স্থানীয় সরকারের খোলস আছে, দর্শনটা নেই

রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগের তিনটি স্তর। সর্বোচ্চ স্তরে রাষ্ট্রপ্রধান রাষ্ট্রপতি, মধ্যস্তরে প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর মন্ত্রিপরিষদ এবং তৃতীয় স্তরে স্থানীয় সরকার। জনগণের সরাসরি ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান অঙ্গীকার করেছে, তিনটি স্তরই পরিচালিত হবে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বারা। রাষ্ট্রকে যদি মানবদেহের সঙ্গে তুলনা করা হয় তাহলে রাষ্ট্রপতি হলেন মাথা, প্রধানমন্ত্রী হলেন হৃৎপিণ্ড-ফুসফুস এবং স্থানীয় সরকার হচ্ছে ধমনি-শিরা-উপশিরা।

বাংলাদেশে যে কয়টা স্থানীয় সরকার ইউনিট আছে, তার মধ্যে পৌরসভার এলাকা সবচেয়ে ছোট। ভোটার সংখ্যাও অপেক্ষাকৃত কম। মোটের ওপর সবাই সবাইকে চেনে। কে কোন রাজনৈতিক দলের নেতা, কার পারিবারিক ঐতিহ্য কী, কার নৈতিক চরিত্র কেমন, কার সমাজসেবা ও এলাকার উন্নয়ন করার মানসিকতা কেমন, তা কমবেশি সবাই জানে। বিধি অনুযায়ী পৌরসভার নির্বাচিত প্রতিনিধিদের ক্ষমতা বা স্বাধীনতাও যথেষ্ট। সেই ক্ষমতার সদ্ব্যবহার যে পৌরসভা যত করবে, সেই পৌরসভা হবে তত সমৃদ্ধ, সেখানকার নাগরিকদের জীবনযাত্রার মান হবে তত উন্নত।

সম্প্রতি ৮৩টি পৌরসভার নির্বাচন হয়ে গেল। প্রথম ধাপে ২৩টি এবং ১৬ জানুয়ারি দ্বিতীয় ধাপে ৬০টি। নির্বাচনগুলোতে মারামারি, খুনখারাবি, ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া, যানবাহন ভাঙচুর যা হয়েছে তা অনাকাঙ্ক্ষিত কিন্তু অস্বাভাবিক নয়। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে সহিংসতা হয়ে থাকে। তবে বাংলাদেশে কিছু বাড়তি উপভোগ্য ব্যাপার থাকে। যেমন এবারও ‘কেন্দ্রের পাশেই ১০ মণ চালের বিরিয়ানি’ পাকানো হচ্ছিল। তবে যাদের জন্য তা রান্নার আয়োজন, সেই অতিথিদের ভাগ্যে তা জোটেনি। ‘আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সেই খাবার নিয়ে বিভিন্ন এতিমখানায় দিয়ে দেয়।’ [কালের কণ্ঠ]

৬০ পৌরসভার মেয়র পদে মোট ২২১ প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন, তাঁদের মধ্যে নারী ছিলেন ৭ জন। তাঁরা কেউ জয়লাভ করেননি। নির্বাচন হয়েছে দলীয় ভিত্তিতে। প্রধান দলগুলো থেকে জনা কয়েক নারীকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রে হতে পারত অন্তত এক–তৃতীয়াংশ। এতে প্রমাণিত হয় কোনো দলেই নারী নেতৃত্ব গড়ে ওঠেনি কোনো পৌরসভায়। যেখানে বহু নারী ইউএনও, ডিসি, এসপির দায়িত্ব দক্ষতার সঙ্গে পালন করছেন, বহু সচিব নারী। সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের গুরুদায়িত্ব পালন করছেন নারী নিজস্ব যোগ্যতায়, জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হওয়ার জন্য তাঁদের দরকার অনুকম্পার। অর্থাৎ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে নয়, মনোনয়নে। অথচ ব্রিটিশ পার্লামেন্টে বাংলাদেশি বাঙালি নারী সদস্য হচ্ছেন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। ইউরোপ, আমেরিকার স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোতেও বাঙালি নারীর সাফল্য প্রায়ই পত্রিকায় আসে।

পরাধীন ব্রিটিশ আমলে যখন গণতন্ত্র ছিল না, তখনো পৌরসভাগুলো পরিচালিত হতো মনোনীত বা নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের দ্বারা। তবে তখন জনপ্রতিনিধি নির্বাচনের পদ্ধতি এখনকার মতো ছিল না। একটা সমঝোতার ভেতর দিয়ে নির্বাচিত বা মনোনীত হতেন সবচেয়ে শ্রদ্ধেয়, যোগ্য ও জনপ্রিয় ব্যক্তিটি। অনেক পরে গোপন ভোটে নির্বাচনের প্রবর্তন হয়।

পশ্চিমের গণতান্ত্রিক বিশ্বে প্রতিটি ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে সুনির্দিষ্ট দর্শনের ভিত্তিতে; কোনো রাজা-বাদশাহ বা শাসকের খেয়ালখুশিমতো নয়। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সূচনা বা অনুশীলন স্থানীয় সরকার থেকে। ব্রিটিশ সরকার উপমহাদেশের মানুষকে গণতন্ত্র শিক্ষা দেয় ইউনিয়ন বোর্ড (বর্তমানে ইউনিয়ন পরিষদ) ও পৌরসভা নির্বাচন থেকে। ‘সমষ্টিগত ব্যক্তি-জনগণের’ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠাই ছিল স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার মূল দর্শন। বাংলাদেশে এখন স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার খোলসটাই শুধু আছে, তার চেতনা ও দর্শনটা হারিয়ে গেছে।

কোনো রাজনৈতিক দলের কোনো কমিটির কেউ নন, এমনকি সদস্যও নন, এমন সুযোগ্য ব্যক্তি সমাজে প্রচুর রয়েছেন। সমাজ যদি তাঁদের সেবা করার সুযোগ না দেয়, তাতে সমাজেরই ক্ষতি। দীর্ঘ প্রশাসনিক অভিজ্ঞতা রয়েছে এমন ব্যক্তি সব মফস্বল শহরেই আছেন। প্রবীণ আইনজীবী, শিক্ষক, অবসরপ্রাপ্ত সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা যদি জীবনের একটি পর্যায়ে গিয়ে স্থানীয় সরকার পরিচালনার দায়িত্ব পান, তাতে সমাজের লাভ। অন্যদিকে বুড়ো হলেই একজন যোগ্য, দক্ষ হবেন তা-ও নয়। ২৫-৩০ বছর বয়স্ক তরুণ-তরুণীও যে যোগ্যতার পরিচয় দেবেন না, তা কেউ বলতে পারে না। তাঁকে সুযোগ ও দায়িত্ব দিতে হবে। এ মাসেই ইউরোপের এক দেশে ২০ বছর বয়সী এক তরুণী, যাঁর শিক্ষাজীবন এখনো শেষ হয়নি, এক শহরের মেয়র হয়েছেন, পত্রিকায় দেখলাম।

কোনো দলের সমর্থন নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে নির্বাচিত হওয়া আর দলীয় প্রতীকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা এক জিনিস নয়। আমাদের যে রাজনৈতিক সংস্কৃতি, তাতে দলীয় প্রার্থী হয়ে নির্বাচিত হলে তিনি তাঁর দলের নেতা-পাতিনেতা ও কর্মীদের মনোরঞ্জন করতে করতেই নির্দলীয় নাগরিকদের সেবা করার অবকাশ পান না। দলীয় প্রতীকে নির্বাচন হলে এলাকায় দলাদলি বাড়বেই। শুধু নেতা-কর্মীদের হাত-পা ভাঙা নয়, লাশ পড়ার আশঙ্কা শুধু ভোটের সময় নয়, নির্বাচনের পরেও। মারামারি শুধু প্রতিদ্বন্দ্বী দলের সঙ্গে নয়, নিজেদের মধ্যেও। এবারের পৌরসভা নির্বাচন তার দৃষ্টান্ত।

দলীয় প্রতীকে নির্বাচন যদি খুব সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষও হয়, তাতে পরিস্থিতির হেরফের হওয়ার সম্ভাবনা নেই। দায়িত্ব পালনকালে দলীয়পনার প্রতিফলন থাকবেই। ব্যক্তিটি যদি খুব নিরপেক্ষ ও ন্যায়পরায়ণ হন, তাহলে তাঁর আরও বিপদ। কোনো ব্যাপারে ভিন্ন দলের কাউকে যদি সংগত কারণে সুবিধা দেন তাহলে তাঁর দলের নেতারা ক্ষিপ্ত হবেন। দলের কেন্দ্রীয় নেতারা তাঁকে ধমকাবেন, ‘তোমারে এই জন্য নমিনেশন দিছিলাম? নিমকহারামি করতেছ। তোমাকে দেখাইতেছি।’

দেশে সিটি করপোরেশন ১১টি এবং পৌরসভা ৩২৯টি। সুযোগ্য নেতৃত্বের অভাবে এবং নষ্ট রাজনীতির কারণে অধিকাংশ পৌরসভার অবস্থা শোচনীয়। অনেক পৌরসভা তার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা ঠিক সময় দিতে পারে না। অবশ্য মেয়র-কমিশনারদের বেতন বকেয়া আছে, এমন খবর কাগজে দেখিনি।

দলীয় প্রতীকে নির্বাচন যেমন সংকীর্ণ রাজনৈতিক স্বার্থে, তেমনি কতকগুলো হাটবাজারকে ‘পৌরসভা’ বানানোও রাজনৈতিক স্বার্থে—জনস্বার্থে নয়। দুর্নীতি কমানোর উপদেশ দেওয়া অরণ্যে রোদন মাত্র। কিন্তু পৌরসভা যখন করাই হয়েছে, তখন শহরের সুযোগ-সুবিধা সেখানকার নাগরিকদের প্রাপ্য। পানি, বিদ্যুৎ, পয়ঃপ্রণালি, পার্ক, খেলার মাঠ প্রভৃতি থাকতে হবে। সে জন্য আয় বাড়াতে হবে। শুধু গৃহকরের টাকায় আধুনিক শহর গড়া কোনো মেয়রের পক্ষেই সম্ভব নয়। কর্মসংস্থান বাড়ানোর উপায় উদ্ভাবন করার ক্ষমতা থাকতে হবে মেয়রদের। নাগরিকদের উন্নত শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা দিতে না পারলে নামে পৌরসভা থাকলেই কী, না থাকলেই কী। এবং তেমন পৌরসভার মেয়র-কমিশনার হওয়ার মধ্যে গৌরব নেই।

সৈয়দ আবুল মকসুদ: লেখক ও গবেষক