট্র হামলা করে, তখন বাংলাদেশে বিএনপির শাসনকাল। সরকারের নীতিনির্ধারকেরা সৈয়দ মকসুদের এ ব্যতিক্রমী প্রতিবাদ পছন্দ করেননি। এর মধ্যে তিনি দু-একটা পত্রিকায় কলামও লিখতেন। সরকার থেকে চাপ দেওয়া হলো তিনি যেন লেখালেখি বন্ধ করেন। একপর্যায়ে তিনি বাসস থেকে চাকরি ছেড়ে দিলেন। এরপর লেখালেখিই হয়ে ওঠে তাঁর প্রধান কাজ। প্রথম আলোতে তাঁর দুটি কলাম ‘সহজিয়া কড়চা’ ও ‘বাঘা তেঁতুল’ অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়েছিল। যদিও পত্রিকায় কলাম লেখার অনেক আগেই সৈয়দ আবুল মকসুদ লেখক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। প্রবন্ধ, গবেষণা, জীবনী, ভ্রমণকাহিনি, কবিতা—সাহিত্যের এমন কোনো শাখা নেই, যেখানে তাঁর স্বাচ্ছন্দ্য পদচারণ ছিল না।

সৈয়দ আবুল মকসুদ একদা বামপন্থী রাজনীতি করতেন। বাম রাজনীতির ধর্ম হলো ‘যে যত কড়া সে তত গোঁড়া’। মকসুদ ভাইয়ের মধ্যে কোনো গোঁড়ামি বা সংকীর্ণতা ছিল না। তিনি বিচিত্র বিষয় নিয়ে লিখতেন। মকসুদ ভাই মাওলানা ভাসানীর অনুসারী ছিলেন, তাঁর জীবনী ছাড়াও কাগমারী সম্মেলন নিয়ে আলাদা বই লিখেছেন। তাই বলে জাতীয়তাবাদী নেতা বঙ্গবন্ধু কিংবা অন্য নেতাদের অবদানকে যে খাটো করে দেখেননি, প্রথম আলোর পাতা খুললেই তার প্রমাণ পাওয়া যাবে। তিনি ৭ মার্চের বঙ্গবন্ধুর ভাষণ, ছয় দফা কর্মসূচি, অসহযোগ আন্দোলন, মুজিবনগর সরকার নিয়েও লিখেছেন। ইতিহাসে, সমাজে যাঁর যা প্রাপ্য, তাঁকে তা দিয়েছেন। সৈয়দ মকসুদ যেমন মহাত্মা গান্ধী, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্‌কে নিয়ে বই লিখেছেন, তেমনি লিখেছেন মুসলিম লীগ নেতা সলিমুল্লাহকে নিয়েও। গবেষণা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিয়েও।

বাংলাদেশের লেখক-বুদ্ধিজীবী-সাংবাদিকদের বেশির ভাগই দলীয় বৃত্তে বন্দী এবং ক্ষমতাসীনদের নামে জয়ধ্বনি দিতে উদ্‌গ্রীব। অনেকে ব্যক্তিস্বার্থে সরকারের অন্যায় কাজের সাফাই গাইতেও দ্বিধা করেন না। স্বাধীনতার পর থেকে এ ধারা চলে আসছে। পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর যাঁরা নীরব ছিলেন কিংবা ক্ষমতাসীনদের বন্দনায় ব্যস্ত ছিলেন, তাঁদের কেউ কেউ এখন মহা আওয়ামী লীগার সেজেছেন। কিন্তু সৈয়দ আবুল মকসুদ বরাবর সাদাকে সাদা এবং কালোকে কালোই বলতেন, কারও প্রতি কঠোর ভাষা ব্যবহার না করেই। তাঁর লেখায় আবেগ ও গালাগালের চেয়ে যুক্তি ও তথ্য প্রাধান্য পেয়েছে। তাঁর কলাম জনপ্রিয় হওয়ার এটাও কারণ। প্রথম দিকে মকসুদ ভাই অনেকটা গল্পের ঢঙে লিখতেন বড় পরিসরে। পরে পরিসর কমে গেলে সেই স্বতঃস্ফূর্ততা কিছুটা কমে যায়। এ নিয়ে মাঝেমধ্যে আক্ষেপও করতেন।

তবে সৈয়দ আবুল মকসুদ লেখার মধ্যেই তাঁর জীবনসাধনা সীমিত রাখেননি। বিশেষ করে গত দুই দশক তিনি চারণের মতো সারা দেশ ঘুরেছেন; যেখানে দুর্বল সবলের দ্বারা পীড়িত হয়েছে, ছুটে গেছেন। নিরাপদ সড়ক, ধর্মীয় সংখ্যালঘু কিংবা ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষের ন্যায্য দাবিতে বরাবর সোচ্চার ছিলেন তিনি। কখনো তাঁকে দেখতাম শহীদ মিনার বা প্রেসক্লাবের সামনে একাই অন্যায়ের প্রতিবাদ করছেন। আবার সরকার জনহিতকর কোনো কর্মসূচি নিলে তার প্রতি সমর্থনও জানিয়েছেন। মঞ্চে তিনি খুব স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন না। সৈয়দ মকসুদ সেসব বিষয় নিয়ে গবেষণা করতেন, যেসব বিষয় প্রথাগত পণ্ডিতেরা উপেক্ষা করতেন। বাংলাদেশের অন্তর-বাহির জানতে সৈয়দ আবুল মকসুদকে পড়তে হবে।

দেখা হলেই তিনি তাঁর পরবর্তী বই কিংবা গবেষণা নিয়ে কথা বলতেন। কলকাতার কোনো মুদির দোকান থেকে কীভাবে গান্ধীর ডায়েরি উদ্ধার করলেন, কীভাবে আন্ডারগ্রাউন্ড নেতাদের সঙ্গে দেখা করতেন, সেসব গল্প বলতেন। মকসুদ ভাইয়ের সঙ্গে আর আমাদের দেখা হবে না, তাঁর কথাও শুনতে পাব না, পাঠক তাঁর নতুন লেখা পড়তে পারবেন না, এ কথা ভাবতেও মন ভারী হয়ে ওঠে।

করোনাকাল আমাদের অনেক প্রিয় মানুষকে কেড়ে নিয়েছে, প্রথম আলোর সঙ্গে সরাসরি ও নানাভাবে যুক্ত অনেককে আমরা হারিয়েছি। প্রথমে গেলেন জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, তারপর শিল্পী মুর্তজা বশীর, প্রকৌশলী জামিলুর রেজা চৌধুরী, তারপর লেখক-কবি আবুল হাসনাত, সাংবাদিক মুনীরুজ্জামান, তারপর সহকর্মী মিজানুর রহমান খান। এবার হারালাম সৈয়দ আবুল মকসুদকে। বুধবার সকালে যখন এ লেখা লিখছি, তখনই খবর পেলাম বিশিষ্ট ব্যাংকার খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদও আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। এ বেদনার ভার কী করে বইব আমরা?

মকসুদ ভাই কেবল প্রথম আলোর নিয়মিত লেখক ছিলেন না, ছিলেন প্রথম আলো পরিবারের সদস্য। তিনি নিজেকে প্রথম আলোর একজন মনে করতেন। প্রথম আলোর ভালো খবরে তিনি ভীষণ আনন্দিত হতেন। আবার প্রথম আলোর ওপর মহল বিশেষের চাপ তাঁকে বিচলিত করত। একাধিকবার লেখক-বুদ্ধিজীবীদের সই সংগ্রহ করার উদ্যোগ নিয়ে কীভাবে বিফল হয়েছেন, তা-ও বলেছেন।

সৈয়দ আবুল মকসুদের নিশ্চয়ই একটি রাজনৈতিক দর্শন ছিল। কিন্তু সেই রাজনীতির কারণে কাউকে দূরে ঠেলে দেননি, হৃদয়ের ঔদার্যে সবাইকে কাছে টেনে নিয়েছেন। এই ছিলেন সৈয়দ আবুল মকসুদ। তিনি আমাদের সঙ্গে ছিলেন, আছেন, থাকবেন।

সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি

[email protected]