স্কুল ফিডিংয়ে ‘কাজলী মডেল’ কেন নয়

প্রতীকী ছবি

১৯ সেপ্টেম্বর ২০২০ তারিখের প্রথম আলোয় প্রকাশিত সোহরাব হাসানের কলাম ‘পেঁয়াজের ঝাঁজ, খিচুড়ির স্বাদ ও সরকারের ভাবমূর্তি’ আমাকে এই কলাম লিখতে অনুপ্রাণিত করেছে। সরকারের প্রাইমারি স্কুল ফিডিং কর্মসূচি প্রকল্পে ৫০০ জন মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারী ও শিক্ষককে ভারতের কেরালায় পাঠিয়ে ফিডিং ব্যবস্থাপনা সরেজমিনে দেখে আসার জন্য পাঁচ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখার প্রস্তাব করা হয়েছিল, যেটা নিয়ে দেশের সংবাদমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সম্প্রতি তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে। খিচুড়ি রান্না ও পরিবেশন শেখার জন্য বিদেশে ৫০০ জনকে পাঠানোর প্রস্তাবটি নিয়ে সর্বমহলে বিরূপ সমালোচনা হওয়ায় সরকারের নীতিপ্রণেতারা ব্যাখ্যা প্রদানের জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েন।

প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেন ১৬ সেপ্টেম্বর সংবাদ সম্মেলন ডেকে বিষয়টির ব্যাখ্যা দেওয়ার একপর্যায়ে মেজাজ হারিয়ে সাংবাদিকদের গালমন্দ করেন। তাঁর ভাষায়, ‘বিএনপি-জামায়াতের লোকজন এখন সাংবাদিকতা পেশায় আসছেন। তাঁদের কোনো জ্ঞানগরিমা নেই। হুট করে একটা লিখে দিলেই মনে করেন, সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়ে গেল।...আমার এলাকায় বিএনপির যত ছেলে ছিল, সবাই সাংবাদিক হয়ে গেছে। আপনাদের অনুরোধ করব, এসব বিএনপির সাংবাদিক নতুন কালের সাংবাদিকতায় আসছে। এদের একটু নজরে রাখবেন, সরকারের যেন বদনাম না হয়।’

প্রতিমন্ত্রীর এহেন আক্রমণ সমালোচকদের তূণে আরও বাণ জুগিয়েছে। সোহরাবের কলামের মূল সুরটিও প্রশ্নবোধক। তিনি লিখেছেন, ‘যেসব দেশে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য দুপুরের খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছে, সেসব স্থানে স্থানীয় জনগণই মুখ্য ভূমিকা পালন করেন। বাংলাদেশেও এর উদাহরণ আছে। একটি বেসরকারি সংস্থার প্রধান তাঁর অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে বলেছেন, তাঁরা শিক্ষার্থীদের মায়েদের খিচুড়ি রান্নার দায়িত্ব দিয়েছেন। একেক দিন একেকজন মা শিক্ষার্থীদের জন্য খাবার রান্না করে নিয়ে আসেন।’

সোহরাব হাসান যে স্কুল ফিডিং মডেলটির প্রসঙ্গ টেনেছেন, বাংলাদেশে তার উদ্‌গাতা ও পথিকৃৎ রিসার্চ ইনিশিয়েটিভস বাংলাদেশ (রিইব) নামের গবেষণা সংস্থা। রিইবের চেয়ারম্যান ড. শামসুল বারী ও এর নির্বাহী পরিচালক মেঘনা গুহঠাকুরতা। প্রফেসর আনিসুর রহমান উদ্ভাবিত ‘পার্টিসিপেটরি অ্যাকশন রিসার্চ’ (পার) বা ‘গণগবেষণা’ পদ্ধতিতে সমাজের সবচেয়ে সুবিধাবঞ্চিত প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবন ও জীবিকার সংগ্রামে কীভাবে ওই জনগণকে সংগ্রামের সরাসরি মূল কর্তা (সাবজেক্ট) হিসেবে সক্রিয় অংশগ্রহণে উদ্বুদ্ধ করা যায়, ২০০২ সাল থেকে রিইব দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে তারই মাঠপর্যায়ের অ্যাকশন রিসার্চ পরিচালনা করে চলেছে।

১৮ বছর ধরে রিইব তার প্রাক্‌-স্কুলশিক্ষার (প্রি-স্কুল এডুকেশন) ‘গণগবেষণা মডেল’ হিসেবে ‘কাজলী মডেল’ পরিচালনা করে আসছে ১১৭টি গ্রামে। (‘কাজলী’ রিইবের চেয়ারম্যান ড. শামসুল বারীর গ্রামের নাম। এই গ্রামেই মডেলটির প্রথম সফল প্রয়োগের কারণে মডেলটিকে ‘কাজলী মডেল’ অভিহিত করা হয়েছে।) এই কাজলী মডেলে গ্রামের সবচেয়ে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর পরিবারগুলোর ২৬ জন ছেলেমেয়ে নিয়ে একেকটি প্রাক্-স্কুলশিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয় গ্রামেরই কোনো পরিবারের উঠানের একটি ঘরে। টিনের ছাউনি-বেড়ার ঘরটির দরজা-জানালা বাদ দিয়ে চারদিকেই ২৬ জন ছাত্রছাত্রীর জন্য ২৬টি ব্ল্যাকবোর্ড ঝোলানো থাকে। প্রত্যেক ছাত্রছাত্রীকে তার নিজস্ব বোর্ডে লেখার বা ছবি আঁকার স্বাধীনতা দেওয়া হয়। এক বছরের কারিকুলাম ও শিক্ষা উপকরণ সরবরাহ করে রিইব।

আমার দৃঢ় বিশ্বাস, আমলাতান্ত্রিকতা পরিহার করে কাজলী মডেল প্রয়োগ করলে কর্মসূচির ব্যয় তিন ভাগের এক ভাগে নামিয়ে ফেলা যাবে। দুর্নীতি ও অপচয়ও অনেকখানি কমানো যাবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কি বিষয়টা ভেবে দেখবেন

শিক্ষকের বেতন দেন ছাত্রছাত্রীদের অভিভাবকেরা। সকাল ৮টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত স্কুল, মাঝখানে আধঘণ্টা গান ও খেলাধুলার ছুটি। ১২টার সময় সব ছাত্রছাত্রীকে রান্না করা খাবার পরিবেশন করা হয়, যে খাবার একেক দিন একেক ছাত্রছাত্রীর মা রান্না করে নিয়ে এসে পরিবেশন করে যান শিক্ষকের সহায়তায়। এই এক বছরে ছাত্রছাত্রীর যে প্রাক্‌-স্কুলশিক্ষার উন্নয়ন হয়, সেটা অত্যন্ত প্রশংসনীয়। পরের বছর তারা গ্রামের প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি হয়ে যায়, ওখানে ক্লাসের সেরা ছাত্রছাত্রী হিসেবে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে তারা। ১৮ বছর ধরে রিইব সাফল্যের সঙ্গে এই কাজলী মডেল পরিচালনা করে চলেছে। দেশে ও বিদেশে বহু উন্নয়ন প্রকাশনায় এই মডেলের কথা উল্লিখিত হয়েছে। এর আকর্ষণীয় দিক হলো সামাজিক অংশগ্রহণমূলক মিড-ডে ফিডিং।

দেশে স্কুল ফিডিংয়ের পথিকৃৎ রিইব সম্পর্কে খুব বেশি মানুষ হয়তো জানে না, কিন্তু দেশ-বিদেশের অনেক এনজিও এবং অ্যাকশন রিসার্চ সংস্থা এই কাজলী মডেল অনুসরণ করছে। সোহরাব নাম উল্লেখ না করলেও যাঁর উদাহরণ টেনেছেন, তিনিও রিইবের কাজলী মডেলটি বাংলাদেশের বেশ কয়েকটি বেসরকারি সংস্থার পাশাপাশি তাঁর সংস্থায় গ্রহণ করেছেন। সরকার বিলম্বে হলেও দেশের প্রাইমারি স্কুলগুলোতে যে মিড-ডে ফিডিং চালু করছে, তাকে আমি একটি যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত হিসেবে সাধুবাদ জানাই এবং কর্মসূচিটির সাফল্য কামনা করি। এ ব্যাপারে সরকারের নীতিনির্ধারকেরা রিইবের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগাতে পারেন।

আমাদের সুস্পষ্ট প্রস্তাব হলো দেশের প্রতিটি জেলায় দুটো করে প্রাইমারি স্কুলে রিইবের কাজলী মডেলের অনুসরণে স্কুল ফিডিং পাইলট প্রকল্পের কার্যক্রম পরিচালনার দায়িত্ব রিইব গ্রহণ করতে প্রস্তুত। সামাজিক অংশগ্রহণমূলক এই বিকল্প কার্যক্রমে দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার আশঙ্কা যেহেতু থাকছে না, তাই এ ক্ষেত্রে সরকারের সাফল্য অর্জনের সম্ভাবনা উজ্জ্বলতর হবে। প্রাইমারি স্কুলের শ্রেণিগুলোতে যেহেতু ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ২৬ জনের বেশি হওয়াই স্বাভাবিক, তাই একজন মায়ের পরিবর্তে একাধিক মায়ের ওপর প্রতিদিনের খিচুড়ি রান্না ও পরিবেশনের দায়িত্ব প্রদানের সুযোগ থাকবে।

এই মডেলে যেহেতু খাদ্যের ব্যয়ভার অভিভাবকেরা বহন করবেন, তাই কর্মসূচি পরিচালনা সরকারের জন্য তুলনামূলকভাবে অনেক ব্যয়সাশ্রয়ী হবে। প্রয়োজনে খাদ্যের সরঞ্জাম সরবরাহে মায়েদের স্কুল থেকে ভর্তুকি সহায়তা প্রদানের ব্যবস্থা কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করা যায়। (কেরালা মডেলেও নিশ্চয়ই সামাজিক অংশগ্রহণের ব্যবস্থা রয়েছে!) বলা হচ্ছে, সরকারের প্রস্তাবিত ফিডিং প্রকল্পে ১৯ হাজার কোটি টাকা ব্যয় প্রাক্কলন করা হয়েছে।

আমার দৃঢ় বিশ্বাস, আমলাতান্ত্রিকতা পরিহার করে কাজলী মডেল প্রয়োগ করলে কর্মসূচির ব্যয় তিন ভাগের এক ভাগে নামিয়ে ফেলা যাবে। দুর্নীতি ও অপচয়ও অনেকখানি কমানো যাবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কি বিষয়টা ভেবে দেখবেন?

ড. মইনুল ইসলাম: অর্থনীতিবিদ ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক