সোমালিয়াকে আফগানিস্তান থেকে শিক্ষা নিতে হবে

সোমালিয়ায় সরকারি বাহিনীর সঙ্গে লড়াইরত বিদ্রোহী গোষ্ঠী।
ফাইল ছবি: এএফপি

সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ ২০১০ সালে প্রকাশিত তাঁর ‘ডিসিশন পয়েন্টস’ শিরোনামের স্মৃতিকথায় তিনি কেন আফগানিস্তানে অভিযান চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, তার বর্ণনা দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন: ‘আফগানিস্তান ছিল অনিবার্যভাবেই আমাদের একটি জাতি গঠনের মিশন। একটা আদিম একনায়কত্ব ব্যবস্থা থেকে আমরা দেশটিকে মুক্ত করেছিলাম এবং দেশটির জন্য ভালো কিছু রেখে যাওয়ার বিষয়ে আমাদের নৈতিক বাধ্যবাধকতা ছিল। আফগানিস্তানে একটি মুক্ত সমাজ গঠনের মধ্যে আমাদের একটি কৌশলগত স্বার্থও ছিল, কারণ, আমরা জানতাম, গণতান্ত্রিক আফগানিস্তান উগ্রপন্থীদের আফগানিস্তানের একটি আশাবহ বিকল্প হবে।’

আফগানিস্তানে পশ্চিমাদের দখলদারির ২০ বছর পর কাবুল বিমানবন্দরে যেভাবে পশ্চিমাদের এবং তাদের সহায়তাকারী আফগানদের হুড়োহুড়ি করে পালাতে দেখা গেল, তাতে বুশের ভবিষ্যদ্বাণী করা সেই ‘আশাবহ বিকল্পের’ চিহ্নমাত্র দেখা গেল না। লাখো মানুষের জীবন বলি দিয়ে, কোটি কোটি ডলার ঢেলে, আফগান সেনাবাহিনী ও পুলিশ বাহিনীকে সর্বাধুনিক অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ দিয়েও আফগানিস্তানে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা সফল হয়নি। সেখানে এখন তালেবান তাদের নিজস্ব শাসনব্যবস্থা চালু করতে যাচ্ছে।

এটি সোমালিয়ায় উগ্রপন্থী গ্রুপগুলোর সঙ্গে লড়াইরত যোদ্ধাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষণীয় ঘটনা। আফগানিস্তানে যেভাবে যুক্তরাষ্ট্র জাতি গঠনের পরীক্ষা নিরীক্ষা চালাতে গিয়েছিল, ঠিক একইভাবে আফ্রিকান ইউনিয়ন মিশন টু সোমালিয়া (এমইসোম) সোমালিয়ায় জাতি গঠনের নিরীক্ষা চালাচ্ছে। ১৪ বছর ধরে পশ্চিমাদের সমর্থন নিয়ে আফ্রিকান দেশগুলো এক জোট হয়ে সোমালিয়ায় আল–কায়েদার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সন্ত্রাসী গ্রুপ আল শাবাবের বিরুদ্ধে লড়াই করছে। এইমসোমের অধীনে উগান্ডা, বুরুন্ডি, জিবুতি, কেনিয়া ও ইথিওপিয়া থেকে নিয়ে আসা সেনারা এক জোট হয়ে আল শাবাবকে প্রতিহত করে সোমালিয়ার দুর্বল সরকারকে টিকিয়ে রাখছে। দেশটির বেসামরিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে কার্যকর রাখতে এইমসোমের হাতে বেসামরিক লোকবল ও পুলিশও আছে।

বছরে প্রায় ৯০ কোটি ডলার খরচ করে আর বহু বছর ধরে সামরিকভাবে অক্লান্ত চেষ্টা করেও মোগাদিসু সরকার দুর্বলই রয়ে গেছে এবং দেশের সব মানুষের মত বিবেচনায় আনলে জনগণের কাছে মোগাদিসু সরকারের বৈধতাও খুব একটা নেই। ইসলামপন্থী জঙ্গিরা শহরাঞ্চলে কোণঠাসা থাকলেও দেশের বেশির ভাগ গ্রাম প্রধান এলাকা তাদেরই দখলে এবং তারা ইচ্ছা করলে রাজধানীতে ভয়ানক বিপর্যয় ঘটানোর মতো হামলা চালানোর ক্ষমতা রাখে।

সাধারণ জনগণের রুটিরুজির নিশ্চয়তার জন্য আরও বেশি কর্মসংস্থান দরকার। সরকারের মধ্যে দুর্নীতির আধিক্য ও আইনের শাসনের ঘাটতি থাকলে তা সরকারের প্রতি মানুষকে বীতশ্রদ্ধ করে এবং জনসমর্থন জঙ্গিদের দিকে ঝুঁকে যায়। এই শিক্ষা সোমালিয়াকে নিতে হবে। নয়তো সেখানকার অবস্থাও আফগানিস্তানের মতো হতে পারে।

আফগানিস্তানের মতো সোমালিয়াতেও জঙ্গিগোষ্ঠী আল শাবাবকে মোগাদিসু এবং কয়েকটি শহর থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার পর দেশটিতে কিছু অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হয়েছে। বিশ্বব্যাংকের হিসাবমতে, ২০১৫ ও ২০১৬ সালে দেশটির জিডিপি প্রবৃদ্ধি ছিল ৫-৬ শতাংশ। কিন্তু এই প্রবৃদ্ধি ছিল শহরভিত্তিক। দাতাদের দান খয়রাত এবং বিদেশে থাকা সোমালিয়ানদের দেশে পাঠানো বৈদেশিক অর্থই এর চালিকা শক্তি।

২০০৬ সালের ডিসেম্বরে সোমালিয়ায় তৎকালীন ইসলামপন্থীদের সংগঠন দ্য ইউনিয়ন অব ইসলামিক কোর্টস ক্ষমতা দখল করে ইথিওপিয়ার বিরুদ্ধে ‘জিহাদের’ ডাক দেয়। এরপরই যুক্তরাষ্ট্রসমর্থিত ইথিওপিয়ার বাহিনী সোমালিয়ায় ইউনিয়ন অব ইসলামিক কোর্টস (ইউআইসি)-এর বিরুদ্ধে অভিযান চালায় এবং তাদের ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেয়। এরপর সেখানে পশ্চিমাদের ভাষায় শান্তি প্রতিষ্ঠা হয়।

সোমালিয়ার ব্যবসায়ী নেতাদের মদদপুষ্ট ইউআইসি এর আগে নির্বিচার সহিংসতা চালানো কুখ্যাত যুদ্ধবাজ নেতাদের হটিয়ে সেখানে তালেবানের মতো শরিয়াভিত্তিক শাসন জারি করেছিল। তারা দেশটিতে তখন সিনেমা, সংগীত, খেলাধুলা নিষিদ্ধ করেছিল এবং নারীদের বোরকা পরতে বাধ্য করেছিল। কিন্তু তারা অপেক্ষাকৃত শান্তি ও সুশাসন নিশ্চিত করতে পেরেছিল এবং মানুষ তখন অনেকটা নিশ্চিন্তে চলাচল করতে পারত।

কিন্তু ইথিওপিয়া দখলদারি অভিযান চালানোর পর ইউআইসির শাসনের অবসান ঘটে এবং সেই ইউআইসি এখন কার্যত আল শাবাব জঙ্গিগোষ্ঠীতে পরিণত হয়েছে। এরপর ২০০৯ সালে সোমালিয়া থেকে ইথিওপিয়ার বাহিনী সরিয়ে আনা হয়। তখন থেকে সোমালিয়ায় ইথিওপিয়ার বসিয়ে দেওয়া সরকার মূলত উগান্ডা ও বুরুন্ডির কয়েক হাজার সেনার সমর্থন নিয়ে টিকে আছে।

সম্প্রতি ফিন্যান্সিয়াল টাইমস পত্রিকায় নাইজেরিয়ার প্রেসিডেন্ট মুহাম্মাদু বুহারি একটি কলামে লিখেছেন, আফগানিস্তান থেকে আফ্রিকানদের শিক্ষা নিতে হবে, জঙ্গিদের পরাজিত করার জন্য শুধু সামরিক শক্তিই যথেষ্ট নয়। জঙ্গিবাদ ফিরে আসার মূল কারণ উপড়ে ফেলা সবচেয়ে জরুরি। তিনি বলেছেন, ‘আফ্রিকা থেকে সন্ত্রাস নির্মূল করতে তরবারি নয়, লাঙল দরকার।’ অর্থাৎ সাধারণ জনগণের রুটিরুজির নিশ্চয়তার জন্য আরও বেশি কর্মসংস্থান দরকার। সরকারের মধ্যে দুর্নীতির আধিক্য ও আইনের শাসনের ঘাটতি থাকলে তা সরকারের প্রতি মানুষকে বীতশ্রদ্ধ করে এবং জনসমর্থন জঙ্গিদের দিকে ঝুঁকে যায়। এই শিক্ষা সোমালিয়াকে নিতে হবে। নয়তো সেখানকার অবস্থাও আফগানিস্তানের মতো হতে পারে।

আল–জাজিরা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত

প্যাট্রিক গাথারা নাইরোবিভিত্তিক লেখক ও আন্তর্জাতিক পুরস্কারপ্রাপ্ত কার্টুনিস্ট