স্কুলগুলো তো খুলে দিতে হয়!

ইউনিসেফ খুব করে বলছে, স্কুলগুলো খুলে দিন। ইউনিসেফ পরিচালক হেনরিয়েটা ফোর বিবৃতি দিয়ে সরকারগুলোকে বলছেন, স্কুল খুলে দিতে সব রকমের ব্যবস্থা নিন। আর স্কুল বন্ধ রাখার ক্ষতি পৃথিবী সইতে পারবে না। একটা বছর পার হয়ে গেল। শিক্ষার্থীদের ভীষণ ক্ষতি হচ্ছে। হেনরিয়েটা বলছেন, স্কুল বন্ধ রাখার জন্য শিশুদের ক্ষতি হচ্ছে, এ কথা জানা সত্ত্বেও আর স্কুল থেকে করোনা ছড়ায় না, এর প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও সরকারগুলো স্কুল বন্ধ করেই রাখছে। স্কুল বন্ধ থাকায় ৯০ ভাগ শিশু ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, স্কুল থেকে ঝরে পড়া ছেলেমেয়েদের সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে যাচ্ছে, তিন ভাগের এক ভাগ শিশুর সঙ্গে লেখাপড়ার আর কোনো যোগাযোগ থাকছে না। আর বহু শিশু অভুক্ত থাকছে, কারণ তারা স্কুলে গেলে খেতে পেত। স্কুল বন্ধ থাকলে শিশুরা নিরাপত্তাবলয়ের বাইরে চলে যায়, তারা যৌন নিপীড়ন, শিশুবিবাহ আর শিশুশ্রমের শিকারে পরিণত হতে পারে সহজে।

করোনা–যুদ্ধের অবসান ঘটেনি বটে, তবে বাংলাদেশ করোনা–যুদ্ধে এখন পর্যন্ত নানা অপূরণীয় ক্ষয়ক্ষতি সত্ত্বেও জয়লাভই করেছে। ঠিক সময়ে কলকারখানা, যানবাহন, অফিস–আদালত খুলে দেওয়ার কঠিন কিন্তু বাস্তবোচিত সিদ্ধান্ত নিয়ে ওই সময় সমালোচনা হলেও আজকে তা সঠিক বলেই প্রমাণিত হচ্ছে।

এখন এটা খুলে দেওয়ার সময় হয়ে এসেছে। যেটা করা যেতে পারে, শিক্ষকদের টিকা দিয়ে দেওয়া। শিক্ষকেরা প্রথম দফা টিকে নিয়ে নিতে পারেন। বিশেষ করে চল্লিশোর্ধ্ব শিক্ষকেরা। সুরক্ষা অ্যাপে শিক্ষকদের জন্য একটা ঘর খুলে দেওয়া যায়। আমার মনে হয়, মার্চে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো খুলে দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া উচিত।

এখন শুধু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই বন্ধ। এর মানে এই নয় যে শিশুরা বা অভিভাবকেরা, কিংবা শিক্ষকেরা ঘরবন্দী রয়ে যাচ্ছেন। ঢাকার রাস্তায় প্রচণ্ড যানজট, হাটেবাজারে গাদাগাদি ভিড়, বিয়েশাদিসহ সব সামাজিক অনুষ্ঠান হচ্ছে, ভোট হচ্ছে, মিছিল হচ্ছে, সভা–সমাবেশ হচ্ছে, কক্সবাজারে–কুয়াকাটায় মানুষের সঙ্গে মানুষ গাদাগাদি–ঠাসাঠাসি করে বিনোদন ছুটি উপভোগ করছে, শুধু স্কুল-কলেজ বন্ধ।

এখন এটা খুলে দেওয়ার সময় হয়ে এসেছে। যেটা করা যেতে পারে, শিক্ষকদের টিকা দিয়ে দেওয়া। শিক্ষকেরা প্রথম দফা টিকে নিয়ে নিতে পারেন। বিশেষ করে চল্লিশোর্ধ্ব শিক্ষকেরা। সুরক্ষা অ্যাপে শিক্ষকদের জন্য একটা ঘর খুলে দেওয়া যায়। আমার মনে হয়, মার্চে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো খুলে দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া উচিত।

কয়েকজন শিশুকে জিগ্যেস করেছিলাম, তাদের অনলাইন ক্লাস কেমন চলছে। একজন বলল, ‘আমার চোখে খুব চাপ পড়ে।’ স্কুল হলে তো মনিটরের দিকে তাকিয়ে থাকতে হতো না। এখন অনেকক্ষণ ধরে একটানা উজ্জ্বল পর্দার দিকে তাকিয়ে থাকলে তার চোখে সমস্যা হয়।

আমরা জানি, অনলাইন স্কুলের প্রধান অসুবিধা হলো এটা ধনী–গরিবের বৈষম্য প্রকট করে। শহরের সম্পন্ন পরিবারের শিক্ষার্থীরা এই সুযোগ কাজে লাগাতে পারে, গরিব ঘরের সুবিধাবঞ্চিত শিশুরা অনলাইনে লেখাপড়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত। সবচেয়ে বড় কথা হলো সামাজিকতা থেকে শিশুরা বঞ্চিত হচ্ছে। একটা শিশুকে বাইরে যেতে হবে, অন্যদের সঙ্গে মিশতে হবে। স্কুলে আসা-যাওয়া করা, সহপাঠীদের সঙ্গে বসা, কথা বলা, মেলামেশা করা, শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলা, তাঁদের কথা শোনা, বন্ধুদের সঙ্গে ঝগড়াঝাঁটি, মনোমালিন্য, মিলমিশ—সবকিছুই একজন শিশুকে শিক্ষা দেয়, এই পৃথিবীতে টিকে থাকার মতো করে শক্তপোক্ত করে। ঘরে বসে থাকতে থাকতে ছেলেমেয়েরা অসামাজিক হয়ে উঠবে। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘যেখানেই হউক না কেন, মানবসাধারণের মধ্যে যা-কিছু ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া চলিতেছে তাহা ভালো করিয়া জানারই একটা সার্থকতা আছে, পুঁথি ছাড়িয়া সজীব মানুষকে প্রত্যক্ষ পড়িবার চেষ্টা করাতেই একটা শিক্ষা আছে।’

আর আমাদের স্কুলগুলোতে চালু হোক মিডডে মিল। গরম খিচুড়ি। মুজিব বর্ষে গৃহহীনদের জমিসহ বাড়ি দেওয়া যে সবচেয়ে ভালো কর্মসূচি, এতে কোনো সন্দেহ নেই। এখন স্কুলগুলো খোলা হলে যদি মিডডে মিল চালু করা হয়, তা হবে মুজিব বর্ষের আরেকটা সুন্দরতম কর্মসূচি।

আমি যখনই গ্রামে যাই, বাচ্চাদের মুখের দিকে তাকাই। গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জের প্রত্যন্ত গ্রামে আমার দাদাবাড়িতে, কুড়িগ্রামের চিলমারীতে আমি ছেলেমেয়েদের চোখেমুখে দেখতে পেয়েছি পুষ্টিহীনতার ছাপ। আমার বুক কেঁপে উঠেছে। স্কুলগুলোতে মিডডে মিল কর্মসূচি চালু করুন, প্লিজ। এ বছর ৬৫ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মিডডে মিল চালু করার কর্মসূচি সরকার নিয়েই রেখেছে বলে জানি। এখন দরকার স্কুলগুলো খুলে দেওয়ার পদক্ষেপ নেওয়া।

শিক্ষা এবং পুষ্টির ওপরে বিনিয়োগ আতশবাজির মতো উড়ে গিয়ে ফুরিয়ে যাবে না। এসবই বিপুল প্রবৃদ্ধি হয়ে ফিরে আসবে। শিক্ষা হলো আগুনের পরশমণি, এর ছোঁয়ায় কেবল একটা জীবন পাল্টে যায়, তা নয়, একটা গরিব পরিবার দারিদ্র্যচক্রের বাইরে আসতে পারে, তা-ই নয়, একটা দেশও সোনায় পরিণত হতে পারে।


আনিসুল হক: প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক ও সাহিত্যিক