সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়: বুদ্ধিদীপ্ত কিন্তু অকৃত্রিম

কিংবদন্তী হয়ে ওঠা ভারতীয় বাঙালি অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়

মেধা আর মননশীলতা অভিনয়কে কতখানি বাস্তবের কাছে পৌঁছে দিতে পারে, সব ধরনের অভিনয়ের ভেতর দিয়ে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় তা দেখিয়ে গিয়েছেন। 'নীলদর্পণ'–এর অভিনয় দেখে ক্ষিপ্ত বিদ্যাসাগর মঞ্চের নীলকর সাহেবের দিকে নিজের পায়ের চটি ছুড়েছিলেন—এমন একটা প্রবাদ আছে। ব্যাপারটা তাঁর কাছে এতই সত্যিকার মনে হয়েছিল। উনিশ শতকের সেই প্রবাদ যেন সৌমিত্রের কমার্শিয়াল ফিল্ম বা থিয়েটার বা জীবনকেন্দ্রিক ছবি, যাকে 'আর্ট ফিল্ম' হিসেবে চিহ্নিত করতে আমরা অভ্যস্ত।
বাংলা ফিল্মে বোধের সংমিশ্রণের এই অভিনয়ে সৌমিত্রের তুলনা চলে উত্তমকুমারের সঙ্গেই। তবে সৌমিত্রের অভিনয়ে যে বুদ্ধিমত্তা, এতটুকু আর্টিফিশিয়াল ধরন না থাকা, এই সব প্রশ্নে তিনি যে উত্তমকুমারকেও ছাপিয়ে গিয়েছিলেন, এ কথা মুক্ত কণ্ঠেই স্বীকার করতে হয়।

সত্যজিৎয়ের 'নায়ক' ছবিতে অভিনয়ের পুরোনো ছাদ ভাঙার কথা উত্তমকুমারের চরিত্রটিতে আছে। সৌমিত্র ছিলেন এই ছাদ ভেঙে, সময়ের সঙ্গে তাল রেখে চলা এক অভিনেতা। 'অপুর সংসার' থেকে 'বেলাশেষে', বিস্তর সময়ের ব্যবধান রেখে দুরকম দুটি চরিত্র। কিন্তু একটিবারের জন্যও সেই চরিত্র দুটিতে সৌমিত্রবাবুকে কখনোই এতটুকু বেমানান মনে হয়নি। অপুর সংসারে চরিত্রের বোহিমিয়ান মানসিকতা ফোটাতেও তাঁর দক্ষতা ধরা দিয়েছিল। আবার রবীন্দ্রনাথের ‘নষ্টনীড়ে'র সত্যজিতের করা ফিল্মিরূপে চারুর সময়ের থেকে এগিয়ে থাকাকে সৌমিত্র যেন অনেক বেশি বাঙ্‌ময় করে তুলেছিলেন।
আর্ট ফিল্মে তো বটেই, কমার্শিয়াল ছবিতেও কিংবা পেশাদার মঞ্চে (যেমন নামজীবন বা টিকটিকি) সৌমিত্র কখনোই ওভার অ্যাক্টিং করেননি। সংলাপ ক্ষেপণের ভেতরেও (বাচিক শিল্পী হিসেবেও এই ধারাটি তিনি পরিপূর্ণভাবে বজায় রেখেছিলেন) কখনোই স্বরক্ষেপণের ওঠানামার ভেতর দিয়ে অতিনাটকীয়তার দিকে একটিবারের জন্যও ঝোঁকেননি।
‘ঝিন্দের বন্দি'—তপন সিংহের এই ছবিতে সৌমিত্র খলনায়কের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। নায়কের চরিত্রে ছিলেন উত্তমকুমার। দুই মহান অভিনেতার অভিনয় দক্ষতার এক অনবদ্য নিবেদন ছিল ফিল্মটি। সেখানেও সৌমিত্র খলনায়কের চরিত্র বিন্যাসের ক্ষেত্রে একটিবারের জন্যও অভিনয়ে এতটুকু অতিনাটকীয়তা দেখাননি। সাধারণভাবে বাংলা ফিল্মে খল চরিত্র অভিনয়ের ক্ষেত্রে অতিনাটকীয়তা দেখানো একটি দস্তুর। 'বাঘবন্দী খেলা'র মতো সম্পূর্ণ বাণিজ্যিক নয়, আবার এককথায় যাকে আর্ট ফিল্ম ও বলা যায় না, তেমন ফিল্মে খল চরিত্র নিবেদনে উত্তমকুমার স্বয়ং অতিনাটকীয়তার পরিচয় রেখেছিলেন কি না, এ নিয়ে চলচ্চিত্রমোদীদের মধ্যে যথেষ্ট বিতর্ক থাকলেও সৌমিত্র খল চরিত্রে অতিনাটকীয়তার বশবর্তী হয়েছেন, এ কথা কেউ বলতে পারবেন না।

আদর্শগত বোধে স্থিত থেকে কোনো রাজনৈতিক দলের ধামাধরা না হওয়া, আবার প্রয়োজনে রাষ্ট্রযন্ত্রের অন্যায়ের বিরুদ্ধে শামিল হওয়া—বর্তমান সময়ে প্রায় দুর্লভ এই গুণের অধিকারী ছিলেন সৌমিত্রবাবু।

চরিত্রচিত্রণে চরিত্রের সঙ্গে অভিনেতার নিজেকে মিলিয়ে দেওয়া, মিশিয়ে দেওয়া—সমাজমনস্কতার গভীর অনুরণন যদি না শিল্পীর ভেতরে থাকে, তাহলে তা সম্ভবপর নয়। মেধার সেই স্ফূরণের ক্ষেত্রে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের উত্তরণ যেভাবে ঘটেছিল, তেমনটা বাংলা ছবির ক্ষেত্রে খুব একটা দেখা যায় না। যে মেধাদীপ্তি সৌমিত্রের সব অভিনয়ের ভেতরেই বাঙালি দেখেছেন, সেটি সৌমিত্রের কোনো আরোপিত সত্তা ছিল না। মেধার চর্চায় তিনি যেভাবে নিজেকে শেষ দিন পর্যন্ত মাজাঘষা করে গিয়েছেন, এমনটা শোনা যায় অতীতের শিশির কুমার ভাদুড়ি সম্পর্কে। সৌমিত্র নিজেও শিশিরকুমারের অভিনয়, মেধা, আদর্শগত ভিত্তি, বিশেষকরে মার্ক্সবাদে গভীর বিশ্বাস, অথচ প্রত্যক্ষভাবে কোনো রাজনৈতিক দলের সদস্যপদ না নেওয়া—এগুলোর দ্বারা খুব বেশি তাড়িত ছিলেন। সেই মেধাদীপ্তিই সৌমিত্র তাঁর চরিত্রচিত্রণে সব থেকে বেশি পরিস্ফুট করেছেন।
আদর্শগত বোধে স্থিত থেকে কোনো রাজনৈতিক দলের ধামাধরা না হওয়া, আবার প্রয়োজনে রাষ্ট্রযন্ত্রের অন্যায়ের বিরুদ্ধে শামিল হওয়া—বর্তমান সময়ে প্রায় দুর্লভ এই গুণের অধিকারী ছিলেন সৌমিত্রবাবু। ছয়ের দশকে কল্লোল নাটক ঘিরে যখন শিল্পচর্চার ওপর রাষ্ট্রীয় হিংসা নেমে এসেছিল, তখন সত্যজিৎ রায়ের মতোই প্রতিবাদে শামিলই শুধু হননি সৌমিত্র, প্রতিরোধের সংকল্পেও দৃঢ়তা দেখিয়েছিলেন। কল্লোল ঘিরে উৎপল দত্ত যখন গ্রেপ্তার হন, সেই গ্রেপ্তারির বিরুদ্ধে সরাসরি অবস্থান গ্রহণ করেছিলেন, সভায় যোগ দিয়েছিলেন। সমাজমনস্কতার যে পরিচয় সৌমিত্র দেখিয়েছিলেন, তাঁর দীর্ঘ অভিনয়জীবনের সাথিদের বেশির ভাগই তেমন সুসংবদ্ধ সমাজমনস্কতার পরিচয় কিন্তু রাখতে পারেননি।
শাসক বদলেছে। নতুন শাসক কখনো তাঁকে যথোচিত সম্মান, মর্যাদা দিয়েছে। কখনো দেয়নি। সৌমিত্র কিন্তু অবিচল থেকেছেন। প্রশংসায় যেমন তিনি কখনো আপ্লুত হয়ে যাননি, তেমনই নিন্দাকারীর প্রতি কখনো এতটা অসূয়া সূচক মনোভাব প্রকাশ করেননি।
সত্যজিৎ রায়ের বিশেষ ঘনিষ্ঠ ছিলেন বলে সৌমিত্র অসূয়ার মনোভাব নিয়ে চলতেন ঋত্বিকের প্রতি, এমন একটা ভুল ধারণা অনেকেই সৌমিত্র সম্পর্কে চালু করে দিয়েছেন। সৌমিত্রের সত্যজিৎ রায়কে ঘিরে অবিচল শ্রদ্ধা ছিল বলে তিনি ঋত্বিকের প্রতি শ্রদ্ধাহীন ছিলেন; এই রকম ধারণার কোনো বাস্তব সত্যতা নেই।


গৌতম রায় পশ্চিমবঙ্গের গবেষক ও ইতিহাসবিদ।