সৌদি থেকে মুখ ঘুরিয়ে তুরস্কের দিকে পাকিস্তান

পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান
রয়টার্স ফাইল ছবি

দক্ষিণ এশিয়ায় ফেসবুকে সক্রিয় আছেন, এমন কাউকে পাওয়া কঠিন, যিনি তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের নামে খোলা কোনো ফ্যান পেজ দেখেননি। এরদোয়ানের ভক্তরা ‘দ্য ফ্লাগবেয়ারার অব দ্য উম্মাহ’, ‘মাই প্রেসিডেন্ট’, ‘লায়ন অব ইসলাম’, ‘লিডার অব দ্য মুসলিমস’ ইত্যাদি নামে এসব পেজ খুলেছেন। সারা বিশ্বের, বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ার মুসলমান সম্প্রদায়ের তরুণদের মধ্যে এরদোয়ান যে তুমুল জনপ্রিয় হয়ে উঠেছেন, তা ওই সব পেজে চোখ বোলালেই বোঝা যাবে।

গুগলের উপাত্ত দেখাচ্ছে, এ বছর পাকিস্তানে ‘অটোমান’ কি–ওয়ার্ড দিয়ে গুগলে সার্চ করার প্রবণতা তীব্রগতিতে বেড়ে গেছে। এ ছাড়া অটোমান সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা প্রথম উসমানের পিতা দিরিলিসের জীবনকাহিনি নিয়ে বানানো তুর্কি টিভি সিরিজ ‘দিরিলিস: এরতুগরুল’ (পুনরুত্থান: দিরিলিস) সম্প্রতি পাকিস্তানসহ মুসলিম অধ্যুষিত দেশগুলোতে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। এমনকি তুরস্কের চেয়েও পাকিস্তানে এ টিভি সিরিজ বেশি দর্শকপ্রিয়তা পেয়েছে। মধ্য এশিয়া ও আফ্রিকার কিছু অংশেও সিরিজটি জনপ্রিয়তা পেয়েছে।

প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের সাম্প্রতিক তৎপরতার মধ্যে তুরস্কের অতীত ঐতিহ্যের ওপর বিশেষ জোর দেওয়া হচ্ছে। এর মাধ্যমে আসলে ইসলামের সাম্রাজ্য বিস্তারকালকেই মূলত মহিমান্বিত করার প্রয়াস রয়েছে। রাজনৈতিক, কূটনৈতিক ও কৌশলগত সব ব্যবস্থা যন্ত্র সেই আলোকেই কাজ করছে। গত জুলাইয়ে হায়া সোফিয়াকে আবার মসজিদে রূপান্তর করার মধ্য দিয়ে এরদোয়ান তাঁর অবস্থান পরিষ্কার করেছেন। এর মধ্য দিয়ে তিনি তাঁর নব্য অটোমান অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়নের পথে এগোচ্ছেন। বিষয়টি মুসলিম বিশ্বের সাধারণ নাগরিকদের মধ্যে একধরনের আন্দোলন সৃষ্টি করেছে। সেই আন্দোলনের ঢেউ পাকিস্তানের গায়েও আছড়ে পড়েছে।

পাকিস্তানকে সংস্কৃতিগতভাবে ‘এতিম’ রাষ্ট্র বলা যেতে পারে। দেশটি তার নিজস্ব ইতিহাস ও সংস্কৃতিকে সর্বাংশে ধারণ করতে ব্যর্থ হয়েছে। তারা মুহম্মদ ঘোরির মতো ভারতবর্ষে বাইরের দেশ থেকে আসা অধিপতিদের নিয়ে গৌরববোধ করে। জহির উদ্দীন মুহম্মদ বাবুরের সালতানাত নিয়েও তাদের গৌরবের শেষ নেই। আফগানিস্তান থেকে পাকিস্তানে আগ্রাসন চালানো ঐতিহাসিক নেতাদের নামে তাদের একাধিক ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের নামকরণ করা হয়ে। অন্যদিকে পাকিস্তান ভূখণ্ডে মুসলিমদের শাসনের আগে হিন্দু ও বৌদ্ধ নরপতিদের যে শাসনকাল, তার চিহ্নকে তারা নিজেদের ঐতিহ্য বলে প্রচার করতে লজ্জা পায়। দেশটির সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারকদের মধ্যে এ সংকীর্ণ চিন্তার ছাপ দেখা যায়। অন্যের ওপর নির্ভরশীলতার মনোভাবের কারণে দেশটি রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে কোনো দিনই থিতু হতে পারেনি।

পাকিস্তান প্রথমে প্যান ইসলামিজমের ধারণায় ভর করে আরব বিশ্বের পৃষ্ঠপোষকতা চেয়েছে। কিন্তু সৌদি আরবে পাকিস্তানি শ্রমিকদের প্রতি যেভাবে বৈষম্যমূলক আচরণ করা হয়েছে, তা পাকিস্তানকে আশাহত করেছে। বিশুদ্ধতাবাদী সালাফি ও ওহাবি মতাদর্শের আরবরা পাকিস্তানিদের নৃতাত্ত্বিকভাবে অ-আরব ও অমুসলিম আকিদার লোক বলে মনে করে। এতে পাকিস্তানিরা সৌদি আরব ও অন্য আরব দেশগুলোর ওপর ক্ষুব্ধ। এরপর বিশেষ করে ভারতের সঙ্গে সৌদি আরবের সম্পর্কের উন্নয়ন পাকিস্তানকে প্রচণ্ডভাবে আশাহত করে।

ভারতের কাশ্মীরে মুসলমানদের সঙ্গে ভারত সরকার উৎপীড়নমূলক আচরণ করছে উল্লেখ করে পাকিস্তান ওআইসিকে ভারতের নিন্দা জানাতে বলেছিল। রিয়াদের পক্ষ থেকে সে আবেদন খারিজ করে দেওয়া হয়। এর আগে ওআইসির সম্মেলনে ভারতকে পর্যবেক্ষক হিসেবে আমন্ত্রণ জানানোর পর পাকিস্তান তার বিরোধিতা করেছিল। তাও সৌদি কানে তোলেনি। ভারতীয় পাইলট অভিনন্দন বর্তমান পাকিস্তানের হাতে আটক হওয়ার পর সৌদি আরব তাঁকে ছেড়ে দেওয়ার জন্য পাকিস্তানকে চাপ দিয়েছিল। সেটিও পাকিস্তানকে ক্ষুব্ধ করে। সর্বশেষ পাকিস্তানকে সহজ শর্তে দেওয়া ঋণ–সুবিধাও তুলে নেয় সৌদি আরব।

ভারতের কাশ্মীরে মুসলমানদের সঙ্গে ভারত সরকার উৎপীড়নমূলক আচরণ করছে উল্লেখ করে পাকিস্তান ওআইসিকে ভারতের নিন্দা জানাতে বলেছিল। রিয়াদের পক্ষ থেকে সে আবেদন খারিজ করে দেওয়া হয়। এর আগে ওআইসির সম্মেলনে ভারতকে পর্যবেক্ষক হিসেবে আমন্ত্রণ জানানোর পর পাকিস্তান তার বিরোধিতা করেছিল। তাও সৌদি কানে তোলেনি

অন্যদিকে তুরস্ক কাশ্মীর ইস্যুতে ভারতের কড়া সমালোচনা করছে। ভারতে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন পাস হওয়ার পর এটিকে তুরস্ক ‘মুসলিমবিরোধী আইন’ বলে উল্লেখ করেছে। দিল্লিতে সংঘটিত দাঙ্গা মুসলমানদের ওপর গণহত্যা চালানো হয়েছে বলেও তুরস্ক অভিযোগ করেছে।

এসব কারণে পাকিস্তান এখন সৌদি আরব থেকে মুখ ঘুরিয়ে তুরস্কের দিকে যাচ্ছে। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের বেশ কিছু ভাষণে তুরস্কের বিষয়ে প্রশংসাবাণী শোনা যাচ্ছে।

তুরস্ক যদিও এখনো তার উদার পশ্চিমা সংস্কৃতিকে মুছে ফেলেনি। আরব বিশ্বের তুলনায় সেখানে নারী স্বাধীনতা অনেক বেশি। তবে এরদোয়ান ধীরে ধীরে কট্টরপন্থী ইসলামি জীবনাচরণ তুর্কি সমাজে প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছেন। একই সঙ্গে পাকিস্তান এবং মালয়েশিয়ায় সেই রক্ষণশীল মূল্যবোধের প্রচার চালিয়ে যাচ্ছেন। বিশেষ করে পাকিস্তানে এরদোয়ান আদর্শিক নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে উঠছেন।

এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত

পীতাম্বর কৌশিক: ভারতের লেখক ও সাংবাদিক